অপেক্ষমাণের শৈলিবিচার রচনাটি সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যনাটক : ইতিহাস, সমাজ, রাজনীতি ও শিল্প [পিএইচডি অভিসন্দর্ভ] এর অংশ। গবেষনাটির অথোর জান্নাত আরাসোহেলী। এই অভিসন্দর্ভের (পিএইচডি) বিষয় বাংলা নাটক – ইতিহাস ও সমালোচনা। প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষাবর্ষ: ২০১৭-২০১৮। গবেষণাকর্মটি সাহিত্যের শিক্ষার্থীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় আমরা সাহিত্য গুরুকুলে পুন-প্রকাশ করলাম।
অপেক্ষমাণের শৈলিবিচার
সৈয়দ শামসুল হক তাঁর অপেক্ষমাণ নাটকে সমকালীন সমাজ, রাজনীতি, ইতিহাস প্রসঙ্গ উপস্থাপনার মাধ্যমে জনগণের শুভচেতনা জাগ্রত করে সংস্কারমুক্ত পরিন্দ্রো একটি সমাজ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। এ নাটকের চরিত্রায়ণ কৌশল সৈয়দ শামসুল হকের অন্যান্য কাব্যনাটকের তুলনায় স্বতন্ত্র। এখানে একটি চরিত্র বহুস্বরে ব্যল্পনায় উরাজিত হয়ে উঠেছে।
ইবসেনের নাটকের চরিত্র সৈয়দ হকের নাটকের চরিত্র বনে গেছে। আবার, সৈয়দ হকের নির্মিত চরিত্র ইবসেনের নাটকের চরিত্রে অভিনয় করেছে। চরিত্রের এমন মিথষ্ক্রিয়া নাটকটিকে দিয়েছে ভিন্নতর ব্যঞ্জনা। জাবার একটি চরিত্র একাধিক ভূমিকার অভিনন্য করায় অল্পসংখ্যক কুশীলব নিয়ে নাটকটিরা সফল মঞ্চায়ন পর হয়েছে।
যে-কোনো নাট্যপ্রযোজনার জটিল প্রতিবার এটি ইতিবাচক দিক। এরপর আবার নাটকের শেষে আকস্মিকভাবে নাট্যকারদের মঞ্চে উপস্থিতি দর্শকদের মাঝে যেমন সাড়া জাগিয়েছে, তেমনি নাটকটির আঙ্গিককে করে তুলেছে অভিনব। নাটকের অভ্যন্তরে নাট্যকারের এমন উপস্থিতি আমাদের দৃষ্টিতে বাংলা কাব্যনাটকের ইতিহাসে বোধ হয় আর ঘটেনি। সেনিক নিয়েও এ নাটকটির মধ্যে নতুনত্ব পরিলক্ষিত হয়।
সৈয়দ শামসুল হক সঙ্গত কারণেই ইবসেনের মূল রচনা থেকে গ্রহণ-বর্জনের মাধ্যমে আলোচ্য নাটকে চরিত্র সংযোজন করেছেন। যেমন, ইবসেন রচিত এ ডলস হাউস নাটকের প্রধান চরিত্রসংখ্যা পাঁচ হেলমার, ভার স্ত্রী মোরা, নোরার বন্ধু মিসেস লিন, মেলমারের বন্ধু ডাক্তার র্যাঙ্ক ও নিলস জলসতাদ।
এছাড়া নাটকে গৌণ কিন্তু অপরিহার্য চরিত্রের ভূমিকা পালন করেছে আরও কিছু চরিত্র। এরা হলো হেলমার নোরার তিন সন্তান, তাদের ধাত্রী আান, গৃহপরিচারিকা ও কুলি চরিত্র। তবে সৈয়দ শামসুল হক তাঁর অপেক্ষমাণ নাটকে কেবল নোৱা ও তার স্বামী মেলমারের সরিন উপস্থিতি ও কথোপকথন যুক্ত করেছেন। এছাড়া পরিপ্রেক্ষিতকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্যও বেশকিছু চরিত্রের পরোক্ষ উপস্থিতি রয়েছে।
অন্যদিকে এন এনিমি অব দ্য পিপল নাটকের উল্লেখযোগ্য চরিত্র সংখ্যা এগারো। এরা হলো নাটকের প্রধান চরিত্র ডাক্তার স্টকম্যান, তার স্ত্রী মিসেস স্টকম্যান, হেলে মর্টেন ও ইয়েলিফ, ডাক্তারের স্কুল শিক্ষিকা কন্যা পেট্রা, ডাক্তারের জ্যেষ্ঠভ্রাতা নগরপিতা পিটার স্টকম্যান, ডাক্তারের শ্বশুর মর্টেন বিল, পত্রিকার সম্পাদক হোডস্টাড, পত্রিকার সম্পাদনা সহকারী বিলিং, পত্রিকার প্রকাশক আসলাকসেন ও ডাক্তারের প্রকৃত নিঃস্বার্থ নাবিক-বন্ধু ক্যাপ্টেন হরস্টার।
এছাড়াও নাটকের প্রয়োজনীয় ক্লাইমেক্স তৈরিতে একজন মদ্যপ মাতাল এবং শহরের বেশকিছু জনচরিত্র ব্যবহার করেছেন নাট্যকার। কিন্তু সৈয়দ শামসুল হক তাঁর অপেক্ষমাণ নাটকে মূলরচনার সব চরিত্র গ্রহণ করেননি। তিনি কেবল প্রধানতম চরিত্র ডাক্তার স্টকম্যান, খলচরিত্র মেয়র পিটার স্টকম্যান, ডাক্তারের স্ত্রী চরিত্র নিয়ে নাটকের কাহিনি সাজিয়েছেন।
অন্যদিকে, তাঁর স্বরচিত নাটক ঈর্ষার মূল নাট্যকাহিনিতেও মাত্র তিনটি চরিত্রেরই শরীরী উপস্থিতি ছিল প্রৌঢ় শিক্ষক চরিত্র, যুবক শিক্ষার্থী এবং যুবতী। চরিত্রসংখ্যা সীমিত হওয়ার কারণে অপেক্ষমাণ নাটকের ক্ষুদ্র পরিসরেও তাদের তিনজনকেই কমবেশি ক্রিয়াশীল রেখেছেন। নাট্যকার। আবার আলোচ্য নাটকে তিনি সম্পূর্ণ নতুন কিছু চরিত্র এনেছেন। যেমন, স্টেশন মাস্টার, কুলি, ব্রেকডান্সারের দল, কেরানি প্রভৃতি।
বস্তুত, তিনটি নাট্যকাহিনিকে একই ক্যানভাসে উপস্থাপনের প্রয়োজনে সৈয়দ শামসুল হক মূল নাটকে চরিত্রের এমন সংযোজন-বিয়োজন করেছেন। এতৎসত্ত্বেও মূল নাটকের রসাস্বাদনে বিঘ্ন ঘটেনি।
অপেক্ষমাণ এর নাট্যকাহিনি শুরু হয়েছে কোরাস চরিত্রের মাধ্যমে, নিশুতিরাতে রেলস্টেশনের প্লাটফর্মে। কোরাসে নাট্যকার যে চরিত্রগুলি ব্যবহার করেছেন তারা উক্ত স্টেশনের স্টেশন মাস্টার, কুলি ও কেরানি। এরাই বিভিন্ন সময়ে নাটকের প্রয়োজনে বিভিন্ন চরিত্রের ভূমিকা পালন করেছে।
এরাই কখনো ব্রেকডান্সারের দলভুক্ত হয়ে নাটকের মূলসূত্র দর্শকের সম্মুখে উপস্থাপন করেছে, কখনো এন এনিমি অব দ্য পিপলের জনগণের ভূমিকা পালন করেছে, আবার কখনো কখনো দৃশ্যানুযায়ী মঞ্চসজ্জার কাজে ভূমিকা পালন করেছে। অর্থাৎ কোৱাসকে সৈয়দ শামসুল হক নাট্যপরিবেশনার সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছেন।
কোরাসের এই বহুমাত্রিক উপস্থাপনা বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে অভূতপূর্ব ঘটনা। নাটাকার অপেক্ষমাণ নাটকের প্রারম্ভে যে মঞ্চ নির্দেশনা প্রদান করেছেন, সেখানেই কোরাসের এমন বহুবিধ ব্যবহার সম্পর্কে দর্শকদের ধারণা দেবার প্রয়াস পেয়েছেন :
শূন্য মঞ্চ। অন্ধকার মঞ্চের ওপর প্রথমে কয়েকটি তীব্র আলোর বৃত্ত নাচানাচি করে। তার কিছুক্ষণ পরে মধে প্রবেশ করে ব্রেকডান্সারের দল। এরা আসলে স্টেশনের মাস্টার, কুলি ও কেরাণীর দল। গাতে সেই রকমেরই ইউনিফর্ম, কিন্তু তাদের হাতে ধরা নাটকের ট্রাজেডি ও কমেডির একটি করে মুখোশ। এরা কোরানের ভূমিকা পালন করবে – দৃশ্যের প্রয়োজনে মঞ্চ সাজাতে আসবে। সঙ্গীতের সঙ্গে তারা ব্রেকডান শুরু করে। (কাব্যনাট্যসমগ্র ৫০১ )
মূলত, প্রাচীন গ্রিক নাট্যকলায় নাট্যকারগণ কোরাসের ভূমিকাকে যেভাবে নাটকে প্রদর্শন করেছেন, সৈয়দ শামসুল হক তা আত্তীকৃত করে তার মধ্যে নবতর ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছেন। এই নাটকে কোরাসের বহুমাত্রিক ভূমিকা নাটকটির মধ্যপ্রদর্শনকে যেমন সহজতর করে তুলেছে, তেমনি চরিত্রাধিক্যের জটিলতা থেকে নাটকটিকে মুক্ত করেছে।
অপেক্ষমাণ শুরু হয়েছে রেলওয়ের প্লাটফর্মে তিনটি নাটকের প্রধান তিনটি চরিত্রের পারস্পরিক সংলাপ বিনিময়ের মাধ্যমে তারা নিজেরাই প্রসঙ্গক্রমে নিজেদের বর্তমান চরিত্র বদলে ফিরে গেছে অতীতে, এবং দর্শকদের সম্মুখে তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া বেদাদায়ক কাহিনি অভিনয়কলার মাধ্যমে উপস্থাপন করছে।
নাটকের প্রৌঢ়চরিত্র কখনো হয়ে উঠেছেন সৈয়দ শামসুল হকের দ্যা নাটকের প্রবীণ অধ্যাপক, কখনো হয়েছেন এ ডলস হাউস নাটকের নোরার স্বামী হেলমার, আবার কখনো এন এনিমি অব দ্য পিপল নাটকের খল চরিত্র নগরপিতা পিটার স্টারম্যান। নাট্যসমাপ্তিতে আবার তিনি প্রত্যাবর্তন করেছেন ঈর্ষা নাটকের প্রৌঢ় চরিত্রে।
তবে মূল ঈর্ষা নাটকে যে অসূযাকাতর প্রৌঢ় শিল্পীকে দেখা যায়, যিনি স্বীয় শিল্পচর্চা আর জৈবিক প্রয়োজনে নিজের ছাত্রীকে ব্যবহার করেছেন, আবার শিল্পকর্মের আদর্শানুসারী না হওয়ায় জনৈক প্রতিভাবান ছাত্রকে পরীক্ষার খাতায় কম নম্বর দিয়েছেন, সেই ক্রুদ্ধ, ঈর্ষাকাতর প্রবীণ শিল্পী অপেক্ষমাণ নাটকে এসে ইতিবাচক চরিত্রে রূপান্তরিত হয়ে গেছেন।
ঈর্ষা নাটকে যেখানে তিনি ছিলেন হতাশায় মজ্জমান ব্যর্থ প্রেমিক সত্তা এবং যিনি তাঁরই প্রেমাস্পদ ছাত্রীর বিবাহিত জীবনকে তছনছ করে দেবার হুমকি দিয়ে বলেছিলেন
এত ঘৃণা অসহা এতই । এতই দূরত্ব আজ ? …..
দু’জনের মাঝখানে একটি যুবক আজ ?
প্রতিবন্ধী এখন যুবক আমারই একজন ছাত্র ?
সে তোমাকে নগ্ন করে দেখেছে কিন্তু এরই মধ্যে শোয়া হয়ে গেছে ? …..
আহ আ আ, কি যে কোষ হচ্ছে আমার। কোন হাঁ হাঁ কাধ (চা, কাব্যনাট্যসমগ্র: ৩২০ )
ক্রোধে মত্ত, প্রতিশোধে উন্মুখ সেই প্রবীণ অধ্যাপকই অপেক্ষমাণ নাটকে এসে শান্ত, স্থিত ও প্রজ্ঞাবান চরিত্রে রূপান্তরিত হয়েছেন। অন্তরের যাবতীয় পাপাচার, অশুদ্ধতা ধুয়েমুছে এ যেন তাঁর নবতর সত্তায় আ্যোদ্বোধন। তবে ঈর্ষা নাটকেও প্রৌঢ়ের আত্ম-অনুশোচনার ইঙ্গিত ছিল। তবে সেটি ছিল কিছুটা ধোঁয়াশাপূর্ণ।
সেখানে একবার তাঁর মনে হয়েছিল, মেয়েটির সঙ্গে প্রতারণার মাধ্যমে শরীরী সম্পর্কে যাওয়া তাঁর উচিত হয়নি, কেননা প্রতারণা ও মিথ্যাচার যাবতীয় শিল্প ও সুন্দরের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আর যাই হোক মিথ্যে দিয়ে, চাতুরি দিয়ে সত্য, সুন্দর ও শিল্পের স্তর সম্ভব নয়। কিন্তু পরক্ষণেই তাঁর মন ও শরীর মেয়েটির জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে।
ঈর্ষা নাটকের শেষে প্রৌঢ়ের সংলাপগুলো বিচার করলে সেটি সুস্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে ঈর্ষাকাতর প্রেমিকের মতোই তিনি সন্দেহ করেছেন মেয়েটি হয়তো যুবকের সঙ্গেই অন্য কোথাও মিলিত হচ্ছে। তাকে ফেরানোর আকাঙ্ক্ষায় ব্যাকুল হয়ে তিনি বলেছেন।
কোথায় সে? কোথায়? তুমি আছো কোথায় ? …
তুমি, তুমি, রক্তমাংসে যে তুমি, আমি সেই তোমাকে চাই ।
আমার ক্যানভাস হোক অমর, তোমার নদীতে আমি মরতে চাই। ঔ, কাব্যনাট্যসমগ্র: ৩৬৮)
অথচ অপেক্ষমাণ নাটকে এই কাম-ক্রোধে উন্মত্ত প্রৌঢ় চরিত্রটি বিস্ময়করভাবে বদলে গেছেন। নারীর শরীর। নিয়ে শিল্পচর্চা আর তাঁর আরাধ্য নয়; বরং প্রকৃতির অবারিত সৌন্দর্য উপভোগ করে তাকে স্বীয় ক্যানভাসে অমর করে রাখাই এখন তার অন্বিষ্ট।
ঈর্ষা নাটকে যুবক ছাত্রের পছন্দ ছিল প্রকৃতির রূপলাবণ্য ও বাস্তবদৃশ্য নিয়ে ছবি আঁকা। প্রৌঢ় চরিত্রটি মত ছিলেন ন্যুড আর বিমূর্ত চিত্রকলায় প্রকৃতির ছবি আঁকা একটা সময় তার কাছে মনে হতো শিল্পের নয় বরং ক্যামেরার চোখ দিয়ে সৌন্দর্য-অবলোকন। কিন্তু অন্তরের ঊর্যা আর পঙ্কিলতা ঝেড়ে ফেলে শুদ্ধতম সভায় উন্নীত হয়ে তিনি এখন ছুটে চলেছেন দূরের কোনো গ্রামে যেখানে অবারিত মাঠের প্রান্তে আকাশের কোলে টুপ করে ডুবে যায় দিনান্তের রক্তিম সূর্য; কিংবা খরায়, কন্যায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিপন্ন ফসলের খেতে উদীয়মান সূর্যের মনোলোভা ছবি।
রেলস্টেশনে দেখা পাওয়া যুবতী নারীকে (যেন এ ডলস হাউসের নোরাকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেছেন, এ রেল স্টেশনে বসে অপেক্ষা করা কেবল নিছকই রেলে চেপে গন্তব্যে প্রস্থানের জন্য নয়, বরং এ অপেক্ষা দিন বদলের। কালোকে ধুয়ে মুছে আলোতে পরিবর্তন করার। প্রতারণা থেকে বেরিয়ে এসে সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করার।
অপেক্ষমাণ নাটকে প্রৌঢ় চরিত্রটিই নোরা ও ডাক্তারের উদ্দেশ্যের সঙ্গে নিজের উদ্দেশ্যকে একাকার করে ফেলেছেন। অর্থাৎ সে-ই তিনটি চরিত্রের নেতৃত্ব দিয়ে তাদের উদ্দেশ্যকে একই ফ্রেমে বেঁধেছেন। বস্তুত প্রৌঢ় চরিত্রটিই এখানে নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হকের প্রতিনিধি হয়ে তিনটি নাটকের সারকথা দর্শকের সম্মুখে উপস্থাপন করেছেন।
নারী চরিত্রটি অর্থাৎ নোরা যখন নাটক শেষে বলে উঠেছে আমাদের ট্রেনের জন্য অপেক্ষা বোধ হয় শেষ হতে যাচ্ছে, তখন পুরুষ চরিত্রটি অর্থাৎ এন এনিমি অব দ্য পিপল নাটকের ডাক্তার স্টম্যান চরিত্রটি বলেছে- এ অপেক্ষার কেবল ট্রেনে চড়ে যাবার জন্য নয়, এ অপেক্ষা দিন বদলের। প্রৌঢ় চরিত্রটির উচ্চারিত সংলাপে সেই বক্তব্যই প্রতিধ্বনিত হয়েছে ।
প্রতারণা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন করে সব কিছু শুরু করবার।
ব্যক্তির জীবনের প্রতারণা।
জনতাকে প্রতারণা।
সংসারের প্রতারণা। (কাব্যনাট্যসমগ্র ৫৪৪ )
এখানে ব্যক্তির জীবনের প্রতারণা বলতে প্রৌঢ় নিজের জীবনের কথা বলেছেন। কেননা তিনি শিল্পচর্চার নামে ছাত্রীর ন্যুড এঁকে, তাকে ব্যবহার করে একদিকে যেমন তার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন, তেমনি শিল্পকে করেছেন অমর্যাদা। তাঁর অদূরদর্শী ও হীন তৎপরতায় তছনছ হয়ে গেছে দুজন সন্তানতুলা ছাত্রছাত্রীর জীবন। এই সত্য উপলব্ধি করেই তিনি এখন আত্মাকে শুদ্ধ করতে চাইছেন।
অন্যদিকে, জনতাকে প্রতারণার কথা বলে তিনি ইঙ্গিত করেছেন এন এনিমি অব দ্য পিপল নাটকের কাহিনি-অন্তর্গত নগরপিতার কথা। যিনি রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য তাঁর ভাই ডাক্তার স্টকহোমকে প্রতারিত করেছেন। ডরিত্রটি কোনো কিছু ব্যক্তিস্বার্থে জনতাকে ঠকাতে চাননি। শহরের পানিতে বিষক্রিয়ার কথা তিনি নির্দ্বিধায় জনগণকে অবহিত করেছেন। অথচ বিষয়টি চেপে গেলে তিনি তাঁর ভাই নগরপিতাকর্তৃক অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হতে পারতেন।
বরং সে সত্যে অবিচল থেকে সত্যকে প্রচারের জন্য সব হারিয়ে তিনি আজ পথে নেমে এসেছেন। যে জনতা তাকে ভুল বুঝে শহর ত্যাগে বাধ্য করেছে, সেই জনতার স্বার্থরক্ষায় তিনি আজ পথে পথে। আবার সংসারের প্রতারণা বলতে প্রৌঢ় এ ডলস হাউসের নারী চরিত্র অর্থাৎ নোরাকে বুঝিয়েছেন। কেননা পুরুষশাষিত সমাজের প্রতারণা থেকে মুক্ত হয়ে সেও জীবনানন্দে স্থিত হতে চেয়েছে। দিনবদলের এই জয়গানের কথাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে প্রৌঢ় চরিত্রের সংলাপে
হ্যাঁ, আমি সেই প্রাপ্তরে যাচ্ছি-
খরায় উজাড় হয়ে যাওয়া মাঠে সূর্য উঠছে- আঁকতে। (কাব্যনাট্যসহ ৫৪8)
অপেক্ষমাণ নাটকের প্রারমে তিনটি চরিত্রের পারস্পরিক আলাপের সূচনাও ঘটেছে ঈর্ষা নাটকের প্রৌঢ় চরিত্রের উদ্যোগে। নইলে ইবসেন নির্মিত চরিত্র নোরা এবং ডাক্তার স্টারম্যান তারা দুজনেই ছিলেন নিজেদের চিন্তায় আত্মমগ্ন, বিভোর। আশেপাশের ব্যক্তি বা পরিবেশ নিয়ে তাদের আগ্রহ ছিল না। নোরার এই আত্মমগ্নতা নাট্যকার মনির্দেশ অংশে একটি উপমার মাধ্যমে চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন।
এখানে তিনি নোৱাকে বলেছেন ছায়ামূর্তির মতো অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা নারী, যার বসনপ্রাপ্ত হাওয়ায় উড়ছে। এমনকি প্রৌঢ়ব্যাক্তি তাকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে কুশল বিনিময়ের জন্য এগিয়ে গেলেও নোরা তখনো তাকে লক্ষ করে না।
প্রৌঢ়ের সংলাপ এবং নোরার প্রতিক্রিয়ার যে মঞ্চনির্দেশনা নাট্যকার দিয়েছেন তা উল্লেখ করলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। অপেক্ষমাণ নাটকে প্রৌঢ়ের প্রথম সংলাপ ও নারী চরিত্রের প্রতিক্রিয়া নিম্নরূপ :
প্রৌঢ়। এই যে ?
নারী উত্তর দেয় না। যেমন সে শোনেই নি।
প্রৌঢ় এবার আর একটু কাছে এগিয়ে যায়।
প্রৌঢ়। আপনি কি যাত্রী? ট্রেন আবার বেশ দেরী আছে কিন্তু।
নারী এবারও কোনো উত্তর করে না বা সাড়া দেয় না। কাব্যনাট্যসমগ্র ৫০৪ ) এরপর প্রৌঢ় হাল না ছেড়ে আবারো বারোটি বাক্যসংবলিত একটি দীর্ঘ সংলাপ বলে নারীটিকে বাক্যালাপে আগ্রহী করে তুলতে চায়। এ পর্যায়ে মঞ্চে প্রথম নারী চরিত্রটি অর্থাৎ নোরার প্রথম সংলাপ শুনতে পাওয়া যায়, তবে সেটিও নারীর স্বাভাবিক চপলতাসুলভ নয়। বরং ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ একটি মাত্র বাক্যের সংলাপ : ‘আমি এখানেই ভাল আছি। কিন্তু বারংবার প্রৌঢ় চরিত্রটির উত্থাপিত নানান প্রসঙ্গ এবং বাক্যালাপের আস্তরিকতা একসময় প্রৌঢ়ের সঙ্গে তাকে আলাপে অনুপ্রাণিত করে তোলে।
সে প্রথমে প্রৌঢ়ের জীবনকাহিনি শ্রবণ করে। এরপর ধীরে ধীরে সে নিজের জীবনকাহিনি উন্মোচিত করে। অবশেষে তাদের এ আলাপে নিজে থেকেই যুক্ত হয় ওয়েটিং রুমে অপেক্ষারত অপর পুরুষ চরিত্র ডাক্তার স্টকম্যান। উল্লেখ্য এখানে স্পষ্টত প্রৌঢ়ের একক আগ্রহেই রেল স্টেশনে অপেক্ষারত তিনটি পৃথক চরিত্র একীভূত হয়ে তাদের জীবনের গল্পগুলো বিনিময় করে।
একটু বিবেচনা করলে বোঝা যায়, প্রৌঢ় ব্যাক্তির এমন উদ্যোগী হয়ে আলাপ জমানোর দুটি কারণ হতে পারে। প্রথমত, নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হক নিজেই যখন উদ্যোগী হয়েছেন আর্ন্তজাতিক ইবসেন নাট্যোৎসবে এ চরিত্রগুলির সম্মিলনের, সেক্ষেত্রে তাঁর নিজের রচিত নাটকের চরিত্র উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করবে সেটিই স্বাভাবিক। আর দ্বিতীয় কারণ হতে পারে যেহেতু তিনটি চরিত্রের মধ্যে অপেক্ষাকৃত বেশি বয়সী পৌঢ় চরিত্রটি।
তাই বয়সের অভ্যাস অনুসারে প্রৌঢ় ব্যক্তির সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতা অত্যন্ত স্বাভাবিক ধরে নিয়েই নাট্যকার অত্যন্ত কুশলী হয়ে প্রৌঢ়ের সঙ্গেই নোরার প্রথম আলাপ জমিয়েছেন। অর্থাৎ সৈয়দ শামসুল হক স্পষ্টত চর্যা নাটকের প্রৌঢ় চরিত্রের তুলনায় অপেক্ষমাণ নাটকে আলাপি স্বভাবের এক প্রৌঢ় চরিত্র নির্মাণ করেছেন। চরিত্রটির ইতিবাচক পরিবর্তনের যে ইঙ্গিত তিনি ইর্যা নাটকে রেখে এসেছিলেন, তারই পূর্ণাঙ্গ প্রকাশ ঘটিয়েছেন আলোচ্য নাটকে।
অন্যদিকে তিনি অপেক্ষমাণ নাটকে নারী ও পুরুষ নামে যে চরিত্রদুটির চিত্রণ ঘটিয়েছেন, তা পুরোটাই ইবসেন নির্মিত চরিত্রের প্রতিরূপ। যেহেতু তিনটি নাটককে সমীকৃত করে একটি নাটক রচনা করতে হয়েছে তাঁকে, তাই নাট্যরা ধরে রাখতে এবং সংহত অবয়ব প্রদানের প্রয়োজনে তিনি ইবসেনের চরিত্রদুটিকে বিস্তৃত আকারে গ্রন্থিত করেননি। তবে চরিত্রদুটির যে আংশিক ঝলক এবং দৃঢ়তা তিনি নাটকে উপস্থাপন করেছেন তাকে ইবসেন নির্মিত ডিটেইলস চরিত্রের সারবত্তা বলা যায় নিঃসন্দেহে।
নারী চরিত্রটি ইবসেনের নোরা চরিত্রের বাইরে ঈর্ষা নাটকের ছাত্রীর ভূমিকাতেও অভিনয় করেছে। তবে শেষাবধি ফিরে এসেছে নোৱা চরিত্রেই। এ ডলস হাউস নাটকে নোরা চরিত্রটির একটি রূপান্তর দেখিয়েছেন নাট্যকার ইবসেন। যেমন নাটকের প্রাথমিক অঙ্কে নোরার যে ছবি অঙ্কিত হয়েছে তাতে তাকে আমুদে, চলচপলা, মেহশীল মাত্রা ও একনিষ্ঠ পত্নী ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি। তার মিষ্টি চিনেবাদাম খাওয়া স্বামীর পছন্দ নয়।
তাই সে লুকিয়ে নিজের ভীষণ পছন্দের বাদাম যায়, প্রকাশ্যে স্বামীকে নিজের পছন্দ সম্পর্কে বলতে পারে না বা বলে না। বরং স্বামীর জেরার মুখে সে মনে করে স্বামীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে তার কখনোই যাওয়া উচিত নয়, হোক তা যতই সঠিক আর পছন্দের। হেলমার ও নোরার এতৎসংক্রান্ত সংলাপ উল্লেখ করা যেতে পারে
হেলমার। তুমি কি আজ মিষ্টির দোকানে যাওনি
নোৱা না তো! একথা বলছো কেন ? । ……
নোরা। ডানদিকে টেবিলের কাছে গিয়ে তোমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে যাওয়াটা আমার উচিত নয়।
হেলমার। না, নিশ্চয় না। (পুতুলের সংসার, ১ম অঙ্ক, ইবসেন- নাট্যসম্ভার, পৃ. ১২-১৩)
নোরার স্বামী যখন তাকে কথায় কথায় ‘মেয়েছেলে’ ‘বেহিসেবী নারী’ ‘উড়নচণ্ডী’ প্রভৃতি উক্তি করে তখন সে নীরবে সয়ে যায়, গায়ে মাখে না, বরং হেসে উড়িয়ে দেয়। আবার স্বামী হেলমার যখন তাকে ভালবেসে ‘পক্ষীরাণী’, ‘ক্ষুদে কাঠবিড়ালী’ প্রভৃতি প্রাণীবাচক বিশেষণ ব্যবহার করে, নোরা তখন সেগুলো সানন্দচিত্তে উপভোগ করে:
হেলমার। আমার পৃষ্ঠারাণীর গলা নাকি ।
মোরা। হ্যাঁ, পক্ষীরাণীর। …….
হেলমার। আমার কাঠবিড়ালী বাড়ি ফিরলো কখন ?
নোরা। এইমাত্র। (পুতুলের সংসার, ১ম অঙ্ক, ইবসেন-নাট্যসম্ভার, পৃ. ৯-১০)
অথচ এই নোৱাই কিছু ঘটনার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ অবশেষে পুরোপুরি বদলে যায়। সামাজিক প্রথা আর প্রচলন ভেঙে সে হয়ে ওঠে আত্মপ্রত্যয়ী নারী। যে সংসার, সন্তান ও স্বামী ছিল তার সার্বক্ষণিক ভাবনার, দৈনন্দিন কর্মের কেন্দ্রবিন্দু সে-সবকে পেছনে ফেলে সে নিজেকে আত্মানুসন্ধানে বেরিয়ে পড়ে।
অপেক্ষমাণ নাটকে সৈয়দ শামসুল হক রেলস্টেশনে অপেক্ষারত যে নারীর ছবি এঁকেছেন সে মূলত এই দৃঢ়প্রভায়ী নোৱা। সে এখন আর সংসারের পুতুল নয়, পুরুষের খেলার বস্তু নয়। বরং সমাজে নারীপুরুষের সমমর্যাদা ও অধিকারের দাবিতে সোচ্চার ও দৃঢ়কণ্ঠ। এই প্রত্যয়ের দীপ্তি তার অন্তরে ছিল বলেই সে রেলস্টেশনের অন্ধকারকে ভয় পায়নি, অচেনা পরিবেশে নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করেনি কিংবা ভয়বোধে আক্রান্ত হয়নি।
বরং প্রৌঢ়ের আহবানের মুখে নিজের জীবনকাহিনি তাকে খুলে বলতে পেরেছে। নাটকের শেষে যখন প্রৌঢ় তাকে জানিয়েছে প্রতারণা ছেড়ে তার প্রকৃতিসম্ভোগে বেরিয়ে পড়ার কথা, তখন সেও তার গম্ভব্য প্রসঙ্গে বলেছে
আপাতত যেখানে আমার জনু, সেইখানে।
নতুন জন্ম আমি নিতে চাই। নারী নয়, ব্যক্তির জন্ম ( কাব্যনাট্যসমগ্র ৫88)
এমনকি নারী চরিত্রটি তার এই নবজাত ব্যাক্তিস্বাতস্ত্র্যবোধ নাটকের শেষ সংলাপ অব্দি বজায় রেখেছে বা প্রমাণ করে গেছে। কেননা, অপেক্ষমাণ নাটকের শেষে যখন নাটকীয়ভাবে দুই দেশের দুই কালের দুজন নাট্যকারের সাক্ষাৎ ঘটে মঞ্চে, তখন প্রৌঢ় চরিত্রটি আবেগাপ্লুত হয়ে বলে ওঠেন এই মহান নাট্যকারগণই তাদের সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু নোৱা সেটি মেনে নেয় না। সে বলে- নাট্যকারগণ তাদের সৃষ্টি করেননি, বরং তারাই নাট্যকার সৃষ্টি করেছে :
প্রৌঢ় । আসলে এই যে দেখছেন ওঁরাই আমাদের সৃষ্টি করেছেন।
নারী। না। ভুল বললেন। আমরাই ওঁদের সৃষ্টি করেছি। ( কাব্যনাট্যসমগ্র ৫৪৫)
বস্তুত, নারীচরিত্রটির এমন দীপ্ত সংলাপের মাধ্যমে নোরার আত্নপ্রভারী রূপ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে। সে এখন পুরুষের ভুল শুধরে দেবার মতো সাহস সঞ্চার করতে পেরেছে। একজন নাট্যকার যেমন চরিত্রসৃষ্টি করেন, তেমনি ঘটনা কিংবা চরিত্রই যে প্রকৃতপক্ষে একজন কালজয়ী নাট্যকারের জন্ম অবশায়ারী করে তোলে সেই সতাই উদ্ভাসিত হয়েছে নোরার এই সংলাপে।
অপেক্ষমাণ নাটকের পুরুষ চরিত্রটি সৈয়দ শামসুল হক হেনরিক ইবসেনের এন এনিমি অব দ্য পিপল নাটকের ডাক্তার স্টকম্যান চরিত্র থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে রচনা করেছেন। ফলে এই চরিত্রের মধ্যে ইবসেন রচিত চরিত্র পুরোটাই মিশে আছে। সৈয়দ শামসুল হক আর সেখানে কোনো বদল আনেননি। ইবসেন যেমন একজন জনদরদি, প্রচণ্ড মেধারী ও আবেগি ডাক্তার চরিত্র নির্মাণ করেছেন, সৈয়দ হকও এই চরিত্র নির্মাণে সেই বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ রেখেছেন।
তাঁর নাটকে প্রথম পর্যায়ে এ চরিত্রটিকে তিনি দেখিয়েছেন একজন ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ। আত্মভোলা মানুষ হিসেবে। যিনি অত্যন্ত অনুরচিত্তে ওয়েটিং রুমে ক্রমাগত পায়চারি করেই চলেছেন, সহযাত্রীর প্রতি তাঁর কোনো আগ্রহ বা কৌতূহল নেই। তাঁর উপস্থিতি তখনই জানা যায়, যখন প্রৌঢ় চরিত্রটি নারী চরিত্রটিকে ওয়েটিংরুমে বসার আমন্ত্রণ জানিয়ে বলছেন
আসুন, ওয়েটিং রুমে বসবেন।
ওখানে আরো একজন আছেন।
রুমে তিনি পায়চারি করছেন সেই এসেছেন থেকে।
অদ্ভুত অদ্রলোক। একটি কথাও এ পর্যন্ত হয়নি।
দু’ একবার চেষ্টা করেছিলাম।
চোখমুখ দেখে তেমন ভালো ঠেকলো না।
তাই বাইরে বেরিয়েছিলাম। (কাব্যনাট্যস ৩০৫)
একপর্যায়ে নারীটি সম্পূর্ণ একা স্বামীগৃহ ছেড়ে সন্তানুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে শুনে প্রৌঢ় চরিত্রটি যখন বিলা প্রকাশ করে, তখন দেখা যায়, আত্মমগ্ন পুরুষ চরিত্রটি নারীটিকে সমর্থন করছে। এ পর্যায়ে কিন্তু চরিত্রটিকে আর আত্মভোলা ভাবগামীপূর্ণ বলে মনে হয় না, বরং সমাজসচেতন একজন সদালাপী, বাস্তববাদী মানুষ হিসেবেই তিনি দর্শকের সম্মুখে হাজির হয়।
তিনি দূর থেকে এঁদের কথোপকথন শুনে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন এবং নিজেও স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁর মতামত প্রকাশ করেছেন। তাঁর সংলাপে স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁর সৌজন্যবোধ, সুরুচি, প্রজ্ঞা ও পরিস্থিতি অনুধাবন ও বিশ্লেষণের ক্ষমতা
দুঃখিত, আমি দুঃখিত। একপাশে দাঁড়িয়ে আপনাদের কথা শুনছিলাম।
আশাকরি মনে কিছু করেননি। বা, নেমওকা হাজির হয়ে পড়িনি।
শুনলাম আপনি পেইন্টার। অনেক কথা বোঝে শোবেন।
কিন্তু আপনার কথাটার প্রতিবাদ না করে পারলাম না।
একা মানুষেরই কোনো ভয় থাকে না।
তবে, একা হয়ে ওঠাটাই যা মুশকিল।
সবাই পারে না। সবার কাছে একা মানেই অসহায়।
আমার কাছে নয়। আমি এটা আমার জীবন দিয়ে বুঝেছি। (কাব্যনাট্যসময় ৫22)
তার সংলাপ শোনার পর প্রৌঢ় চরিত্রটির মনে হয়, তিনি হয়তো কবি সাহিত্যিক বা আত্মমগ্ন প্রকৃতির লোক। যে কারণে তিনি তাঁকে প্রাচ্যভাববাদ চর্চার পুরোধা ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘একলা চলা’ বিষয়ক বিখ্যাত গানের পক্তি স্মরণ করিয়ে দিয়ে জানতে চান তিনি কি ভাববাদে আস্থা রেখে দুঃখের সমুদ্র পাড়ি দিতে চান। কিন্তু পুরুষ চরিত্র তখনি তাঁর ভ্রম সংশোধন করে বলেছেন। ভাববাদ নয়, বরং জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি অবশেষে একলা থাকার মন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছেন। তিনি তাই স্পষ্ট করে জানান :
না, অতটা কাব্য করে বলার বা দেখার লোক আমি নই।
আমি কঠিন বাস্তবের মানুষ।
সে হিসেবেই আমি নিজেকে গড়ে তুলেছি।
বাস্তবকে আমি বিচার করে দেখি, বিশ্লেষণ করে দেখি,
তারপর আমার কর্তব্য সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।
এটা আমার সিদ্ধান্তের কথা। (কাব্যনাট্যসমগ্র 223)
এরপর পুরুষ চরিত্রটি প্রৌঢ় এবং নারী চরিত্রটির কৌতূহলী দৃষ্টির সম্মুখে নিজের জীবনের ট্র্যাজিক আখ্যান বর্ণনা করেন। হেনরিক ইবসেন তিনটি অঙ্কের বিস্তৃত পরিসরে যে নাট্যকাহিনি বেশকিছু চরিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন, নাট্যকার সৈফল হত সেখানে পুরুষ চরিত্রের দীর্ঘ একটি সংলাপের মাধ্যমেই তা প্রকাশ করেছেন।
ইবসেনের মূল নাটকের যে অংশে নগরপিতা, ডাক্তার ও জনগণ মুখোমুখি হয়েছে সৈয়দ হক অপেক্ষমাণ নাটকে সেখান থেকেই শুরু করেছেন। এদেশের মানুষ, সমাজ ও রাজনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে তিনি নাট্যকাহিনি ও চরিত্র সাজিয়েছেন। ইবসেনের নাটকে ডাক্তার চরিত্রটি যেমন দেশপ্রেমিক, নির্লোভ, সত্যান্বেষী, নির্ভীক চরিত্রের, অপেক্ষমাণ নাটকেও চরিত্রটি সেরকম।
প্রকৃতপক্ষে ঘটনা ও চরিত্রের বিবর্তন বা পুনর্নির্মাণ নয়, সৈয়দ হকের উদ্দেশ্য ছিলো অতীতের বিখ্যাত নাট্যকারের বিখ্যাত চরিত্রকে সমকালের সমাজ, রাজনীতির সঙ্গে একাকার করে পরিবেশন তিনি দেখাতে চেয়েছেন শতবছর পরেও সব কালে সব দেশে, সব সমাজে হেনরিক ইবসেন কতটা প্রাসঙ্গিক।
আলোচ্য নাটকের পুরুষ চরিত্রটি ডাক্তার স্টকম্যান চরিত্রের বাইরে আরো একটি চরিত্রে অভিনয় করেছেন। প্রৌঢ় যখন নিজের কাহিনি অভিনয়ের মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন তখন এ চরিত্রটি যুবক ছাত্রের ভূমিকা নিয়েছে।
আবার নাটকের শেষপর্যায়ে মূল চরিত্রে প্রত্যাবর্তন করেছে। নাটকের শেষে আবারও তাকে প্রত্যক্ষ করা যায় দৃঢ়প্রত্যয়ী দিনবদলের পথিক চরিত্ররূপে। তিনি জানেন তাঁর প্রতীক্ষা কেবল ট্রেনের জন্য নয়, বরং
অপেক্ষা পরিবর্তনের।
বদলের – সবকিছু বদলে যাবার। ( কাব্যনাট্যসমগ্র ৫88)
ফলে তিনি ছুটে যেতে চেয়েছেন “শহরে শহরে গ্রামে গঞ্জে মানুষের কাছে সত্য তুলে ধরতে। কারণ তিনি জানেন সুযোগ কেউ কাউকে দেয় না, সুযোগ নিজেকেই সৃষ্টি করে নিতে হয়। যেমন গড়ে নিতে হয় নিজেই নিজেকে।
বস্তুত, ‘ইবসেনের নাটকগুলোর উপস্থাপন, চরিত্রায়ণ সাদামাটা হলেও সব মিলিয়ে এই সাধারণই একসময় অসাধারণ হয়ে ওঠে। নাটক যে সমাজকে উপস্থাপন করে, সেটিও নতুনভাবে দর্শকদের উপলব্ধি করান তিনি। ইবসেনের আগে নাটকে রাজা-রানি, বাদশা, বেগম, সেনাপতি – অর্থাৎ বীর ও অভিজাত শ্রেণির চরিত্র চিত্রায়ণ করা হতো। কিন্তু জনজীবন উপস্থাপিত না হয়ে উপেক্ষিত থাকত।
ইবসেন সাধারণ মানুষের কথা বলেছেন, সমাজস্থ অসংগতি ও নারীদের যথাযথভাবে উপস্থাপন করেছেন দক্ষতার সঙ্গে। সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যনাটকের চরিত্রনির্মাণ প্রসঙ্গেও একই মন্তব্য প্রযোজ্য। অপেক্ষমাণ কাব্যনাটকটিও এর ব্যাতিক্রম নয়।
হেনরিক ইবসেন তাঁর বিখ্যাত এ ডলস হাউস নাটকটি তিনটি অঙ্কের মাধ্যমে সমাপ্ত করেছেন। কিন্তু তাঁর মধ্যেই যুক্ত করেছেন গ্রিক পঞ্চাঙ্ক নাটকের বাগুনাসূত্র। অনাদিকে তাঁর এন এনিমি অব দ্য পিপল নাটকটিও রচিত হয়েছে তিনটি অঙ্কের কলেবরে। আবার ঈর্ষা নাটকটি সমাপ্ত হয়েছে তিনটি চরিত্রের সাতটি বৃহৎ সংলাপের মাধ্যমে।
সৈয়দ শামসুল হক অবশ্য অপেক্ষমাণ নাটকে প্রচলিত নাট্যফর্ম মেনে কোনো অঙ্ক বা দৃশ্য বিভাজনে যাননি। বরং একটি দৃশ্যের মধ্যেই পুরো নাটকটি সমাপ্ত করেছেন। ভিন্ন ভিন্ন নাটকের চরিত্রগুলো এখানে কেবল সংলাপ প্রক্ষেপণের নান্দনিকতায় স্বকীয় হয়ে উঠেছে। তিনটি বৃহৎ কলেবরের নাটককে একই দৃশ্যে মঞ্চায়নের এমন অভিনবত্ব নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য।
সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার (সিএটি) আয়োজিত ইবসেন আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব উপলক্ষ্যে ১৯ নভেম্বর ২০০৯ তারিখে শিল্পকলা একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার হলে অপেক্ষমাণ নাটকটির উদ্বোধনী মঞ্চায়ন হয়। নাটকটি প্রযোজনা করে নাগরিক নাট্যসম্প্রদায় পরিচালনা করেন নাট্যজন আতাউর রহমান। তিনি এ নাটকটির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র প্রৌঢ়ের ভূমিকায় অভিনয়ও করেন।
এছাড়া এ নাটেকের নারী চরিত্রে অভিনয় করেন অপি করিম ও যুবক ডাক্তার চরিত্রে অভিনয় করেন পান্থ শাহরিয়ার। বলাবাহুল্য পরিচালকের নির্দেশনার দক্ষতায় এবং অভিনেতাদের অভিনয় নৈপুণ্যে নাটকটি দর্শকদের মধ্যে সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়।
প্রাচ্য-পাশ্চাত্য নাটকের এমন অনন্য সংমিশ্রণের অভিনবত্ব প্রত্যক্ষ করে ঢাকার দর্শক মুগ্ধতা প্রকাশ করেন। এই জনপ্রিয়তার ধারাবাহিকতায় নাটকটি ২০১০ সালে মিশর আর্ন্তজাতিক নাট্যোৎসবে উপস্থাপনের জন্য আমন্ত্রণ পায়। এ সময়ে নাটকটির সমকালীনতা নিয়ে নির্দেশক আতাউর রহমান নিম্নরূপ মন্তব্য করেন
নাটকটির মধ্যে বর্তমান সময়ের অনেক কিছুই প্রতিফলিত হয়েছে। ফলে এর আবেদন অনেক বেশি। এজন্য দর্শকের কাছে সহজে পৌঁছে যায়। গতবছর ঢাকায় ইবসেন নাট্যোৎসবে এর প্রথম মঞ্চায়ন হয়। তখন মিশরের শিল্পকলার একজন কর্মকর্তা ঢাকায় নাটকটি দেখে যান। তিনিই আমাদের নাটকটি নিয়ে এক্সপেরিমেন্টাল এ উৎসবে আমন্ত্রণ করেছেন।
অপেক্ষমাণ নাটকের মঞ্চসফলতা নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করে দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে তিনি আরও মন্তব্য করেছিলেন :
আমার রক্তকরবী নাটকটি দেখে শম্ভু মিত্রা মঞ্চে উঠে এসে তাঁর বিমোহিত হওয়ার কথা দর্শকদের সামনে জানিয়েছিলেন। আমার বিশ্বাস, এ নাটকটিও তেমন একটি প্রযোজনা হবে।
অন্যদিকে, নাটকটির অন্যতম প্রধান চরিত্র নারীর ভূমিকায় অভিনয় করা নাট্যঅভিনেত্রী অপি করিম এ নাটকটিতে অভিনয়ের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে এক আলাপচারিতায় জানান।
নাটকটির প্রথম মঞ্চায়ন হয়েছিল গত বছরের নভেম্বরে। সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার (সিএটি) আয়োজিত আর্ন্তজাতিক ইবসেন উৎসবে। হেনরিক ইবসেনের দুটো নাটক এ ডলস হাউস ও অ্যান এনিমি অব দ্য পিপল এবং সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যনাট্য ঈর্ষার সমন্বয়ে এ নাটকটি রচনা করা হয়েছে।
এ নাটকে আমি অভিনয় করেছি মোরা ও যুবতী চরিত্রে। গতবছরের নভেম্বর মাসে আমরা রক্তকরবী নিয়ে কায়রো উৎসবে গিয়েছিলাম। সে উৎসব থেকে ফিরেই এ নাটকটির কাজ ধরতে হয়েছিল। মাত্র ১২ থেকে ১৫ দিন পেয়েছিলাম আমরা। এত অল্প সময়ে একটি মঞ্চনাটক তৈরি করে প্রদর্শন করা খুবই কঠিন কাজ। তবু আমরা সেই কঠিন কাজটাকে সত্যি করেছি।
এই নাটকে একই সঙ্গে দুটি ভিন্নধর্মী চরিত্রে আমাকে অভিনয় করতে হয়েছে। এটা সত্যি কঠিন কাজ। দুটি চরিত্রের পোশাক-আশাক, মানসিক অবস্থা, স্বভাব, সংলাপ সবই ভিন্ন। রাতদিন খেটে আমাকে এই নাটকের জন্য তৈরি হতে হয়েছে। তবে মূল রচনাগুলো আমার পড়া ছিল বলে কিছুটা উপকার পেয়েছি। প্রচণ্ড ভয়ে ছিলাম সংলাপ মুখস্থ করা নিয়ে। প্রতিদিন সকাল ১০ টা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত টানা আমাদের কাজ করতে হয়েছে।
অপেক্ষমাণ নাটকের ভাষানির্মাণের ক্ষেত্রে নাট্যকার নতুন করে সংলাপ লিখেছেন কম, বরং ইবসেন থেকে রূপান্তর করেছেন বেশি। আবার, নিজের লেখা পুরাতন নাটকের ভাষা বা সংলাপ হুবুহু তুলে ধরেছেন। ফলে এ নাটকের সংলাপে শিল্পের কারুকাজ – উপমা, অলঙ্কারের প্রয়োগ অপেক্ষাকৃত কম চোখে পড়ে।
ঊষা নাটকের যে অংশ তিনি হুবুহু তুলে ধরেছেন, যে অংশের ভাষার যে অপরূপত্ব, তা নতুন করে আলোচনা আমরা বাহুল্য মনে করছি। তবে হেনরিক ইবসেনের রচনা দুটি তিনি অনুবাদ করলেও তাকে এ-কাল ও সমাজের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করে তিনি সাজিয়েছেন। ফলে এ অংশগুলোতে ভাষার চমক, শব্দের নতুনত্ব, অলঙ্কার ও উপমার প্রয়োগ বেশ চোখে পড়ে। আর যেসব এলাকা তিনি নতুন করে বিন্যস্ত করেছেন সেখানেও তাঁর অনন্যতা দৃষ্টি এড়ায় না।
এ নাটকে তিনি উল্লেখযোগ্যভাবে সংগীত ও নৃত্যের প্রয়োগ করেছেন। নাটকে সূত্রধার বা কোৱাস হিসেবে ব্রেকডান্সারের দল যে গান ও নাচ পরিবেশন করেছে মঞ্চে, বাংলাদেশের মঞ্চনাটকে তাও অভিনব ঘটনা। আধুনিক রক গানের ধাঁচে মঞ্চে সংগীত পরিবেশন এবং তরুণসমাজে তুমুল জনপ্রিয় ব্রেকডান্সকে মঞ্চনাটকে উপস্থাপনের সম্ভাব্যতা তিনিই প্রথম ভেবেছেন। মূলত এমন সংগীত পরিবেশনা এবং নাচের মাধ্যমে তিনি নাটকে একটি পাশ্চাত্তা ধাঁচের আবহ ও শিহরণ সৃষ্টি করতে চেয়েছেন।
নাট্যকার ব্রেকডালার চরিত্রের উপযোগী করে যে সংগীত রচনা করেছেন রক ধাঁচে, সেখানে তিনি স্বভাবতই কোনো নির্দিষ্ট সুর সংযোজন করেননি। তিনি চেয়েছেন ব্রেকডান্স যেমন তারুণ্যের উদ্দীপনায় হৃদয়ের অভ্যন্তর থেকে উৎসারিত হয় এখানেও তেমনটা বজায় থাক। তিনি এমন করে পত্তজির মাত্রা নির্ণয় করেছেন, শব্দের মালা গেঁথেছেন, যাতে পেশাদার না হলেও এ গান মঞ্চে ঠিকই পরিবেশন করা যায়, এবং ধ্বনিঝংকারে ভিন্নতর ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করা যায়। ফলে আন্যানুপ্রাস, অন্ত্যানুপ্রাসের ঝংকারে গানগুলো আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। যেমন :
হেনরিক ইবসেন ইবসেন
হো হো ইবনে
হেনরিক ইবসেন।
হেনরিক ইবসেন ইবসেন
হো হো ইবনে
হেনরিক ইবসেন ……
দৃশ্য দৃশ্য
পুতুলের সংসার করে অবিমূখ
অবিমৃষ্য
আরো এক নাটকের সেই এক ব্যক্তি
ব্যক্তি ব্যক্তি
জনতার শত্রু সে চিহ্নিত হয় হোক
সত্যের পক্ষেই তার অভিব্যক্তি
বলেছেন
হো হো ইবসেন
হেনরিক ইবসেন। (কাব্যনাট্যস ৫০২)
এখানে স্পষ্টতই অনুমান করা যায় ধ্বনিমাধুর্যে, শব্দের সুষমবিন্যাসে সঙ্গীতের ভাষা কতটা উপযোগী এবং শিল্পমাধুর্যমণ্ডিত হয়েছে। যেহেতু এটি কোরাসের পরিবেশনা, তাই মূল পক্তির পরে আবার সে লাইন থেকে শব্দের পুনরাবৃত্তি সুরের নালিতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে। কেবল তাই নয়, সংগীতের ব্যবহারটি ঠিক নাটকে কেমন হবে, তা নিয়েও নাটকের প্রারম্ভে নাট্যকারের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। নির্দেশনাটি নিম্নরূপ :
সঙ্গীতের সঙ্গে তারা ব্রেক ডাগ শুরু করে।
সেই সঙ্গে গানের কথাগুলো এ হয়।
খানের কথাগুলোতে খুব একটা সুর দেবার দরকার নেই। ১-২/১-২ মাত্রার আবৃত্তির মতো করেও বলা যেতে পারে। মূল ব্যাপারটা হবে ব্রেক ডালের ড্রাম ও কী বোর্ডের সঙ্গীত নির্ভর। দলটি নেচে চলে। (কাব্যনাট্যসমগ্র :৫০১)
সৈয়দ শামসুল হক আলোচ্য নাটকে হেনরিক ইবসেনের মূল রচনা থেকে প্রায়ই হুবহু অনুবাদ করলেও তাঁর মতো জাত কবির হাতে পড়ে তা আরও প্রাঞ্জল ও নান্দনিক হয়ে উঠেছে। আবার, কাহিনির বুননের কারণে তিনি কিন্তু বলোপ কাটছাট করে রচনা করেছেন।
সমকালীনতা বলার রাখতে অনেককিছু বদল করেছেন। যেমন, নোরা ও তার স্বামী যখন ধর্মীয় বিধি-নিষেধ নিয়ে আলাপ করেছে, তখন তারা খ্রিষ্টধর্মাচার, যাজক, পাদ্রি চার্চ প্রভৃতি অনুষঙ্গ ব্যবহার করেছে। কিন্তু সৈয়দ শামসুল হক যখন সেটিকে অনুবাদ করেছেন তখন বাঙালি মুসলিম সমাজের ধর্মাচার এবং শিষ্টাচার মাথায় রেখেই তা করেছেন। যেমন এ ডলস হাউস নাটকে হেলমার যখন নোরাকে ধর্মের দোহাই দিয়ে আটকাতে চেষ্টা করে তখন নোৱা বলে
নোরা।
ধর্ম বলতে কী বোঝায় তা আমি সত্যিই জানিনে। […] বিয়ের সময় যাজক হ্যানসেন আমাকে যা বলেছিলেন সেটাই আমি কেবল জানি- তিনি আমাকে বলেছিলেন ধর্ম বলতে এই বোঝায় – ওই বোঝায়। এখান থেকে বেরিয়ে নিজের পায়ের ওপরে দাঁড়ানোর পরে আমি দেখতে চাই যাজক হ্যানসেন ঠিক কথা বলেছিলেন কি না। অন্তত, তিনি যা বলেছিলেন সে কথা আমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি না।
হেলমার। তোমার মতো যুবতীর মুখে এইরকম কথা শোনার কল্পনাও কেউ কখনও করেনি।
(পুতুলের সংসার, ইবসেন-নাট্যসম্ভার, পৃ. ৮৫)
অন্যদিকে সৈয়দ শামসুল হক তাঁর অপেক্ষমাণ নাটকে এ কথালাপ ফুটিয়ে তুলেছেন নিতান্ত সংলাপের মাধ্যমে, যেখানে সুস্পষ্ট হয়েছে সাধারণ বাঙালি মুসলিম পরিবারের শিষ্টাচার, জীবনাদর্শ :
স্বামী।
এত বোঝো, আর এটুকু বোঝো না যে তোমার স্থান হচ্ছে তোমার সংসারে। হ্যাঁ, সংসারেই। হাদিস কোরান, গীতা বাইবেল, মানে ধর্ম তোমাকে শেখায়নি?
স্ত্রী।
শুনতে তোমার হয়তো খারাপই লাগবে ধর্মটা যে কী, আমি ঠিক বুঝি না। ….. ধর্ম তো এই মোল্লারা যা বলে, পাদ্রাৱা যা বোঝায়, যা ব্যাখ্যা করো এবার আমাকে নিজের মতো করে বুঝতে হবে। জীবনের পাঠ নিয়ে দেখতে হবে সত্যটা আছে কোথায়। আমাকে জানতেই হবে মোল্লারা যা বলে তার কতখানি সত্য, আর কতটা মনগড়া। বা, ওরা যা বলে তা আমার বেলায় খাটে কিনা (কাব্যনাট্যস ৫১৫)
আবার এ ডলস হাউস নাটকের হেলমার চরিত্রের অপেক্ষমাণে পুরুষ চরিত্র) মুখে আরবি শব্দমিশ্রিত সংলাপ জুড়ে দিয়েছেন তিনি। নোরা বা নারী যখন তাকে জানিয়েছে মোরানির্ধারিত ধর্মে তার আপত্তি আছে, সে নিজের ধর্ম-কর্ম নিজেই বুঝে নিতে চায় বাস্তবতার নিরিখে তখন হেলমার তথা স্বামী চরিত্রটি জানিয়েছে স্বামী। তওবা করো, তওবা করো। মানুষ তোমার মুখে থুতু দেবে। (কাব্যনাট্যসমগ্র ৫১৫)
সৈয়দ শামসুল হকের কবিমানসের অনেকটা জুড়েই ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি তাঁর প্রায় রচনাতেই রবীন্দ্রনাথের উক্তি কিংবা রচনার অংশবিশেষ জুড়ে দিয়েছেন। ঈর্ষা কাব্যনাটকেও প্রসঙ্গক্রমে চরিত্রের মুখে রবীন্দ্রনাথের গান কিংবা কবিতার পক্তি উচ্চারিত হতে দেখা যায়।
অপেক্ষমাণ নাটকেও রবীন্দ্রনাথ প্রাসঙ্গিক ভাবে উচ্চারিত হয়েছে। এন এনিমি অব দ্য পিপল নাটকের ডাক্তার চরিত্রটি যখন বলেছে – একা মানুষেরই কোনো ভয় থাকে না। পিছুটানহীন মানুষই পারে নির্ভীক চিত্তে মিথ্যের মোড়কে জড়ানো সমাজের সঙ্গে অনুষ্ঠ চিত্তে লড়ে যেতে, তখন প্রৌঢ় চরিত্রটি তাকে রবীন্দ্রনাথের সংগীতের কথাই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। পাশ্চাত্য নাট্যচিন্তার সঙ্গে প্রাচ্যকবি রবীন্দ্রনাথের এই মেলবন্ধন নাটকটিকে করে তুলেছে অনন্য স্বাদী। প্রাসঙ্গিক এলাকা উল্লেখ করা যেতে পারে :
পুরুষ।
একা মানুষেরই কোনো ভয় থাকে না।
তবে, একা হয়ে ওঠাটাই যা মুশকিল।
সবাই পারে না। সবার কাছে একা মানেই অসহায়।
আমার কাছে নয়। আমি এটা আমার জীবন দিয়ে বুঝেছি।
প্রৌঢ়।
ও! আপনি তাহলে সেই গানের লোক মুশকিলে ভরসা দিতে চান?
“যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে। (কাব্যনাট্যসমগ্র 22 )
মূল এনিমি অব দ্য পিপলে যখন ডাক্তার স্টকম্যান, মেয়র পিটার স্টকম্যান ও জনতা সভামঞ্চে মুখোমুখি হয়েছে, তখন জনতার বাক্যালাপ ছিল উত্তর-প্রত্যুত্তরধর্মী একটি সাধারণ সভায় অংশগ্রহণকারীরা যেমন নিজেদের মতামত ব্যক্ত করে বা বক্তাকে প্রশ্ন করে ঠিক সেরকম। কিন্তু সৈয়দ শামসুল হক যখন এ অংশটি অনুবাদ করেছেন তখন এদেশীয় ঝাঁজ বজায় রেখেছেন।
বাংলা অঞ্চলে সাধারণ জনতার একটি বৈশিষ্ট্য হলো – কোনো কিছু পছন্দ না হলে ‘ভূয়া তৃষ্ণা’ বলে দূয়োধ্বনি তোলা। আবার, এদেশের মিছিলের জনপ্রিয় স্লোগানগুলোকেও নাট্যকার নাটকে উপস্থাপন করে পাশ্চাত্যের একটি নাটককে এদেশীয় সামাজিক বাস্তবতায় ঢেলে সাজিয়েছেন। যেমন
১. জনতা। ভূয়া ভূয়া
ভূয়া ভূয়া ( কাব্যনাট 220 )
২. রাজধানীর গোড়াতে আগুন জ্বালো।
জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো। (কাব্যনাট্যসমগ্র ৫২৫)
৩. চলো চলো রাজধানী চলো।
ষড়যন্ত্রের গোড়া মারো (কাব্যনাট্যসহ ৫20 )
৪. ডাক্তারের চামড়া তুলে নেবো আমরা।
ডাক্তারের চামড়া তুলে নেবো আমরা। (কাব্যনাট্যসমগ্র ৫২৬)
৫. জুতা মারো তালে তালে।
জুতা মারো দুই গালে (কাব্যনাট্যসমগ্র ৫২৭ )
এছাড়াও অপেক্ষমাণ নাটকের ভাষায় ব্যবহৃত কিছু নান্দনিক অলঙ্কার, উপমা, উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প, রূপক-প্রতীক, প্রবাদ-প্রবচন-বাগধারার দৃষ্টান্ত নিয়ে উপস্থাপন করা হলো :
উপমা
১. এক নারী মঞ্চের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে ছায়ামূর্তির মতো। ( কাব্যনাট্যসমগ্র ৫০৩ )
২. রাগ রাগ তো পানির মতো।
আগুন পেলে টগবগ করে ফোটে,
কিছুক্ষণ পরেই ঠাণ্ডা হয়ে যায়। (কাব্যনাট্যসমগ্র ৫০৭)
৩. যারাই মিথ্যার সঙ্গে বসবাস করে, জনতাকে ভুল পথে নিয়ে যায়,
আপন স্বার্থে ব্যবহার করে
মহামারীয় বীজাণু ছড়ানো কীটের মতো তাদের মেরে ফেলা উচিত। (কাব্যনাট্যসমগ্র ৫৩৩ )
উৎপ্রেক্ষা
১. খাতার ওপরে কামরুল তাঁর দ্রুত হাতে কলমের টান দিয়ে
চলেছেন-
আকছেন হীরামন পাখির শরীর, তার ঠোঁট, তার পালক, বিশাল আকাশ-
কামরুল এঁকে চলেছেন –
মেয়েটির বিস্ময়ভরা চোখের সমুখে যেন ঘটে যাচ্ছে
ইন্দ্রজাল (কাব্যনাট্যসমগ্র ৫৩৮ )
চিত্রকল্প
২. ভাবছি এবার থেকে প্রকৃতির ছবি আঁকবো।
যেমন এই যে অসাধারণ ভোরের কথা বললাম,
বিস্তীর্ণ পাথারের ওপর সূর্য উঠছে।
একটু একটু করে কাটাবন, শলাকাটা মাঠ,
শুকনো খড়ের স্তূপ, কথো মাটি,
ভোরের রক্তমাখা আলোয় ফুটে উঠছে, আঁকবো (কাব্যনাট্যসমগ্র ৫০৬)
৩. খাতার ওপরে কামরুল তাঁর দ্রুত হাতে কলমের টান দিয়ে
চলেছেন-
আকছেন হীরামন পাখির শরীর, তার ঠোঁট, তার পালক, বিশাল আকাশ-
কামরুল এঁকে চলেছেন –
মেয়েটির বিস্ময়ভরা চোখের সমুখে যেন ঘটে যাচ্ছে
ইন্দ্রজাল (কাব্যনাট্যসমগ্র ৫৩৮ )
রূপক / প্ৰতীক
১. এ তো আর আজকের দিনের হালকা পদ্মা নন।
ওক কাঠের দরোজা, উনবিংশ শতাব্দীর কঠিন
সমাজটার মতোই। (কাব্যনাট্যসমগ্র ৫20)
২. আমি অবাক হয়ে যাই কীভাবে মৃতের শাসনে জীবিতেরা আজ পড়ে আছে। (কাব্যনাট্যসমগ্র ৫:৩২ )
সমাসোক্তি
১. হ্যাঁ, রক্ত মিথ্যার আঘাতে সত্যের শরীর থেকে রক্ত করছে। (কাব্যনাট্যসমগ্র ৫৩৩ )
২. জীবনের মিথ্যা তোমাকে শিল্পের মিথ্যা করে তুলবে।
তোমার ছবি হবে প্রতারক হবে অশুদ্ধ মূষিত (কাব্যনাট্যসমগ্র: ৫৩৫)
বাগধারা / প্রবাদ / প্রবাদপ্রতিমবাক্য
১. একা হয়ে যেতে হয় সত্যের সম্মুখেই
শক্তিটা আছে শুধু সত্যেই (কাব্যনাট্যসমগ্র ৫০৩)
২. নারীর পক্ষে সিদ্ধান্ত শব্দটা অচল, বিস্ময়কর? (কাব্যনাট্যসমগ্র ৫০৮)
৩. সেটা হচ্ছে রাজধানীর মতলবী ফাঁদ। (কাব্যনাট্যসমগ্র ৫২৫)
৪. ডাক্তারের কাজ শুধু রোগের চিকিৎসা করা নয়, ডাক্তারের প্রথম কাজ আমার বিবেচনায় রোগের কারণ
নির্মূল করা। (কাব্যনাট্যসমগ্র ৫২৯)
৫. পিলে চমকে ওঠে কাব্যনাট্য ৫00)
৬. সত্যের পক্ষে যারা তারা চিরকালই সংখ্যালঘু (কাব্যনাট্যসময় ৫৩১)
৭. শক্তি তাদেরই হাতে যারা সত্যমিথ্যা বিচার করতে পারে, ভালো মন্দ স্পষ্ট করে নির্ণয় করার ক্ষমতা রাখে। (কাব্যনাট্যসমগ্র ৫৩১ )
৮. সত্য কাউকে মুকুট পরায় না। সত্য মানুষকে বিকশিত করে।
সত্য মানুষকে মুক্ত বায়ুতে নিঃশ্বাস নিতে দেয়। (কাব্যনাট্যসময় ৫৩১)
হেনরিক ইবসেন ছিলেন নওরেজিয়ান সাহিত্যের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। অবশ্য তিনি তাঁর মহৎ লেখনী ও দূরদর্শী শিল্পদৃষ্টির জন্যে দেশকালের গণ্ডি ছাপিয়ে হয়ে উঠছেন বিশ্বজনীন। তাঁর নাট্যরচনার একটি বিশেষ প্রবণতা হলো তাঁর নাটকে শিল্প এবং সমাজ যুগপৎভাবে অবস্থান করে।
প্রচলিত ভিক্টোরীয় সমাজের কুসংস্কার, গোঁড়ামি ও বিবিধ অসংগতি বাস্তবতার নিরিখে তাঁর নাটকে প্রদর্শিত হয়েছে। এ-গুণই হেনরিক ইবসেনকে সাধারণের চোখে অসাধারণ করে তুলেছে। বস্তুত, তিনিই প্রথম সমালোচকের দৃষ্টিতে সমাজকে দেখে নাটকের সমাপ্তিতে বৈচিত্র্য আনেন।
অর্থাৎ ইবসেনই প্রথম নাট্যকার, যিনি ইউরোপীয় নাট্য ঐতিহ্যের বিপরীত প্রান্তে দাঁড়িয়ে নাট্য রচনা করেন। এ জন্য তাকে মানুষের কথা ও সমালোচকদের তীক্ষ্ণ তীরও হজম করতে হয়েছে। […]. প্রথমে তাঁর চিন্তা ও কর্ম বিভিন্ন মহলে সমালোচিত হলেও পরবর্তী সময়ে সেই চিন্তাগুলোই সমগ্র ইউরোপে ও পরে বিশ্বসাহিত্যে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশেও সেই ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন সময়ে উদযাপিত হয়ে আসছে হেনরিক ইবসেন আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব; যাকে ঘিরে এদেশের প্রথিতযশা নাট্যকারগণ হেনরিক ইবসেনের বিভিন্ন বিখ্যাত নাট্যকর্ম অনুবাদ করেছেন, এবং দেশের স্বনামধন্য নাট্যদলগুলো সেসব নাটক মধ্যে পরিবেশনায় ব্রতী হয়েছেন। ফলে এদেশের নাট্যামোদী দর্শক ভিনদেশি এ
নাট্যকারের দর্শন ও সমাজবোধের সঙ্গে পরিচিত হতে পেরেছে। তবে সৈয়দ শামসুল হক এ ধারায় নিসন্দেহে অনন্যতা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি নাট্যজন আতাউর রহমানের অনুরোধে ইবসেনের নাটকের রসনির্যাস গ্রহণ করে তাঁর সৃষ্টিশীল কল্পনাবৃত্তিকে বহুদূর প্রসারিত করেছেন এবং তিনটি নাটকের মূলসার সমীকৃত করে সৃষ্টি করতে পেরেছেন কালজয়ী মৌলিক কাব্যনাটক অপেক্ষমাণ। এ-নাটকে সৈয়দ হক নাট্যপ্রতিভার যে স্বাক্ষর মুদ্রিত করেছেন তার দ্বিতীয় স্বাক্ষর বাংলাদেশের নাট্যাঙ্গনে বিরল।
আরও দেখুনঃ