লেনিনের দেশে লালনের মেয়ে । রোকাইয়া জাফরী

লেনিনের দেশে লালনের মেয়ে রোকাইয়া জাফরীর চীন ও রাশিয়া ভ্রমণ অভিজ্ঞতা অবলম্বনে রচিত একটি অনন্য ভ্রমণকাহিনী, যা বাংলা সাহিত্যের রাশিয়া ভ্রমণ সাহিত্যের ধারায় একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন। এই বইয়ে তিনি সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ার রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং মানবিক দিকগুলোকে গভীর অন্তর্দৃষ্টিতে তুলে ধরেছেন। রোকাইয়া জাফরীর লেখনীতে মিশে আছে লালন ফকিরের মানবতাবাদী চিন্তা ও রাশিয়ার বিপ্লবী ইতিহাসের ছোঁয়া, যা একদিকে আন্তর্জাতিকতাবাদকে জাগ্রত করে, অন্যদিকে মানবিক মূল্যবোধকে শক্তিশালী করে। বইটি পাঠকদের সামনে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে, যেখানে সংস্কৃতি, আদর্শ ও মানবিকতার মেলবন্ধন স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

 

লেনিনের দেশে লালনের মেয়ে । রোকাইয়া জাফরী

 

লেনিনের দেশে লালনের মেয়ে । রোকাইয়া জাফরী

রোকাইয়া জাফরী ১৯২৫ সালে সিরাজগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সৈয়দ আকবর আলী ছিলেন একজন প্রখ্যাত আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ। সেকালে সিরাজগঞ্জ শহরে কোন উচ্চ বিদ্যালয় না থাকায় তিনি ১৯৪০ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কোলকাতা থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং রাজশাহী বিভাগের মুসলিম মহিলাদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন। এরপর তিনি কোলকাতাস্থ লেডি ব্রাবোর্ণ কলেজ থেকে বি.এ. এবং ১৯৪৬ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এম. এ. ডিগ্রী লাভ করেন।

তিনি ১৯৪৫ সালে নিখিল বাংলা মুসলিম ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ছাত্রী সংগঠনগুলো মজবুত করে গড়ে তোলার দায়িত্ব তাঁকে নিতে হয়। ১৯৪৬-এর ২৬ ফেব্রুয়ারী যখন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সাহেবের সভাপতিত্বে কোলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ময়দানে বিরাট সমাবেশের আয়োজন করা হয় তখন তিনি নিজ হাতে তৈরি পাকিস্তানী পতাকা তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এরপর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ তাঁকে জেনানা “মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড” এর প্রধান সংগঠকরূপে নিয়োজিত করেন।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর তিনি স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাস শুরু করেন এবং ঢাকার “লেখক সমিতি” এর সদস্যা ও বাংলা একাডেমীর ‘আজীবন সদস্যাপদ’ লাভ করেন। ১৯৪৯-এ নিখিল পাকিস্তান মহিলা সমিতির পূর্ব পাকিস্তান শাখার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক নিযুক্ত হন এবং পরবর্তী বৎসরই তিনি অধ্যাপিকা পদে যোগ দেন হলিক্রস কলেজে। ঢাকাস্থ ওয়ারী এলাকায় “সিলভার ডেল” নামে একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুল চালু হয় তাঁরই প্রচেষ্টায়।

১৯৬১-তে তিনি ঢাকা মহানগরীর প্রথম মহিলা ম্যাজিস্ট্রেটরূপে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। মহিলা সংগঠন ও ঢাকা কর্মজীবী মহিলা সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকরূপে কার্যভার গ্রহণ এবং ওয়ারী মহিলা সমিতির ও পাবনা সমিতির সভাপতি পদে কার্যভার গ্রহণ করেন।

তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক সংগঠনে যোগদান এবং ঐ সংগঠনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে কার্যভার গ্রহণ করেন ১৯৬২ সালে। তিনি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য পদে নির্বাচিত হন। সক্রিয় বিরোধী রাজনীতির পাশাপাশি তাঁকে পূর্ব পাকিস্তান শাখার শিশু কল্যাণ সমিতির সভানেত্রীর কাজও করতে হতো। ১৯৬৫ সাল থেকে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ৯

১৯৬৩ সালের অক্টোবর মাস। এসময় লেখিকার কাছে সোভিয়েট ইউনিয়ন থেকে সেদেশের বিপ্লব দিবস উপলক্ষে এক নিমন্ত্রণপত্র এসে পৌঁছায়। বিপ্লব দিবস অনুষ্ঠানে যোগ দিতে না পারলেও নিমন্ত্রণের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ১১ই নভেম্বর সে দেশের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়েন। ঢাকা থেকে প্রথম করাচী ; করাচীতে তিনদিন বিরতির পর দিল্লী হয়ে তিনি ১৬ই নভেম্বর সোভিয়েট ইউনিয়নে এসে পৌঁছান।

১ গবেষকের কাছে লেখা রোকাইয়া জাফরীর সহোদর সৈয়দ কায়সার আলীর ২৩.০৯.৯৫ তারিখের চিঠি থেকে।পাকিস্তানের সাথে সোভিয়েট দেশের যখন কোন হৃদ্যতাই ছিলনা ঠিক এমন একটি সময়ে রোকাইয়া জাফরী সেদেশ ভ্রমণের সুযোগ পান। তখন সোভিয়েট ইউনিয়নকে বলা হতো লৌহ যবনিকার দেশ বা নিষিদ্ধ দেশ। খুব কম লোকই তখন সে দেশ ভ্রমণের সুযোগ পেতেন।

লেখিকা সতের দিন সোভিয়েট ইউনিয়নে অবস্থান করেছিলেন। বিশাল একটি দেশ ভ্রমণের পক্ষে এই সতের দিন নিতান্তই কম সময়। তবু তিনি সমগ্র সোভিয়েট সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা নিয়ে দেশে ফিরেছিলেন। দেশে ফিরে তিনি ‘লেনিনের দেশে লালনের মেয়ে’ নামে ভ্রমণ কাহিনীটি রচনা করেন। ভ্রমণ সাহিত্য হিসেবে এটি জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সমাজতান্ত্রিক দেশ সম্পর্কে জানতে আগ্রহী পাঠকদের কাছে ‘লেনিনের দেশে লালনের মেয়ে’ ছিল বহু প্রত্যাশিত একটি বই। বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৬ সালে। ১৯৬৮ সালে এর দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে।

দুই

সোভিয়েট ইউনিয়নের উদ্দেশে লেখিকা প্রথম ঢাকা থেকে করাচী যান। করাচী পৌঁছলে সোভিয়েট দূতাবাসের প্রতিনিধি এবং তাঁর আত্মীয় স্বজন তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। করাচীতে দু’দিন পি.আই.এ অফিস, ষ্টেটব্যাঙ্ক এবং হেলথ্ সার্টিফিকেট ইত্যাদি কাজে তাঁকে ব্যস্ত থাকতে হয়েছিল। বিদেশ ভ্রমণ যে সহজ ব্যাপার নয় এটা তিনি বিভিন্ন কাজে হাত দিয়ে টের পেয়েছিলেন।

করাচীর সোভিয়েট দূতাবাস তাঁর সম্মানে এক ডিনার পার্টির আয়োজন করেছিল। ক্যাভিয়ার ছিল ডিনারের প্রধান আকর্ষণ। তবে এটি লেখিকার একেবারেই পছন্দ হয়নি। রাষ্ট্রদূত তাঁকে ‘পাসিবো’ (ধন্যবাদ) ও ‘দোব্রাওতরা’ (সুপ্রভাত) নামে দুটি রুশ শব্দ শিখিয়েছিলেন। পনেরো তারিখ তিনি করাচী ছেড়ে দিল্লী রওনা হন ।

দিল্লী পৌঁছলে পাকিস্তান দূতাবাসের প্রতিনিধিরা তাঁকে স্বাগত জানান। রুশ দূতাবাসের কর্মকর্তা মিঃ ভরোসভও উপস্থিত ছিলেন তাঁকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য। মস্কোর প্লেন পরদিন থাকায় দিল্লীতে একরাত লেখিকাকে থাকতে হয়েছিল।

ভারতীয় ভিসা না থাকায় রাত্রিবাসের অনুমতির ব্যাপারে তিনি কিছুটা অসুবিধায় পড়েছিলেন। পরদিন এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইটে করে তিনি মস্কোর উদ্দেশে রওনা হন। দিল্লী থেকে মস্কোর দূরত্ব ৩,২৫০ মাইল। দিল্লী থেকে মস্কো পৌঁছতে সময় লেগে যায় প্রায় ছয় ঘন্টা। সন্ধ্যায় তিনি মস্কোর মাটিতে পা রাখেন। শ্রীমিতিভো বিমান বন্দরে তখন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছিল; একটু আধটু বরফও পড়ছিল কোথাও কোথাও। মস্কোর নিয়মে প্লেন থেকে নামবার আগেই পুলিশ যাত্রীদের পাসপোর্ট জমা নিয়ে নেয়। পাসপোর্ট জমা হলে নামবার অনুমতি মেলে।

প্লেন থেকে নেমেই লেখিকা সেখানকার শীতের পরিচয় পেয়েছিলেন। দেশ ছাড়ার আগে তিনি আত্মীয়, শুভাকাঙ্খী সবার মুখেই সোভিয়েটের ভয়ঙ্কর শীতের কথা শুনেছিলেন। ইতিহাসের দিকে তাকালেও শীত সংক্রান্ত কিছু কাহিনী স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যেমন অষ্টাদশ শতাব্দীতে সম্রাট নেপোলিয়ানের নেতৃত্বে যুদ্ধরত ফরাসী সৈন্যদল প্রচন্ড শীতের দাপটে পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়েছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ও সমগ্র পৃথিবীতে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী জার্মান সৈন্যদল শীতের তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পিছিয়ে এসেছিল ।

এয়ারপোর্ট টারমিনালে ‘সোভিয়েট ওম্যান’ পত্রিকার পক্ষ থেকে পত্রিকার হিন্দি সংস্করণের সম্পাদিকা মারিয়া গ্রিজুনোভা, সোভিয়েট মহিলা সংস্থার ডেপুটি চীফ নীনা ভরোনীনা ও পাকিস্তান দূতাবাসের পক্ষ থেকে মিঃ জিয়াউদ্দিীন আহমেদ তাকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত ছিলেন। সোভিয়েট দেশে শীতের তীব্রতা এত বেশী যে তিনি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ীতে বসেও হাড়ের কাঁপুনি অনুভব করছিলেন।

হোটেল বার্লিনে তাঁর থাকবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। হোটেল কক্ষের চাবি পেতেও তিনি সেখানে নতুন নিয়ম দেখেছিলেন। রাতে খাবার ঘরে সোভিয়েট ওম্যান’ পত্রিকার প্রধান সম্পাদিকা মারিয়া আফসানিকেভার এবং প্রধান সহ-সম্পাদিকা, মাতা ইনচুক লেখিকার সংগে পরিচিত হন। সোভিয়েট দেশে পানীয় হিসেবে হালকা মদ বা মিনারেল ওয়াটার ব্যবহার করা হয়। লেখিকা এ দু’টোর কোনটাই পছন্দ না করে ‘ফুকতো’ (ফলের রস) বেছে নেন।

পর দিন সকাল ১১টায় রুশ দেশের সফর তালিকা প্রস্তুতের জন্য তিনি ‘সোভিয়েট ওম্যান’ পত্রিকা অফিসে যান। তাঁর সম্মানার্থে পত্রিকার প্রধান সম্পাদিকা এক টি পার্টির আয়োজন করেছিলেন। পার্টিতে বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ করেন। সোভিয়েট দেশ ভ্রমণের পক্ষে দু’সপ্তাহ খুব কম সময় হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা আন্তরিকতার সংগে তাঁর সফর তালিকা প্রস্তুত করে দেন।

শহর ঘুরতে বেরিয়ে প্রথমেই মটরের মহিলা চালক দেখেছিলেন তিনি। তাঁর গাইড নীনা” তাঁকে পথের দুপাশের উল্লেখযোগ্য জিনিসগুলোর সাথে পরিচিত হতে সাহায্য করেছিল। নীনা তাঁকে জানিয়েছিল সোভিয়েট দেশে ফ্লাটগুলো ফ্যক্টরী থেকে তৈরী হয়ে আসে। রুশরা খুব কম সময়ে মানুষের বাসস্থানের সমস্যা সমাধান করেছে। তিনি অবাক হয়েছিলেন সোভিয়েট সরকারের সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিকল্পনায় যা সোভিয়েটবাসীর আবাসিক সমস্যা সমাধানে জরুরী ভূমিকা রেখেছে। সেদেশে কোন গৃহহীন মানুষ লেখিকার চোখে পড়েনি।

 

লেনিনের দেশে লালনের মেয়ে । রোকাইয়া জাফরী

 

শহর ছাড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এসে তিনি দেখেছিলেন বত্রিশ তলা বিশিষ্ট বিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ভবন। এখানে পৃথিবীর সমস্ত দেশের ছেলেমেয়েরা পড়তে আসে। প্রায় ২০ হাজার ছেলেমেয়ে এখানে পড়াশুনা করবার সুযোগ পায়। বিরাট এলাকা জুড়ে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয় ভবনটিতে সমস্ত কিছুর সুব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে তিনি আসেন মস্কো নদীর কাছে। নদীর দুধারে বিরাট বিরাট অট্টালিকার সৌন্দর্য লেখিকাকে মুগ্ধ করেছিল।

মস্কোর একটি স্কুল পরিদর্শনে গিয়েছিলেন তিনি। মাইক্রো রিজিয়ন নামে সেখানে কিছু ছোট ছোট মহল্লা আছে। এবং প্রত্যেকটি রিজিয়নেই একটি করে কিন্ডারগার্টেন স্কুল আছে। এলাকার নামানুসারে স্কুলগুলোর নামকরণ করা হয়। “অক্টোবর রিজিয়ন তীর” নামে এক স্কুল পরিদর্শনে গিয়ে তিনি সেখানকার সমস্ত কিছু ঘুরে দেখেন। স্কুলের ডিরেক্টর তাঁকে সমস্ত তথ্য জানান।

রিজিয়নের স্কুলগুলোতে তিন বছর বয়স থেকে আট বছর বয়স পর্যন্ত বাচ্চাদের শিক্ষা দেয়া হয়। নানারকম বিনোদনের মাধ্যমে শিশুরা সেখানে তাদের প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করে। সেদেশের কর্মব্যস্ত মা-বাবারা শিশুকে নিয়ে কোন সমস্যায় পড়েন না। কাজে যাবার আগে তারা প্রত্যেকেই তাদের বাচ্চাদের কিন্ডারগার্টেনে দিয়ে সম্পূর্ণ নিশ্চিত থাকেন।

মস্কোর এক অপেরায় গিয়েছিলেন তিনি। অপেরা ঘরের সৌন্দর্য তাঁর কল্পনাকেও হার মানিয়েছিল। সেক্সপীয়রের নাটক অবলম্বনে রচিত নাটকটিতে রুশ শিল্পীদের প্রত্যেকেই নিখুঁত অভিনয় করেছিলেন।

১৭ই নভেম্বর ইনষ্টিটিউট অব এ্যাডভান্সড এডুকেশন ফর ডক্টরস এর ডিরেক্টর “কভেরী গীনার’ সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তিনি। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ভদ্রমহিলা জানিয়েছিলেন সেদেশের শতকরা পঁচাত্তর জন ডাক্তারই মহিলা। গীনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তিনি মস্কোর একটি শিশু হাসপাতাল দেখতে যান। হাসপাতালটির পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা এবং শিশুদের আনন্দ দেবার মতো উপকরণ তাঁর ভালো লেগেছিল।

হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে “লাল অক্টোবর” নামে এক মিষ্টি তৈরীর কারখানায় গিয়েছিলেন তিনি। মস্কো শহরের খুব পরিচিত এই ফ্যাক্টরীতে বিভিন্ন ধরনের টফি, লজেন্স, চকলেট আরও নানা প্রকারের মিষ্টি তৈরী করা হয়। খাদ্যদ্রব্যে যাতে দূষিত জীবাণু প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য কারখানার ভেতরে প্রবেশ করতে হলে তাদের দেয়া এ্যাপ্রণ পরে প্রবেশ করতে হয়। পরিচালিকার ঘরে চা-চক্রের আয়োজনে যোগ দিয়ে বিভিন্ন ডিজাইনের মিষ্টিদ্রব্য দেখতে পেয়ে তিনি আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন।

দোত কিমিওর নামে এক শিশুদের দোকানে গিয়ে দেখেছিলেন সত্যিই সেখানে একটি শিশুদের পৃথিবী বানিয়ে রাখা হয়েছে। বাচ্চাদের যাবতীয় জিনিস পাওয়া যায় এ দোকানে। সর্বত্রই খুদে খদ্দেরদের ভীড় তাঁর চোখে পড়েছিল।

রুশ দেশে শিশুরা হচ্ছে সবচেয়ে আদরণীয়। সব কিছুর ঊর্ধ্বে এরা জাতির ভবিষ্যৎ নাগরিকদের স্থান দিয়ে রাখে। শিশুদের দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবার সকল দায়িত্ব সরকারের। রুশ দেশের প্রায় প্রত্যেক শহরেই প্যালেস অফ পাইওনিয়ার্স খুলে রাখা হয়েছে। মস্কোর একটি পাইওনিয়ার সেন্টারে গিয়ে লেখিকা সেখানকার শিক্ষাব্যবস্থার পদ্ধতিগুলো দেখে এসেছিলেন। তিনতলা বিশিষ্ট ভবনটিতে একশ’-এর ওপর কামরা রয়েছে এবং প্রত্যেক কামরাতেই রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা।

পরদিন তিনি সোভিয়েটের ইতিহাস বিখ্যাত ক্রেমলিন দেখতে যান। ক্রেমলিন যাবার পথে মস্কোর বিখ্যাত রেডস্কোয়ার, লেনিনের স্মৃতিভবন, গোর্কীরোড, রাশিয়ার সবচেয়ে বড় দালান “গুম”, গোর্কী পার্ক ইত্যাদি পরিদর্শন করে ক্রেমলিন পৌঁছেন।

১৯৪৭ সালে ইউরীদ আল গোর্কী প্রথম ক্রেমলিনের ভিত্তি প্রস্তুর স্থাপন করেন। কিংবদন্তী আছে মস্কো শহর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৭টি পাহাড়ের উপর আর ক্রেমলিন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৭টি পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ে। ক্রেমলিনের অদূরেই মস্কোর ঐতিহাসিক ঘন্টা দেখতে পেয়েছিলেন তিনি। পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের এক আশ্চর্য এই ঘন্টা। বিশাল ঘন্টাটি দেখে লেখিকা বিস্মিত হয়েছিলেন। ঘন্টাটির ওজন ২০০ টন। এটি নির্মিত হয় ১৭৩৫ সালে।

ঘন্টার পেছনে আইভান ভেলকীর গির্জা। জার বোরিস গুত্তোনোভ এর সময় ১৬০০ সালে এটি নির্মিত হয়। গীর্জা থেকে দশ পা এগিয়ে তিনি পুরোনো আমলের এক বিশাল কামান দেখতে পান। এছাড়াও ক্রেমলীনে বহু ক্যাথিড্রাল তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। সুপ্রীম গোডিয়েটের অফিস, হাউজ অফ কংগ্রেস এবং আরও বহু প্রাচীন ইমারত দেখে তিনি ক্রেমলিন যাদুঘরে গিয়েছিলেন। বিগত দিন থেকে শুরু করে আধুনিক কাল পর্যন্ত দেশের যাবতীয় শিল্প এবং তার ক্রমবিকাশের ইতিহাস ও বহু দুষ্প্রাপ্য ঐতিহাসিক বস্তু রাখা হয়েছে এ যাদুঘরে।

সন্ধায় লেখিকা ক্রেমলিনের এক বিচিত্রানুষ্ঠান দেখতে যান। পুরো সোভিয়েট ইউনিয়নের সেরা শিল্পীদের নিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। অনুষ্ঠান শেষে ঐ রাতেই তিনি লেনিনগ্রাডের উদ্দেশে রওনা হয়ে যান। সোভিয়েট ওম্যান পত্রিকার ইংরেজী বিভাগের সহকারী সম্পাদিকা “রোজাবাই মুরাত ওরা” তার সফরসঙ্গী ছিলেন। সোভিয়েটের ট্রেনগুলোতে কোন শ্রেণীবিন্যাস নেই। সেদেশের ট্রেনগুলো সব ধরণের সুব্যবস্থায় সুন্দর এবং আরামপ্রদ।

লেনিনগ্রাড় পৌঁছলে সেখানকার ডিরেক্টর অফ স্কুলস লেখিকাকে অভ্যর্থনা জানান। হোটেল আস্তরিয়াতে তাঁর থাকবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। পিটারের নাম অনুসারে লেলিনগ্রাডের পূর্ব নাম ছিল পিটার্সবাগ।

লেনিনগ্রাডের শহর ঘুরতে গিয়ে প্রথমেই তিনি যান অরোরা ক্রুজার দেখতে। ১৯০৩ সালে এই জাহাজটি তৈরী হয়। ১৯০৪ সালে রুশ-জাপান যুদ্ধের সময় এটিকে কাজে লাগানো হয়েছিল। ১৯১৭ সালে বিদ্রোহের সময় এ জাহাজের গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। এরপর তিনি নিকোলাসের হত্যার স্থান, টেম্পল অফ্ ব্লাড’, পিটার-দা গ্রেটের গ্রীস্ম প্রাসাদ, নেভেস্কী স্কোয়ার, মস্কো এ্যাভেন, লেনিন স্কোরার, ফিনল্যান্ড টারমিনাস প্রভৃতি দেখে সেন্ট আইজ্যাক স্ট্রীট ও প্যালেস স্কোয়ার হয়ে এসেছিলেন বিপ্লবের প্রধান কেন্দ্র বিখ্যাত স্মলনীতে। স্থলনীর প্রধান আকর্ষণ এখানকার একটি ছোট্ট ঘরে লেনিন বাস করতেন।

ম্মলনী থেকে তিনি যান ম্যাটারনিটী হাসপাতালে। বিরাট হাসপাতাল পরিদর্শন শেষে লেখিকা লেনিনগ্রাডের একটি বিখ্যাত ব্যালে নাচ দেখতে গিয়েছিলেন। রুশ নৃত্য-কৌশল তাঁকে মুগ্ধ করেছিল।

পরদিন মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত একটি টুপি কারখানা দেখে তিনি নেভার তীরে অবস্থিত হারমিটেজ প্রাসাদ দেখতে যান। হারমিটেজ পাঁচটি বড় বড় অট্টালিকা নিয়ে গড়া রাশিয়ার প্রাচীন জার রসোনভের শীতকালীন প্রসাদ।

১৭৫৫-১৭৬২ সালে এই প্রাসাদ নির্মিত হয়। রুশ দেশের সবচেয়ে বড় যাদুঘর এই হারমিটেজ প্রাসাদ। গাইড লেখিকাকে জানিয়েছিল গোটা হারমিটেজ দেখতে পুরো একমাস সময় লেগে যায়, চিত্রকলা বিভাগটিতে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি, রাফায়েল, মাইকেল এঞ্জেলো এবং রামব্রান্ড এর মূল ছবি রাখা হয়েছে। এছাড়াও পৃথিবীর বিখ্যাত চিত্রকলার সৌন্দর্য তাঁকে মুগ্ধ করেছিল।

সন্ধ্যায় “হোম ফর ওল্ড আর্টিষ্ট”-এ গিয়ে তিনি বিখ্যাত বৃদ্ধ শিল্পীদের সংগে কথা বলেন। বিখ্যাত শিল্পী যারা বার্ধক্যে এসে পৌঁছেছেন তাদের নিয়ে গঠিত হয়েছে এই হোম। এদের সমস্ত খরচ সরকার বহন করেন। সোভিয়েট গভর্নমেন্ট শিল্পীদের অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখেন।

 

লেনিনের দেশে লালনের মেয়ে । রোকাইয়া জাফরী

 

দু’দিন লেনিনগ্রাড ভ্রমণ শেষে তিনি আবারও মস্কো ফিরে আসেন। মস্কো এসেই রওনা হয়ে যান তিবলিসীর উদ্দেশ্যে। তিবলিসী প্রাচীন জর্জিয়া প্রদেশের রাজধানী। সোভিয়েট ইউনিয়নের অপেক্ষাকৃত গরম প্রদেশ এটি। জর্জিয়া ধাতু ও খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ। রাজধানী তিবলিসীকে রুশরা সংক্ষেপে বলে বিলিসী’। যার অর্থ গরম।

বিলিসী পৌঁছলে তাঁকে ভোরডিয়াসভ্যালী রোডের শ্রেষ্ঠ হোটেল ‘বিলিসীতে’ নিয়ে যাওয়া হয়। জর্জিয়ার মহিলা সংস্থার বিশিষ্ট সদস্যা নীনা পরদিন লেখিকাকে শহর প্রদক্ষিণে নিয়ে যান। পাহাড়ের ওপর অবস্থিত বিলিসী শহর প্রাকৃতিক সোন্দর্যে অপরূপ। দশম শতাব্দীর একটি গীজা চোখে পড়েছিল তার। নানা জানিয়েছিল ঐ গীর্জায় যীশুখৃষ্টের ব্যবহৃত কিছু কাপড়-জামা সংরক্ষিত আছে।

বিলিসীর যাদুঘরে গিয়ে তিনি অনেক দর্শনীয় বস্তুর ভেতর যীশুখ্রীষ্টের একটি বিশাল ছবি দেখেছিলেন, যেটি সোনার ফ্রেমে আঁটা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় চিত্র। যাদুঘর দেখে মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত একটি কোর্ট তৈরীর ফ্যাক্টরী দেখেন তিনি। সাধারণ থেকে শুরু করে খুব দামী কোটও এ ফ্যাক্টরীতে তৈরী করছে কর্মীরা।

বিকেল পাঁচটায় লেখিকা হোটেলের খুব কাছাকাছি প্যালেস অফ পাইওনিয়ার্স দেখতে যান। প্যালেস অফ পাইওনিয়ার্সে যাবার পথে তাঁর শাড়ীর প্রতি পথচারীদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছিল। পাইওনিয়ার্সে পৌঁছলে ডিরেক্টর তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়ে পুরো কেন্দ্রটি ঘুরে দেখান। বিভিন্ন গ্রুপে নানা বয়সের ছেলেমেয়েরা সেখানে আছে। জাতির ভবিষ্যৎ নাগরিক এই শিশুরা এ ধরণের শিশুরাজ্য থেকেই বিকশিত হয়। বাচ্চাদের পরিবেশিত জর্জিয়ার জাতীয় নৃত্যের সাথে তিনি স্বদেশের নৃত্যকলার অনেক মিল দেখতে পান।

বিলিসী সরকারের প্রধান অফিসে তিনি গিয়েছিলেন একটি ডকুমেন্টারী ছবি দেখতে। প্রথম একটি শিশুদের ছবি দেখিয়ে পরে সেক্সপীয়রের ওথেলো নাটকের ব্যালে ড্যান্স দেখানো হয়েছিল।

২২শে নভেম্বর তিনি যান রেশম কারখানায়। সেখানকার মহিলা ডিরেক্টর তাঁকে সমস্ত কারখানাটি ঘুরিয়ে দেখান। চা-চক্রে লেখিকা কারখানা শ্রমিকদের বাসগৃহ দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করলে ডিরেক্টর তাঁকে শ্রমিকদের ফ্লাটে নিয়ে যায়। শ্রমিক গৃহগুলোর সুরুচির পারিপাট্যে তিনি অভিভূত হয়েছিলেন। সেখান থেকে বেরিয়ে তিনি যান জর্জিয়ার একটি কনসার্ট হলে। কনসার্টে জর্জিয়ার বিভিন্ন প্রদেশের গান বাজনার আয়োজন করা হয়েছিল। মধ্যবয়স্ক এক ভদ্রলোকের হাস্যরস পরিবেশনাটি লেখিকার ভালো লেগেছিল।

সেই রাতেই তিনি যান বিখ্যাত “ফুনিফ্লোর” দেখতে। ফুনিক্লোর পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত আধুনিক হোটেল, যেখানে ভ্রমণ করবার জন্য সুড়ঙ্গ পথে বৈদ্যুতিক ট্রাম চলাচলের ব্যবস্থা আছে।

পরদিন বিলিসীর একটি গ্রাম দেখতে বেরিয়েছিলেন তিনি। ‘তেলাভী গ্রামে পৌঁছলে সেখানকার কোর্ট ও যাদুঘর তার দৃষ্টি কেড়েছিল। সামান্য একটি গ্রামেও এরা যাদুঘর রাখে, যে ব্যাপারটিতে লেখিকা অবাক হয়েছিলেন। সন্ধায় সেখানকার টাউনহলে এক ডিনার পার্টির আয়োজন করা হয়। ভোজ পর্বের মাঝখানে কয়েকজন উঠে নাচতে শুরু করেন এবং এক পর্যায়ে তারা লেখিকাকেও নাচতে বাধ্য করেন।

২৫শে নভেম্বর তিনি তাসখন্দ যান। তাসখন্দ যাবার আগে বিলিসীর একটি বাগান দেখতে গিয়েছিলেন। তিনি। বৃদ্ধ কবি “মিখাইল মুলা রোমভিলার নিজহাতে নির্মিত বাগানটিতে যাবতীয় সংগ্রহ বৃদ্ধের নিজের চেষ্টায় সম্ভব হয়েছে। কবির প্রোগাম অনুযায়ী তাঁরা প্রথম যান নৃত্য ও গীত শিক্ষা বিদ্যালয় পরিদর্শনে। সেখান থেকে সারা উজবেকিস্তানের বহু প্রাচীন মসজিদ দেখে তাঁরা এসে পৌঁছান পার্লামেন্ট ভবন ও তাসখন্দ যাদুঘরে। এ যাদুঘরে হযরত ওসমান (রাঃ) এর রক্তমাখা কোরান শরীফ এবং সিন্দাবাদ গল্প গ্রন্থের প্রথম সংস্করণ সংরক্ষণ করা হয়েছে। এছাড়াও সেখানে রয়েছে বহু অমূল্য, দুষ্পাপ্য সব সংগ্রহ। সময়ের স্বল্পতায় তিনি যাদুঘরটির ভেতর ঘুরে দেখতে পারেননি বলে দুঃখ পেয়েছিলেন।

পরদিন সেখানকার একটি নার্সারী দেখতে যান তিনি। সোভিয়েট দেশের নার্সারীগুলোতে শিশুরা পরম যত্নে ও আনন্দে বেড়ে ওঠে। কিন্ডারগার্টেনেও শিশুদের বই পুস্তকের পড়া মুখস্থ করতে হয় না। নানারকম ছবির মাধ্যমে তারা তাদের প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করে।

শিশুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তিনি গিয়েছিলেন সোভিয়েট সোসালিস্ট রিপাবলিক অফিসে। উজবেকিস্তানের মহিলা কবি এবং পার্লামেন্ট সদস্য মিসেস জুলফিয়াসহ বহু গণ্যমান্য মহিলা তাঁকে স্বাগত জানান। পাকিস্তান সংক্রান্ত নানা আলোচনায় মহিলাদের সুযোগ-সুবিধার ব্যাপারটি তারা জানতে চেয়েছিলেন। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষিত আছে জেনে তারা অবাক হয়েছিলেন।

আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তিনি জেনেছিলেন উজবেকিস্তানে মুসলমানের সংখ্যা বেশী হলেও সেখানে একাধিক বিয়ে কিংবা তালাকের প্রচলন নেই। বিদায় নেবার সময় মিসেস জুলফিয়া তাঁকে তাসখন্দের জাতীয় নিদর্শন সিল্কের কাপড় ও টুপি উপহার দিয়েছিলেন। বিকেলে তাসখন্দের বিখ্যাত সিরামিক কারখানা, উজবেকিস্তানের পার্লামেন্ট ভবন, উজবেক সরকারের ভবন, তাসখন্দের বিখ্যাত কম মোল স্কোয়ার দেখে হোটেলে ফিরে আসেন।

আটাশে নভেম্বর মস্কোতে এসে টিউব ট্রেন দেখবার ইচ্ছে প্রকাশ করলে মারিয়া ও মার্ক যারা তাঁর প্রায় সার্বক্ষণিক ভ্রমণ সঙ্গী ছিলেন তারা তাঁকে টিউব ট্রেন দেখাতে নিয়ে যান। এ ট্রেনে চেপে যে যেখানেই যাকনা কেন ভাড়া লাগবে মাত্র পাঁচ কোপেক যা পাকিস্তানের পাঁচ পয়সার সমান।

সন্ধ্যায় পাকিস্তান দূতাবাসের জিয়াউদ্দীন সাহেবের বাসায় লেখিকার সম্মানে এক ডিনার পার্টির আয়োজন করা হয়েছিল। ২৯শে নভেম্বর তিনি সোভিয়েট ইউনিয়ন থেকে বিদায় নিয়ে লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান।

তিন

সোভিয়েট দেশ ভ্রমণে গিয়ে লেখিকা সেদেশের নানা বৈশিষ্ট্যের সংগে পরিচিত হন। গণতান্ত্রিক দেশ পাকিস্তান এবং সোসালিষ্ট কান্ট্রি সোভিয়েট ইউনিয়নের মধ্যে তিনি কিছু সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যের বিষয় লক্ষ্য করেছিলেন। সোভিয়েট দেশের নানা বৈশিষ্ট্য এবং দুটি দেশের তুলনামূলক আলোচনায় তিনি বিষয়গুলোকে একটি সুনির্দিষ্ট ধারণায় এনে দাঁড় করিয়েছেন।

মস্কোর শ্রীমিতিভো বিমান বন্দরে যে বৈশিষ্ট্যটি লেখিকার নজরে পড়েছিল সেটি অন্যান্য দেশ থেকে ছিল আলাদা ধরনের। এ সম্পর্কে তিনি বলেছেন-

বিমানের পরিচারিকা সকলের পাসপোর্ট নিয়ে তৈরী থাকতে বললেন। একটু পরেই রুশ দেশের পুলিশ বিমানে প্রবেশ করে সকল যাত্রীর কাছ থেকে তাদের পাসপোর্ট নিয়ে চলে গেলো। এ অভিজ্ঞতা নুতন। ইতিপূর্বে যত দেশ ভ্রমণ করেছি বিমান বন্দরে নেমে গিয়ে পাসপোর্ট জমা দিতে হয়েছে। কাজেই এদের ভিন্ন রীতিতে একটু আশ্চর্য হলাম। এইবার নামবার অনুমতি পাওয়া গেলো। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়েই থমকে দাঁড়াতে হোল এ আবার কি কান্ড! একজন লোক ক্যামেরা ধরে পটপট করে সব যাত্রীদের ছবি তুলে নিচ্ছে। পরে বুঝেছিলাম, এ লোক মস্কো পুলিশের লোক তাদের নিয়ম। ২

হোটেল কক্ষের চাবি পেতেও তিনি সেদেশে নতুন নিয়মের মুখোমুখি হয়েছিলেন। হোটেলে অবস্থিত সোভিয়েট বুরোর অফিসে পাসপোর্ট জমা রেখে তাঁকে রুমের চাবি সংগ্রহ করতে হয়। রুমে ঢুকে চারিপাশে তাকিয়ে তিনি স্বদেশের সাথে সোভিয়েট রুচির অনেক মিল খুঁজে পেয়েছিলেন।

খাবার টেবিলে লক্ষ্য করেছিলেন রুশরা সাদা পানি খায় না। এরা সবাই হাল্কা ধরনের মদ বা মিনারেল ওয়াটার পান করে।
শুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি এবং প্রচন্ড শীত উপেক্ষা করে রুশ জনগণ যে যার মত কাজে যায়। পথে কোথাও কোন হৈ চৈ নেই। কোন বিশৃঙ্খলা নেই। কর্মপাগল জনতা নিঃশব্দে এগিয়ে যাচ্ছে তাদের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে।

সোভিয়েট দেশে নারী-পুরুষের ভেদাভেদ তাঁর চোখে পড়েনি। সামাজিক সুব্যবস্থার ফলে সেদেশের সর্বত্রই
তিনি লক্ষ্য করেছেন পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সমান কিংবা কখনও কোথাও বেশী ভূমিকা রাখছে। স্বদেশের
নারী চিত্রের রূপটি তিনি সোভিয়েট দেশের কোথাও দেখতে পাননি ।

এদেশের মহিলারা অত্যন্ত কর্মঠ এবং কর্তব্য পরায়ণ। আমাদের দেশের কাব্যে বর্ণিত “ললিত লবঙ্গ লতার” মত এরা নয় মোটেই। এরা পুরুষের পাশাপাশি সব রকমের কার্যভার আপন স্কন্ধে তুলে নিচ্ছে। কোন অসুবিধা বা কোন রকমের বাধা সৃষ্টি হয়নি তাদের কাজের পথে। মেয়েদেরকে এরা সহজভাবেই গ্রহণ করেছে, কাজেই মেয়েরা মানুষের মর্যাদা পেয়েছে। তাই পথে ঘাটে সর্বত্রই পুরুষের সঙ্গে পাশাপাশি মহিলাকর্মীও নজরে পড়ছে। ৩

 

লেনিনের দেশে লালনের মেয়ে । রোকাইয়া জাফরী

 

সোভিয়েট ইউনিয়নের আর একটি বৈশিষ্ট্য যা লেখিকাকে চমৎকৃত করেছিল সেটি সে দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়া। খুব কম সময়ে তারা সমগ্র দেশ ও জাতিকে উন্নতি ও অগ্রগতির শীর্ষে নিয়ে গেছে। স্বদেশের সাথে তুলনায় তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন-

আমি যা দেখি তাতেই আশ্চর্য হই। মাত্র কয়েক বছরে এরা কত উন্নতি লাভ করেছে। নূতন এলাকায় যেখানে বাড়ীর পর বাড়ী তৈরী হচ্ছে নীনা দেখালো, সেখানকার ফ্ল্যাটগুলো সব ফ্যাক্টরী থেকে তৈরী হয়ে আসে। আস্ত ফ্ল্যাট সেখান থেকে তুলে এনে এখানে একটার পর একটা বসিয়ে শুধু জোড়া লাগানো হয়। ফলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে হাজার হাজার ফ্ল্যাট বাড়ী তৈরী হয়ে যাচ্ছে।

অবশ্য এইসব বাড়ী দেখতে একই রকম। আমি চমৎকৃত হলাম তাদের বুদ্ধির পরিচয় পেয়ে। আমাদের দেশে একটি বাড়ী তৈরী করতে হলে কত উদ্যোগ আয়োজন করতে হয় আর কত পরিশ্রম করতে হয় তার পিছনে। ঝড়, বৃষ্টি আর রোদ মাথায় করে বেচারা রাজমিস্ত্রীরা একটার পর একটা ইট সাজিয়ে তৈরী করে ইমারৎ। আর এখানে কোন চিন্তা নেই, পরিশ্রম সবই হচ্ছে যন্ত্রের সাহায্যে, সদ্য তৈরী ফ্ল্যাট বেরিয়ে আসছে যন্ত্রের ভিতর থেকে। মিস্ত্রীদের একমাত্র কাজ হচ্ছে একটার সংগে আর একটা জুড়ে দেওয়া। 8

সেদেশের মানুষকে তিনি ফুটপাতে বা গাছের তলায় শুয়ে থাকতে দেখেননি কোথাও। আরও একটি বিষয় তিনি লক্ষ্য করেছিলেন সোভিয়েটের সব রাস্তাগুলো তারা প্রশস্ত করেছে খুব কম সময়ে কোন বাড়ী ঘর বা কোন ঐতিহাসিক প্রাসাদ না ভেঙ্গেই। যান্ত্রিক উপায়ে তারা এগুলো সম্ভব করেছে।

সোভিয়েট দেশের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সেদেশের সরকার শিশুদের ভবিষ্যৎ নাগরিক হিসেবে সম্পূর্ণরূপে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বদ্ধপরিকর। সেখানকার শিশু শিক্ষাদানের পদ্ধতিটি লেখিকার ভালো লেগেছিল। সেদেশের সর্বত্রই রয়েছে নার্সারী।

নার্সারীগুলোতে কর্মব্যস্ত বাবা-মা তাদের ছেলেমেয়েদের রেখে যান। মায়ের ভূমিকা দানকারী শিক্ষয়িত্রীরা সেই অবুঝ শিশুদের সারাদিন নানাভাবে বিনোদনের মাধ্যমে বড় করে তোলেন। শিশুর পরিপূর্ণ বিকাশের সবরকম সুযোগ সুবিধা দিয়ে তারা শিশুদের বেড়ে উঠতে সাহায্য করেন। তিন বছর বয়স পর্যন্ত শিশুরা নার্সারীতে অবস্থান করে এরপর তারা যায় কিন্ডারগার্টেনে। সেখানেও তারা নানারকম বিনোদনের ভেতর দিয়ে ব্যবহারিক শিক্ষা লাভ করে।

প্রত্যক্ষভাবে জ্ঞানলাভের ফলে তারা একবার যা শিখছে তা আর ভুলে যাচ্ছেনা। সোভিয়েটের সর্বত্রই রয়েছে শিশুদের অবাধ স্বাধীনতা। খেলাধূলা ও ছবি দেখার ভেতর দিয়ে নিজের অজান্তেই তারা প্রয়োজনীয় শিক্ষা লাভ করছে বলে কোথাও কোন বাধ্যবাধকতা নেই। সেখানকার সকল ছাত্রছাত্রীর লেখাপড়ার যাবতীয় খরচ সরকার বহন করে। এ প্রসঙ্গে স্বভাবতই তাঁর নিজের দেশের কথা মনে পড়েছে তিনি আহত কণ্ঠে বলেছেন-

কত দরিদ্র পিতামাতার মেধাবী সন্তান শুধুমাত্র সুযোগ ও সুবিধার অভাবে উপযুক্ত শিক্ষালাভ করতে পারলো না- অকালে ঝরে গেল। অথচ হলফ করে কে বলতে পারে যে যারা ঐ অবহেলিত ও অনাদরে পড়ে রইলো তাদের ভেতর নজরুল, ইকবাল, জয়নুল আবেদীন বা কায়েদে আজম জন্মলাভ করতেন না। শুধুমাত্র সুযোগের অভাবে উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে কত মুকুল ঝরে গেল, কত পুষ্প প্রস্ফুটিত হোল না, ভেবে মনটা বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন হয় বই কি। ৫

সোভিয়েট রাশিয়ার একটি বিষয় লেখিকার কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। সেখানে কিছু শিশু সারা সপ্তাহ বোর্ডিং এ থেকে ছুটির দিনটি শুধু বাবা মায়ের সংগে কাটায়। এতে করে শিশুর মনোবিকাশের ক্ষেত্রে কিছুটা বাধার সৃষ্টি হয় এবং মাতা-পিতারও সন্তানের প্রতি কর্তব্যে কিছুটা অবহেলা করা হয় বলে তিনি মনে করেন।

সোভিয়েট ইউনিয়নের খাদ্য কারখানার দুটি বিশেষত্ব তাঁর চোখে পড়েছিল। একটি সেখানে যারা কাজ করছিল তারা প্রায় সবাই মহিলা। অপরটি তৈরী জিনিসগুলোতে কোথাও কোন হাতের স্পর্শ লাগানো হচ্ছিল না। সমস্ত কাজই তারা মেশিনের সাহায্যে করে থাকে। খাদ্যবস্তুতে যাতে কোন প্রকার দূষিত জীবাণু প্রবেশ করতে না পারে সে ব্যাপারে তারা সবাই সজাগ। কারখানাগুলো পরিচ্ছন্নতায় ঝকঝক্ করে সর্বত্র।

অতীতকে আঁকড়ে ধরার প্রবণতা রুশদের প্রবল। অতীতের গৌরবময় ঐতিহ্যগুলোকে তারা গর্বের সাথে সংরক্ষণ করে। কোথাও কিছুটা বিকৃত হলে গবেষণার মাধ্যমে তারা সে জিনিসের আসল রূপ ফিরিয়ে আনে। বর্তমানের মাঝে অতীতকে ধরে রাখা সোভিয়েট দেশের একটি বৈশিষ্ট্য। সোভিয়েটের যেখানেই তিনি। গিয়েছেন লক্ষ্য করেছেন গীর্জার ছড়াছড়ি। অতীতের গৌরব ও ঐতিহ্যকে বহন করে চলেছে ঐ গীর্জাগুলো।

সোভিয়েট ইউনিয়নের সর্বত্রই লালের ছড়াছড়ি। পাকিস্তানে যেমন সবুজের ভাগটাই বেশী চোখে পড়ে তেমনি সোভিয়েট দেশে লাল রংটাকেই তারা বেছে নিয়েছে বিশেষভাবে। সবুজ রং সতেজ জীবনের প্রতীক আর লাল উগ্র একটা বিদ্রোহী ভাবের প্রতীক। তবে তারকা ব্যবহারের দিক থেকে মিল দেখতে পান দু দেশেরই। পাকিস্তানের জাতীয় পতাকায় তারকার স্থান রয়েছে। আর রুশ দেশে লাল তারকা স্থান পেয়েছে বড় বড় অট্টালিকার মাথায়, দোকানের ছাদে।

 

লেনিনের দেশে লালনের মেয়ে । রোকাইয়া জাফরী

 

তিনি দেখেছিলেন রুশ দেশে বৃদ্ধদের জন্য হোম এর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা সেখানে সরকারী খরচে তাদের বাকী জীবনটা আনন্দে কাটিয়ে দেন। শিল্পীকে সোভিয়েট দেশে সর্বোচ্চ সম্মান দেয়া হয়। বৃদ্ধ শিল্পী, ৫০ এর উর্ধ্বে যাদের বয়স তারা সবাই এ ধরনের হোম এ এসে নিশ্চিন্তে তাদের বাকী জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারেন।

সোভিয়েট দেশের লোকজন প্রত্যেকেই বই পাগল। কর্মব্যস্ততার ভেতর তারা যেটুকু সময় পান বই নিয়ে বসে যান। তিনি আরও লক্ষ্য করেছিলেন সোভিয়েট দেশের লেখকরা সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি। লেখিকা “সোভিয়েট ওম্যান” পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখে তার প্রমাণ পেয়েছিলেন। একটি ছোট লেখার জন্য তাঁকে অনেক রুবল সম্মানী দেয়া হয়। এ প্রসঙ্গে তিনি স্বদেশের লেখককূলের শোচনীয় অবস্থার কথা ভেবে মর্মাহত হয়েছিলেন।

আধ ঘন্টার মধ্যেই নীনা উপস্থিত হোল। লেখাটা নিয়ে আমাকে তৈরী হতে বলে সে চলে গেলো পত্রিকার অফিসে। আরও আধঘন্টা পরে ফিরে এসে আমার হাতে তুলে দিলো অনেকগুলো রুবল। আবার আশ্চর্য হবার পালা। ঐটুকু লেখার জন্য এত রুবল। আমাদের দেশের লেখকগোষ্ঠীর অবস্থা সবচেয়ে শোচনীয়। লেখা বিক্রি করে কালেভদ্রে যে পয়সা পাওয়া যায় সেটা মোটেই সম্মানজনক নয়। অথচ এদেশে এক এক জন লেখক অত্যন্ত সম্মানীয় ব্যক্তি, তাঁর স্থান সবার উপরে।

সোভিয়েট ইউনিয়ন ভ্রমণে গিয়ে লেখিকাকে কখনও কখনও বিমান ব্যবহার করতে হয়েছে। পি.আই.এ.-র তুলনায় রুশদেশের বিমানগুলো তাঁর একেবারেই পছন্দ হয়নি।

সোভিয়েট নৃত্যকলার সাথে তিনি স্বদেশের নৃত্যশিল্পের অনেক মিল খুঁজে পান। জর্জিয়ার জাতীয় নৃত্য দেখে তিনি পাকিস্তানের নৃত্যের সাথে এর খুব বেশী সাদৃশ্য লক্ষ্য করেন।

রুশদেশে মানুষে মানুষে পার্থক্য লেখিকার নজরে পড়েনি। সেদেশে সব মানুষ সমান মর্যাদাসম্পন্ন। অভাবনীয় অর্থনৈতিক সাফল্যের পাশাপাশি মানুষের অন্তরও হয়েছে সেখানে বিপুল ঐশ্বর্যময়। শ্রমিকদের ফ্লাটগুলো ঘুরে দেখেছিলেন তিনি। বাড়ীগুলো দেখতে গিয়ে স্বদেশের কথা তাঁর খুব বেশী মনে পড়েছিল। তিনি আহত হয়েছিলেন দেশীয় দৈন্য, বৈষম্য, অসাম্য প্রভৃতির কথা ভেবে।

দেখছি আর অবাক হচ্ছি, এই নাকি আমি একজন সাধারণ শ্রমিকের বাড়ী দেখছি। আমাদের দেশের যে কোন উঁচু স্তরের বড় লোকের বাড়ীর সঙ্গে এ বাড়ীর তুলনা করা চলে। উপযুক্ত আসবাব পত্রের সাহায্যে এমন সুন্দর করে, পরিপাটি করে সাজানো গোছানো বাড়ী দেখে আমি সত্যিই হতভম্ভ হয়ে গেলাম। মনে পড়ে গেল আমাদের দেশের শ্রমিকদের কথা।

অধিকাংশ শ্রমিকেরই মাথা গোঁজবার ঠাঁই নেই। ভাঙ্গাগড়ার পর্ব এখন চলছে সেখানে। আমাদের দেশে তাই আজও তার সন্তানদের বাসস্থান সম্পর্কে সুনিশ্চিত আশা দিতে পারছেনা। এদের বাসস্থান দেখে সত্যিই গায়ে জ্বালা ধরে যায়। কত ঐশ্বর্যের অধিকারী হলে আর কত সম্পদশালী হলে একটি দেশ তার সাধারণ শ্রমিকদের বাসের জন্য এমন সুন্দর ব্যবস্থা করতে পারে। ৭

রুশ দেশের সর্বত্রই লেখিকা লক্ষ্য করেছেন যে, সেখানকার লোকেরা দুধ ছাড়া চা এবং তার সংগে লজেন্স জাতীয় মিষ্টি ও ফলমূল অতিথিদের পরিবেশন করে। চকলেট রুশদের খুব প্রিয় খাদ্য। সে দেশের মানুষ ব্রেকফাস্টে মাসোনী বলে দই জাতীয় একপ্রকার খাবার খায়। এছাড়া কাঁচা মূলোর পাতা রুশদের একটি উপাদেয় খাবার। পাকিস্তানের সাথে এর একেবারেই মিল নেই।

সোভিয়েট ইউনিয়নে ধর্ম সম্পর্কে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা কোথাও তাঁর চোখে পড়েনি। তাদের নীতি হচ্ছে নাস্তিকতাবাদ। ধর্মের ব্যাপারে তাদের কোন বাধ্যবাধকতা নেই। ধর্মটা নিতান্তই এদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। মূলত সেদেশের সব শিক্ষাই মার্কসবাদের মূল আদর্শের ওপর ভিত্তি করে।

রুশ রাষ্ট্রব্যবস্থায় জাতীয় পরিষদে মহিলাদের জন্য কোন আসন সংরক্ষিত নেই। তারা সাধারণ নির্বাচনে সকলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে নির্বাচিতা হয়ে পরিষদে আসেন।

বাঁধা সময়ের নির্দিষ্টতা, সরকারী নিয়ন্ত্রণ ও প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়েও লেখিকা যতটুকু পেরেছেন সাধ্যমত বিশ্রামহীনভাবে সোভিয়েট দেশকে দেখতে আগ্রহী হয়েছেন। কিন্তু যতই দেখেছেন ততই তিনি মুগ্ধ ও বিস্মিত হয়েছেন এবং আরও গভীরে যাবার স্পৃহা তাঁর প্রবল হয়েছে। সোভিয়েটের বহু জায়গা ঘুরেও বহুকিছু জেনেও সেদেশের প্রতিটিক্ষেত্রের ব্যাপক উন্নতি ও অগ্রগতির রহস্যটি তাঁর কাছে অজানাই থেকে গেছে। বহু চেষ্টা করেও তিনি ঐ ব্যাপক উন্নয়নের পেছনে কোন সুনির্দিষ্ট কারণ দাঁড় করাতে পারেননি।

১. রোজা ভদ্রতা করে জিজ্ঞেস করলো ক্লান্তি লাগছে কিনা। না, মোটেই না। আমি এসেছি নতুন দেশ দেখতে, বিশ্রাম করতে আসিনি। যতটুকু পারা যায় দেখে নিতে চাই। ক্লান্তি আসে বইকি কিন্তু নতুন – দেশকে দেখবার ও জানবার এই সুযোগ তো সহজে পাওয়া যাবেনা, সুতরাং ক্লান্তিকে তো এখন প্রশ্রয় দেওয়া চলে না। আমি দেখতে চাই আরও, জানতে চাই আরও বেশী করে কিসের জোরে তোমরা এত উন্নতি লাভ করলে।

কোন যাদুমন্ত্রে তোমাদের দেশের চেহারা পাল্টে গেল। সেই যাদুমন্ত্রের চাবিটি কোথায় ? কেমন ? জানতে চাই। কিসের জন্য এতকাল পর্যন্ত পৃথিবীর অন্যান্য দেশবাসীর নিকট তোমাদের দেশের দুয়ার রুদ্ধ ছিল। কিসের তোমাদের এত গৌরব, এত গর্ব ? হ্যাঁ গর্ব করবার মত বস্তু আছে, তোমাদের দেশের সর্বত্রই ছড়িয়ে আছে উত্থান-পতনের ইতিহাস। এই উত্থান পতনের ইতিহাস সব দেশ জাতিরই আছে, কিন্তু তাদের সঙ্গে তোমাদের পার্থক্য আছে অনেক। তোমরা গরীবকে দিয়েছো সম্মান, দিয়েছো নিরাপত্তা।

তাই পৃথিবীর নির্যাতিত ও বঞ্চিতদের তীর্থস্থান এই লেনিনগ্রাড। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে নাও লেনিনগ্রাডকে। কিন্তু ভালো করে কি দেখবার উপায় আছে ? বাইরে তো সারাক্ষণই টিপ্‌ টিপ্‌ বৃষ্টি হচ্ছে, আর সেই সঙ্গে প্রচন্ড কনকনে শীত। ঘরের বাইরে পা দেওয়া মাত্রই মনে হয় কনকনে শীতের স্পর্শে হাড় কেটে কেটে বসে যাচ্ছে।

২. বিছানায় আশ্রয় নেবার পরও অনেকক্ষণ নিদ্রাদেবীর আগমন প্রত্যাশায় জেগে থাকতে বাধ্য হলাম। শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম, এত বড় একটা দেশ কোন যাদুমন্ত্রের বলে উন্নতির শিখরে আরোহণ করেছে। ব্যাপক উন্নতির পরিচয় ছড়ানো রয়েছে এদের পথে-ঘাটে, ইমারতের চূড়ায়, লোকজনের পোষাকে ও কথাবার্তায়। এক যুগ আগেও যে দেশে কিছুই ছিল না একমাত্র কতকগুলি প্রাচীন ইমরাত ছাড়া, আজ সেখানে আধুনিক ফ্যাক্টরী, বিদ্যুৎ উৎপাদনের কারখানা, কাচের কারখানা, কৃষি যন্ত্রপাতির কারখানা, লোহার কারখানা। সবই যেন আলাউদ্দীনের আশ্চর্য প্রদীপের মতো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।

চার

‘লেনিনের দেশে লালনের মেয়ে’ একটি সার্থক সাহিত্য সৃষ্টি। রূপ, রস, কল্পনা, বাস্তবতা এবং হৃদয়ের মুগ্ধতা মেশানো রচনাশৈলীর গুনে এটি একটি উন্নত সাহিত্য হয়ে উঠেছে। বইটির নামকরণের মধ্যে দু’দেশের পরিচয় এবং কাহিনীর নাম থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত নারী হৃদয়ই প্রধান হয়ে উঠেছে। বইয়ের ভূমিকায় ডঃ মুহম্মদ এনামুল হক বলেছেন :
বেগম রোকাইয়ার ‘লেনিনের দেশে লালনের মেয়ে’ ভ্রমণ বৃত্তান্ত বা ভ্রাম্যমাণের রোজনামচা নয় ।

এ হচ্ছে একটি ভ্রমণ কাহিনী। বিবৃতি লেখা সহজ, দিনপঞ্জী তৈরীও কঠিন নয়। কিন্তু, কাহিনী বলা যতটা সোজা মনে হয়, ততটা সোজা নয়। এর প্রধান কারণ হ’ল, যিনি বলিয়ে তাঁর বলার ক্ষমতা থাকা চাই, অর্থাৎ কিনা, তাঁকে স্বভাবদত্ত বাচনভঙ্গীর অধিকারী হ’তে হয়। মিষ্টি খাইয়ে মিষ্টিমুখ করা চলে। কিন্তু মিষ্টিক থায় তুষ্ট করতে হলেই বিপৎ। কেননা, তুষ্টির প্রশ্ন ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বলে বাহ্য। কথার চাতুর্যে মুগ্ধ করতে হ’লে মনের অতীন্দ্রিয় লোকে প্রবেশ করতে হয়, যিনি বলিয়ে তাঁকে। ১০

ভ্রমণ কাহিনীটিতে লেখিকা শিল্প সৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর রচনাশৈলীতে স্পষ্ট হয়েছে ভ্রমণ কাহিনী অবশ্যই এক শ্রেণীর সাহিত্য। এবং যা কিছু সাহিত্য তাতে তো সুক্ষ্মতা ও সুকুমারবৃত্তি থাকবেই । শিল্পের দাবি ব্যাপারটি তিনি কখনই বিসর্জন দেননি।

গ্রন্থটিতে রচয়িতার কল্পনাশক্তি ও রচনাশক্তির গুণে প্রত্যেকটি জিনিসই পাঠকের চিত্তে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। লেখিকার গল্প বলার ঢংটি অর্থাৎ তাঁর বর্ণনাশক্তি সম্পূর্ণ তাঁর নিজস্ব। খুব সাধারণ বর্ণনার ভেতর দিয়ে তিনি এক অসাধারণ ছবি ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন।

বিমানে ওড়ার অভিজ্ঞতা, দিল্লীতে রাত্রিবাসের হয়রানি, সোডিয়েটে শীতের বর্ণনা, সেখানকার বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান দেখবার মুগ্ধতা এবং পাশাপাশি ইতিহাসের বর্ণনা, মাঝেমাঝে হাস্য রসিকতা, পোষাকের বিড়ম্বনা, কখনও স্বজনের কথা মনে পড়ে ব্যাথাহত হওয়া প্রভৃতির মাধ্যমে সোভিয়েটের মানুষ এবং সেদেশের সামগ্রিক কাঠামোর একটা পূর্ণাঙ্গ ছবি তিনি পাঠককে উপহার দিয়েছেন।

 

লেনিনের দেশে লালনের মেয়ে । রোকাইয়া জাফরী

 

চরিত্রসৃষ্টির দিক থেকেও লেখিকার দক্ষতা প্রশংসনীয়। তাঁর দোভাষী এবং সোভিয়েটের বিভিন্ন স্থানের সফরসঙ্গিনী মারিয়া ও ফটোগ্রাফার মার্ক গ্রন্থের উল্লেখযোগ্য চরিত্র। সোভিয়েট দেশের এই সরল চরিত্রগুলো তুলে এনে তিনি প্রকৃতপক্ষে সমগ্র রুপবাসীর সংগে পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। তাদের সামগ্রিক আচরণের শীলিত চিত্র পাঠক হৃদয়ে আদৃত হয়ে তাঁর শৈলীকে করেছে উন্নত। মারিয়া সম্পর্কে তিনি বলেছেন-

আমার বিস্মিত দৃষ্টির উত্তরে মারিয়া জানালো যে আমাকে ব্রেকফাস্ট খাওয়ানোর জন্য এবং সঙ্গদান করবার জন্য নির্দিষ্ট সময়ের আগেই সে এসেছে। হোটেলের খাবার ঘরে একা একা আমি অস্বস্তি বোধ করবো, তাই তার আগমন। সর্বত্র ওদের এই অতিথিপরায়ণতার পরিচয় পেয়ে মুগ্ধ হয়েছি। ১১

ফটোগ্রাফার মার্ক সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য :

ক্যামেরা আর ছবি ওঁর অন্তপ্রাণ। এগুলো ছাড়া আর কিছু তিনি বোঝেন না। খুব হাসিখুশী লোকটি। সব সময় স্ফূর্ত্তি ও প্রাণ প্রাচুর্যে ভরপুর। মাঝে মাঝেই পকেট থেকে একমাত্র ছেলের ছবিটা বের করে দেখান, “দেখতো আমার ছেলের ছবিটি কেমন দেখতে? প্রশংসা শুনে খুশীতে ঝলমল করে ওঠে তাঁর মুখ। আমার সঙ্গে তাঁর ব্যবহারটা মনে হয় যেন একজন অপ্রাপ্ত বয়স্কা ছোট বোনের বড় ভাই এর ভূমিকা গ্রহণ করেছেন তিনি। সবসময় সতর্ক দৃষ্টি আমার সুবিধা ও অসুবিধা ঘিরে। আমিও নির্বিচারে তাঁর এই ব্যবহারকে স্বীকার করে নিয়েছিলাম। কারণ যাতে আন্তরিক স্নেহ ও যতু রয়েছে তাকে তো অস্বীকার করলে নিজেকেই ঠকাতে হয়। ১২

এছাড়াও সোভিয়েট মহিলা সংস্থার ডেপুটি চীফ “নীনা ভরোনীনা”, বৃদ্ধ কবি “মিথাইল মুলা রোমভিলা”, উজবেকিস্তানের স্বনামধন্যা মহিলা কবি মিসেস জুলফিয়া প্রভৃতি চরিত্র তাঁর লেখনীর শৈল্পিক স্পর্শে প্রাণ পেয়ে আদর্শ হিসেবে মননের গভীরে প্রবেশ করেছে।

রোকাইয়া জাফরীর রচনাশৈলীতে তাঁর কল্পনাসচেতন হৃদয় এবং বাচনভঙ্গীর নৈপুণ্য রয়েছে। তিনি তাঁর প্রকাশক্ষমতার গুণে পাঠকের হৃদয়ে স্থায়ী ভাবের উদ্রেক করতে সক্ষম হয়েছেন। এক কথায় ভ্রমণকাহিনীটি সালংকারা। একটু খেয়াল করলেই দেখা যায় কাহিনীর সর্বত্রই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য ঐশ্বর্য। কয়েকটি উদাহরণে বিষয়টি আরও পরিস্কার হয়ে উঠবে।

গ্রন্থের শুরুতে সোভিয়েট দেশ ভ্রমণের নিমন্ত্রণ পেয়ে তিনি বলেছেন-

“বিড়ালের ভাগ্যেও তাহলে শিকে ছিঁড়ে ১৩

বিমানে ওড়ার সময় তাঁর কল্পনাপ্রবণ অনুভূতির প্রকাশ

মায়ের কোলে শিশু যখন চাঁদের রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে করায়ত্ত করবার জন্য হাত বাড়ায়, শিশুর সেই মধুর অজ্ঞতায় আমরা মনে মনে হেসে থাকি। আজ শ্রদ্ধার সংগে স্বীকার করতে হচ্ছে যে অদূর ভবিষ্যতে চাঁদ হয়ত আর মানুষের নাগালের বাইরে থাকবে না, এ যুগের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব সে দূরকে করেছে নিকট- আকাশ আর মাটিতে কোন ব্যবধান সৃষ্টি হতে দেয়নি- তাই আকাশের সংগে মাটির কোলাকুলি হচ্ছে অহরহ। ১৪

বিমানে ওড়ার অভিজ্ঞতায় তাঁর অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে নীচের উদাহরণে-

পুরো ঘন্টা দুই একইভাবে বিমানটি উড়ে চললো মেঘের উপর দিয়ে। মাঝে মাঝে সূর্যকে মেঘের আড়ালে মুখ লুকাতে দেখা গেলো। এ যেনো সখীদের কৌতুকে নবোঢ়া লজ্জিত হয়ে শাড়ীর আঁচলে রাঙ্গামুখ লুকাচ্ছে। ১৫

মিষ্টির কারখানা দেখে ফেরার পথে লেখিকার উচ্ছল অনুভূতির বর্ণনা ঃ

লোভী শিশুর মত দু’হাত ভর্তি নানা প্রকার মিষ্টির উপহার গ্রহণ করে হাসতে হাসতে লাল অক্টোবরের কারখানা থেকে বিদায় নিলাম। ১৬

স্বদেশের দরিদ্র অবহেলিত শিশুদের মুখ মনে করে তাঁর ব্যাথাহত হৃদয়ের আর্তি প্রকাশ পেয়েছে নীচের বর্ণনায়-

“শুধুমাত্র সুযোগের অভাবে উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে কত মুকুল ঝরে গেল, কত পুষ্প প্রস্ফুটিত হোল না, ভেবে মনটা বিষণ্ণতায় আচ্ছন্ন হয় বই কি। ১৭

সোভিয়েটের আবহাওয়ার বর্ণনায় –

বৃষ্টি হচ্ছে সেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। এদেশে পা দিয়ে অবধি সূর্যের চেহারা দেখতে পাইনি। এও এক ভিন্ন ধরণের সৌন্দর্য। সর্বদাই স্নান কান্নায় ভেজা আকাশের গাল। ১৮

সোভিয়েটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনায় লেখিকার মুগ্ধ ভাবের প্রকাশ লিখন-

পার্কের ভিতর দিয়ে হেঁটে চললাম। রাত্রির স্বাভাবিক নির্জন নিরবতায় নিওন বাতির মাদকতার সংগে ফোয়ারা হতে উৎক্ষিপ্ত পানির ঝির ঝির শব্দ অদ্ভুত এক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। সুদূরে ফেলে আসা সেই কোন্ ছেলেবেলায় নানী-দাদীর কাছে শোনা গল্পের পরী রাজ্যের কথা মনে পড়ে যায়। ১৯

তবে গ্রন্থের কোথাও কোথাও লেখিকার পার্লামেন্টারী মনোভাব এবং কিছুটা আক্রমণাত্মক মনোভাব প্রবল হয়ে উঠেছে। যা অনেকটাই দম্ভপূর্ণ মনোবৃত্তির পরিচায়ক। ভারত সম্পর্কে তিক্ত অভিজ্ঞতাগুলোর বর্ণনায় তিনি খুব বেশী বেআব্রু হয়েছেন। এতে তাঁর উন্নত ব্যক্তিত্বে অনেকটাই দীনভাব ধরা পড়েছে। তাছাড়া সমগ্র রচনাটিতে লেখিকার বোধগুলোর অমলতাও অনেকখানি অশুদ্ধ হয়েছে।

১. পাকিস্তান দূতাবাসের কর্মচারীরা পড়লেন মহা ফ্যাসাদে। পাকিস্তানের সর্বোচ্চ পরিষদ অর্থাৎ পার্লামেন্টের সদস্যা আমি সুতরাং আমি ভি.আই.পি. দলভুক্ত। আমাকে নিয়ে এ ধরণের পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়াটাই তাদের জন্য বিড়ম্বনাময়। ২০

২. হোটেলের চেহারা দেখে আমি স্তম্ভিত হলাম। এবার সত্যি সত্যিই বিরক্ত হলাম। হাজার হলেও একটা ভব্যতা জ্ঞান থাকা উচিত। আমি বিমানে প্রথম শ্রেণীতে ভ্রমণ করছি তা ছাড়া আমার একটা বিশেষ পরিচয় রয়েছে এমতাবস্থায় আমাকে এই রকম একটা তৃতীয় শ্রেণীর হোটেলে এনে তোলা হোল। এতে যে তাদেরই মানসিক দৈন্যের রূপটা প্রকাশিত হয়ে পড়েছে। মনকে সান্ত্বনা দিলাম এই বলে যে, কয়লা ধুলে ময়লা যায় না। ২১

৩. বিমান ছাড়তে দেরী হবে সুতরাং আমরা যেনো নেমে গিয়ে বিশ্রামাগারে অপেক্ষা করি। মনটা দারুণ বিরক্তিতে ভরে গেলো। হায়রে ভারত যেমন তোমার আতিথ্যের নমুনা, তেমনি তোমার বিমান সার্ভিস। ২২

এছাড়াও তাঁর রচনায় বেশ কিছু অস্পষ্টতা রয়েছে। রাশিয়ায় কমিউনিজমের ব্যাপারটি তিনি সযতনে এড়িয়ে গেছেন। সোভিয়েট দেশের ব্যাপক উন্নতি অগ্রগতির কারণটি তিনি প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়ে ছেড়ে দিয়েছেন। এ সংক্রান্ত তাঁর বর্ণনা পড়তে গিয়ে মনে হয়েছে তিনি সত্য কথাটি জেনেও বলতে পারছেন না বা খোলাখুলি ভাবে বলতে চাইছেন না।

তবে এসব অক্ষমতা ও অপারগতার পেছনে সময় সংক্ষিপ্ততা যে একটি মূল কারণ ছিল; তা তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন। সফরের প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগাতে গিয়ে তিনি প্রতিটি ক্ষেত্র থেকেই ফিরে এসেছেন সময়ের সীমাবদ্ধতার কাছে। তাই ভ্রমণশেষের খন্ডিত প্রাপ্তি তাঁকে ঠিলে দিয়েছে আক্ষেপের দিকে-

সতেরো দিন এদেশে বাস করে গেলাম। এই সতেরো দিন ধরে সোভিয়েট ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে ঘুরেছি। দেখেছি দেশের আভ্যন্তরীণ অবস্থা, জানতে চেষ্টা করেছি এদেশেবাসীকে। অনুধাবন করেছি এদেশের ক্রমবর্ধমান ইতিহাস। মিশেছি বহুলোকের সঙ্গে। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে জানতে চেষ্টা করেছি তাদের জাতীয় চরিত্রকে। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে আমি কতটুকু দেখেছি। আমি যা দেখেছি, যা শুনেছি, যা জেনেছি, তাতে কি আমার সম্পূর্ণভাবে জানা হয়েছে? পূর্ণভাবে দেখতে পেরেছি ? একটা দেশের অন্তরকে জানতে হলে মাত্র সতেরো দিন কি পর্যাপ্ত সময়? তাই তো আমাদের কবির কথা মনে পড়ে

“এ শুধু বালু বেলায়

ঝিনুক কুড়াবার খেলা”। ২৩

লেনিনের দেশে লালনের মেয়ে’র কাহিনীটি যে একজন নারীর সৃষ্টি তার প্রমাণ বইটির সর্বত্রই ছড়িয়ে আছে। লেখিকা তাঁর কাহিনী বলার ভেতর দিয়ে যে কমনীয় নারী হৃদয় খুলে ধরেছেন, দৃষ্টান্তের মাধ্যমে তা আরও স্পষ্ট হবে।

 

লেনিনের দেশে লালনের মেয়ে । রোকাইয়া জাফরী

 

১. ছেলেমেয়েদের কথা স্মরণ করে মনটা দমে যাচ্ছিল। অসহায় দুটি শিশুকে ফেলে এতদূরের পথে পাড়ি জমাতে গিয়ে মনের দিক থেকে এখন আর কোন উৎসাহ পাচ্ছিলাম না। মনের এই ভাবটাকে বাইরে প্রকাশ হতে দিলাম না কারণ, মেয়েটা আমার বড় বেশী সেন্টিমেন্টাল-২৪

২. এত দেশের পুরুষ ও মহিলার সামাবেশ হয়েছে এখানে অথচ কেউ কারও ভাষা জানেনা । সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো যে শাড়ী পরিহিতা মহিলা একমাত্র আমিই ছিলাম, তাই ঘরে প্রবেশ করবার পর থেকেই যে সকলে আমাকে লক্ষ্য করেছে সেটা বেশ টের পাচ্ছিলাম। আমার কৃষ্ণবর্ণ যে তাদের লক্ষণীয় নয় সেটা বেশ বোঝা গেল। কারণ আমার চেয়ে অন্তত দশগুণ কালো কয়েকজন আফ্রিকান পুরুষ ও মহিলা ঘরের এক কোণে একটি টেবিল দখল করে বসেছিল, কিন্তু তাদের দিকে কারউ লক্ষ্য ছিলনা। সুতরাং ওদের দ্রষ্টব্য যে আমি নই আসলে আমার শাড়ীটাই, তা বুঝতে একটুও দেরী হোলনা ২৫

“লেনিনের দেশে লালনের মেয়েতে’ নারী হৃদয়ের ছোঁয়া যেমন পাওয়া যায় তেমনি নারী চরিত্রের নানা বৈশিষ্ট্যের সন্ধানও মেলে। গ্রন্থের কোথাও কোথাও লেখিকার আচরণে বালিকাসুলভ প্রবৃত্তিগুলোর সহজ প্রকাশ এবং কোথাও তিনি হঠাৎই এত বেশী সেন্টিমেন্টাল হয়ে পড়েছেন যে, যা শুধুমাত্র নারীর পক্ষেই সম্ভব।

বাংলার নারীর জাতীয় পোশাক শাড়ীর প্রতি বিদেশীদের জিজ্ঞাসুদৃষ্টি এবং এ নিয়ে লেখিকার বিড়ম্বনা এবং এক ভোজসভায় যোগ দিয়ে নাচের অনুষ্ঠানে তাঁকে যেভাবে নাজেহাল হতে হয়, তার বর্ণনায় তিনি যা বলেছেন তাও শুধু একজন নারীর পক্ষেই সম্ভব। এতে তাঁর কোন কৃত্রিমতা নেই ।

শেষ কথায় লেখিকা রোকাইয়া জাফরীর ‘লেনিনের দেশে লালনের মেয়ে তাঁর রচনাশৈলীর নৈপুণ্যে ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানে বিচিত্র শিল্প কৃতিত্বে ভরপুর। মৌলিক বিচারে তাঁর এ ভ্রমণ কাহিনী নিঃসন্দেহে প্রকৃত ভ্রমণ সাহিত্যের মর্যাদা পাবার যোগ্য ।

Leave a Comment