আজকের আলোচনার বিষয়ঃ তারাশঙ্করের সাঁওতাল কৌম। যা তারাশঙ্করের তিনটি উপন্যাস : কৌমজীবনের রূপায়ণ এর অন্তর্ভুক্ত।

তারাশঙ্করের সাঁওতাল কৌম
ভারতীয় বিভিন্ন আদিবাসী নৃ-গোষ্ঠীর অন্যতম বৃহৎ প্রতিনিধি সাঁওতাল সম্প্রদায়। প্রাক্-দ্রাবিড় তথা আদি অস্ট্রাল’ শ্রেণিভুক্ত এই আদিবাসী গোষ্ঠীর মৌল নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যসমূহ কালিক ধারাবাহিকতায় ক্রমবিবর্তিত হয়েছে। সুতরাং বর্তমান কালের সাঁওতাল জনগোষ্ঠী মূলত সমাজ-অর্থনীতি-সংস্কৃতির সুদীর্ঘকালব্যাপী সংঘটিত বহুমাত্রিক জটিল পরিবর্তনশীলতারই ফল। সাঁওতালদের নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য অনুধাবনের জন্য এদের উদ্ভব ও বিকাশের প্রকৃতি বিশ্লেষণ প্রয়োজন ।
‘সাঁওতাল’ নামকরণের উৎস নির্ধারণে অনিবার্যভাবে বহুবিধ মতভিন্নতার সম্মুখীন হতে হয়। কেননা, নৃতাত্ত্বিকগণ অদ্যাবধি এ বিষয়ে কোনো তর্কাতীত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেননি। Skrefsnud-এর মতে, “সাঁওতাল কথাটির উদ্ভব ঘটেছে সুঁতার (soonter) থেকে। কিংবদন্তিসূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে সাঁওতালদের পূর্ব নাম ছিল খাববার।
‘খর’ শব্দটি ‘হর’ শব্দ থেকে উদ্ভূত যার অর্থ ‘মানুষ’। ‘সাঁওতালরা যখন মেদেনীপুরের সাঁওত পরগণায় এসে বসবাস শুরু করে তখন তাদের নাম হয় সাঁওতাল। বৃহদ্ধর্মপুরাণে’ উল্লেখিত ‘খর’ জাতিই হল সাঁওতাল উপজাতি । প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে আমরা যে ‘নিষাদ’ জাতির উল্লেখ পাই তাদের সাথেও সাঁওতালদের নৃতাত্ত্বিক সাযুজ্য দুর্লভ নয়।
আদি-অস্ট্রালদের ন্যায় সাঁওতালরাও খর্বাকার, দীর্ঘশিরস্ক, গাত্রবর্ণ কালো, নাক চেপটা, ঠোঁট মোটা, চুল কোঁকড়ানো এবং দেহের উচ্চতা মাঝারি ধরনের। এছাড়া আরেকটি বিষয়ে আদি-অস্ট্রালদের সঙ্গে সাঁওতালদের যথেষ্ট মিল পরিলক্ষিত হয়। তা হচ্ছে আদি-অস্ট্রালদের রক্তে ‘এ’ এগুটিনোজেনের (A Agglutinogen) শতকরা হার যেমন বেশি, সাঁওতালদেরও তেমনি। সাঁওতালদের পূর্ব-ভারতে এসে বসতি স্থাপনের পূর্ব- 8 ইতিহাস আজও অনাবিষ্কৃত।
কিংবদন্তি থেকে জানা যায় যে, সাঁওতালরা উত্তর-পূর্ব দিক থেকে পূর্ব বঙ্গের মধ্য দিয়ে পশ্চিম অভিমুখে ছড়িয়ে পড়েছিল। সাঁওতালদের লোককাহিনীতে হিহিড়ি-পিহিড়ি, খোজকামান, হারাতা পর্বত, সাসাংবেদা এবং চায়ে চম্পা নামক বিভিন্ন স্থানের নাম পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় হারাতা বা জরপী পার্বত্য অঞ্চলকেই পরেশনাথের পাহাড় বলা হয়। কারণ এখনও তারা পরেশনাথের পাহাড়কে ‘বারাংবুডু দেবতা’ বলে কল্পনা করে।
আবার অনেক গবেষক চায়ে চম্পাকেই সাঁওতালদের আদি বসতি অঞ্চল হিসেবে অনুমান করেছেন। চায়ে চম্পা বর্তমান হাজারিবাগ মালভূমির উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত। প্রকৃত অর্থে তখনো সাঁওতালরা বিক্ষিপ্তভাবে বসবাসে অভ্যস্ত ছিল।
কালক্রমে তারা পশ্চিমবঙ্গের মেদেনীপুর, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বীরভূম, হুগলী ও মালদহ জেলায় বসতি স্থাপন করে। তবে সাঁওতালদের বাসস্থান কেবল ওইসব অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল না। পশ্চিমবঙ্গ অপেক্ষা ওড়িশার ময়ূরভঞ্জে, বর্তমান ঝাড়খণ্ডের সাঁওতাল পরগণা, হাজারিবাগ এবং মানভূম জেলায় অধিক সাঁওতাল বাস করত।
চায়ে চম্পা থেকে হিন্দু-আগ্রাসনসহ নানা বৈরি পরিস্থিতির শিকার হয়ে সাঁওতালরা এসব অঞ্চল তথা বাংলা দেশ পর্যন্ত বসতি বিস্তৃত করে।’ ব্রাডলে-বার্ট বলেন, ‘মুসলমান শাসনের শেষদিকে পর্যন্ত পাহাড়িয়া সাঁওতাল এবং ভূঁইয়া প্রভৃতি আদিবাসী গোষ্ঠী বর্তমান সাঁওতাল পরগণার অধিত্যকা অঞ্চলে বসতির সন্ধানে দলে দলে আসা যাওয়া করেছে।
আদি-অস্ট্রাল গোষ্ঠীভুক্ত জনসমষ্টি ‘অস্ট্রিক’ ভাষা শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল। সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর ভাষাও ‘অস্ট্রিক’ ভাষা শ্রেণীর অন্তর্গত। সাঁওতালদের ভাষাকে খেরওয়াড়ী ভাষা বলা হয়। খেরওয়াড়ী ভাষা অদ্যাবধি তার স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে। মুন্ডাদের সঙ্গে সাঁওতালদের ভাষাগত ঐক্য রয়েছে।
হডসন মনে করেন- – হো, – সাঁওতালি, ভূমিজ, কুরুখ ও মুন্ডারি হল কোল ভাষার উপভাষা।” আর কোলারীয় উপভাষাগুলির মধ্যে মুন্ডারি, সাঁওতালি এবং হো হচ্ছে প্রধান। গ্রিয়ারসনের মতে, ‘মুন্ডা ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে সাঁওতালি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ।” বিহারি ভাষা সাঁওতালদের ভাষার ওপর কেবল শব্দগত প্রভাব ফেলেছে। আর বাংলা ভাষার প্রভাবও অতি- সাম্প্রতিক কালেরই বিষয়।
অন্যান্য আদিবাসী গোষ্ঠীর মতো সাঁওতালরাও দ্বিভাষী। পারিবারিক জীবনে নিজস্ব (খেরওয়ারী) ভাষা ব্যবহার করে এবং বৈষয়িক প্রয়োজনে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে হিন্দি, তেলেগু ও বাংলা ভাষা ব্যবহার করে । সাঁওতাল আখড়াগুলোতেও যে ঝুমুর গান হতো সেগুলোর বাংলায় প্রতিবর্ণীকৃতরূপ নিম্নরূপ : ছোট মোট বাঙন বেটী ভাড়ায় পড়ে চুল মোচড়ে বান্ধিব কেশ কদম ফুলের ভুল। ২

এসব ঝুমুর গানে বাংলা শব্দের মিশ্রণ অনেকটা সুস্পষ্ট। মুন্ডা ভাষাগোষ্ঠীর উপভাষাগুলির মধ্যে সাঁওতালিই প্রধান এবং এ ভাষাই সর্বাধিক ব্যবহৃত ভাষা। মুন্ডারি ভাষার কোনো নিজস্ব লিপি নেই। ‘রোমান’ লিপিই এ ভাষায় ব্যবহৃত হয়।
দুই
সাঁওতালদের ধর্মবোধ মূলত আচার নির্ভর। অন্যকথায় তাদের আচরিত সংস্কৃতিই তাদের ধর্ম। অরণ্যচারী এই আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে প্রতিনিয়ত প্রকৃতির বহুবিধ প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে যুঝতে হয়। এক্ষেত্রে তাদের নির্ভরযোগ্য আশ্রয় বিভিন্ন অতিপ্রাকৃত শক্তির কল্পনা। ফলে সাঁওতালরা ব্যাপকভাবে পূজা-অর্চনার সংস্কৃতিকে আত্তীকৃত করে নেয়।
এ-সকল প্রথার সাহায্যেই বিগঠিত হয়েছে সাঁওতালদের ধর্মীয় সংস্কৃতি। তাদের যেখানে সীমাবদ্ধকতা কিংবা অপারগতা সেখানেই তারা পরিত্রাণের উদ্দেশ্যে শক্তিমান কাল্পনিক দেবতাকে পূজা দেয়। সাঁওতাল সম্প্রদায় প্রধানত সূর্য” উপাসক। তাদের জাতীয় দেবতা ‘মারাও বুরু’। প্রাচীনকালে যারা বুরু’র আনুকূল্য লাভের প্রত্যাশায় নরবলি দেওয়া হত। বর্তমানকালে অবশ্য নরবলির বিকল্পে লাল ফুলের অর্ঘ্য দেওয়া হয়।
খ্রিস্টধর্মে যেমন ত্রিত্ববাদ, হিন্দু ধর্মে যেমন ত্রি-ঈশ্বর, তেমনি সাঁওতাল ধর্ম-বিশ্বাসে ত্রয়ী হচ্ছেন ‘মারাঙ বুরু’, তার ভাই ‘মনিকো ও বোন ‘জহের আরা’। এই বোঙাদের জন্য শালকুণ্ডে নির্দিষ্ট পূজা স্থান আছে। সাঁওতালদের নিজস্ব কোনো শাস্ত্র বা ধর্মগ্রন্থ নেই। বিভিন্ন লোককাহিনী থেকে তাদের দেব-দেবী, পূজা-পার্বণ, ধর্মবিশ্বাস ও সংস্কার সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। বহুকাল আর্য ধর্মের সংস্পর্শে থাকার কারণে সাঁওতালদের মধ্যে আর্য হিন্দু ধর্মের ব্যাপক প্রভাব পড়েছে।
আর্য হিন্দুদের মত সাঁওতালরাও অসংখ্য দেবদেবীর পূজা করে। রাঢ় অঞ্চলে সাঁওতালদের ধর্মজীবনে হিন্দুর নানা পূজা পার্বণের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। কোনো কোনো আর্য দেবদেবী কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত হয়ে যেমন আদিবাসীদের ধ্যান ধারণার নিকটবর্তী হয়েছে, তেমনি অনার্য দেবদেবী সম্পর্কিত চিন্তা-চেতনা পরিবর্তিত হয়ে আর্যসমাজের ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে মিশে গেছে।
সাঁওতালদের ধর্মবিশ্বাস মূলত তাদের কৃষিনির্ভর সরল অরণ্যজীবনের লৌকিক বিশ্বাস। সাঁওতালদের ধর্মগুরুকে বলা হয় ‘নায়েক’। এই নায়েকই সব ধরনের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদির পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেন । প্রত্যেক সাওতাল পরিবারের আবার দুটি করে বোঙা আছে- ‘ওরাক বোঙা বা গৃহদেবতা এবং ‘আবগে-বোঙা বা গোত্র দেবতা। গৃহকর্তা গৃহদেবতার নাম গোপন রাখেন এবং মৃত্যুকালে পরিবারের জ্যেষ্ঠ ছেলের কাছে ওই নামটি প্রকাশ করে যান।
সাঁওতালরা বছরে পাঁচটি প্রধান অনুষ্ঠান পালন করে থাকে। এগুলি হল : পৌষ মাসে ফসল তোলার সময় নৃত্য-গীত ও পানাহারের মধ্য দিয়ে ‘সোহারায় উৎসব, মাঘ মাসে বন থেকে ঘর ছাওয়ার খড় সংগ্রহের জন্য ‘মাঘ-সিস’ পর্ব, ফাল্গুন মাসের অমাবস্যায় রঙিন পিচকিরির মাধ্যমে রঙ ছিটিয়ে বসন্ত-উৎসব, আষাঢ় মাসে নায়েক-এর তত্ত্বাবধানে মুরগি সংগ্রহ করে শালকুঞ্জর নির্দিষ্ট স্থানে পূজার মাধ্যমে ‘এরিক সিম’ পর্ব পালন, ভাদ্রমাসে ভাল ফসলের প্রত্যাশায় দেবতার কৃপালাভের উদ্দেশ্যে ‘হাড়িয়া সিম’ পূজা এবং অগ্রহায়ণে বোল্ডার নামে শূকর বা ভেড়া বলি দিয়ে সকল গ্রামবাসী মিলে উৎসবমুখর পান-ভোজন উৎসব।
উল্লিখিত হয়েছে সাঁওতালদের ধর্ম-বিশ্বাস বিভিন্ন লোকাচার তথা ভয়, বিস্ময়, আত্মরক্ষার প্রবল ইচ্ছা প্রভৃতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। শক্তির প্রসন্নতা লাভ এবং অপশক্তির প্রকোপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই তাদের ওইসব লোকবিশ্বাস ও পূজা পার্বণের আয়োজন। অগ্নির দাহিকা শক্তি, প্লাবনের ভয়াবহতা অথবা ঝড়ের ভয়ঙ্কর মূর্তি তাদের চিন্তালোকে অনিষ্টকারী দানবীয় শক্তির প্রতীকরূপেই কল্পিত।”
প্রাকৃতিক শক্তির বিভিন্ন পর্যায়কে প্রকৃতির কোলে লালিত সরল আদিবাসী সাঁওতালরা দেবতা ও অপদেবতারূপে কল্পনা করে এবং তাদের সাহায্য প্রাপ্তি ও অপকারিতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নাচগানের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্রত পালন করে। সাঁওতালদের সব রকমের পূজাপার্বণেই নৃত্য একটি অপরিহার্য বিষয়।
নৃত্য তাদের জীবনাচরণের একটা বিশাল অংশ জুড়ে আছে। নৃত্যের দ্বারা দেবতাদের মনোরঞ্জন করা তাদের যেমন ধর্মীয় কাজের মূল অংশ তেমনি তাদের প্রাত্যহিক জীবনেও জীর্ণতা দূরীকরণে নৃত্যের এবং আনন্দ-যাপনে মদ্যপানের আয়োজন অপরিহার্য।
তিন
ভারতীয় উপমহাদেশে বিভিন্ন অরণ্যচারী অনার্য কৌমগোষ্ঠী ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, আর্থনীতিক কারণে আর্য-সভ্যতা দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়েছে। ফলে তাদের নিজস্ব অস্তিত্ব- সংকট হয়ে উঠেছে অনিবার্য। যুগপৎ তাদের নিজস্ব ধর্মীয় সংস্কৃতিও হয়েছে শুদ্ধতা বিবর্জিত, মিশ্রণদুষ্ট।
সভ্যতার আলোকিত মানুষের প্রকট প্রখর আলোক বিচ্ছুরণে আদিবাসী মানুষের আপন স্বচ্ছন্দ অন্ধকার কেটে গিয়ে তাদের স্বাজাত্যবোধও বিসর্জিত হয়েছে। ক্ষুধা নামক রাক্ষসের মুখ-গহ্বরে অবক্ষয়িত হয়েছে ধর্ম, সংস্কৃতি, স্বকীয় জীবনধারা বদলে গেছে তাদের ঐতিহ্যগত নিজস্বতা”।
সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থনীতিক বিবর্তনের ফলে সাঁওতালরা কালক্রমে যেমন আর্য-হিন্দু সভ্যতার সঙ্গে একীভূত হয়ে পড়েছে, তেমনি জীবিকা, জীবনাচরণ এবং চেতনায়ও পরিবর্তন দেখা দিয়েছে। রমেশচন্দ্র দত্তের মতে, ‘সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে এই অর্ধ-হিন্দু অদিবাসীরা প্রতিদিনই হিন্দুধর্মের নিকটবর্তী হচ্ছে। তাদের মধ্যে যারা বেশি অগ্রসর ও সম্মানিত, তারা যে ইতোমধ্যেই হিন্দু ধর্মের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি গ্রহণ করেছে একথা বলা চলে।
পক্ষান্তরে, যারা অতিশয় পশ্চাৎপদ, তারাও হিন্দু ধর্মের আচার-বিচারের কিছু না কিছু গ্রহণ করেছে। বহুকাল ধরে সাঁত্ততাল কৃষ্টির সঙ্গে হিন্দু বৃষ্টির সংমিশ্রণ ঘটেছে, যার ফলিত রূপ প্রত্যক্ষ হয় সাঁওতালদের আচরিত ধর্ম, বিবাহপ্রথা, অন্তেষ্টিক্রিয়া ইত্যাদি প্রাত্যহিক জীবনাচরণের নানা ক্ষেত্রে। প্রসঙ্গত স্মরণীয়, সাঁওতালরা বহু হিন্দু গ্রামে সমবেত হয়ে হিন্দুদের সঙ্গে একত্র দুর্গাপূজা ও হোলি উৎসবেও যোগদান করে।
সাঁওতালদের মৃতদেহ দাহ করা হয়। নিকট আত্মীয়রাই শবদেহ চারপাইতে বহন করে দাহের জন্য নিয়ে যায়। মৃত ব্যক্তিকে স্নান করানো থেকে শ্মশানঘাটে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত নানারকম উপাচার সাঁওতাল কৌমে পালন করা হয়। এর প্রায় সবই অনেকটা হিন্দু ধর্মের অনুকরণে সম্পন্ন হয়ে থাকে।
সাঁওতালরা নদী বা জলাশয়ের ধারে চিতা সাজায়। মৃতদেহ অর্ধেক পোড়ানো হলে তারা মারাও বুরু দেবতার উদ্দেশে ভাত-মাংস রান্না করে তিন রাস্তার সঙ্গম স্থলে রেখে দেয়।” সাঁওতালদের ধারণা পরলোকে তাদের কৃতকর্মের বিচার হয় । তারা পরজন্মে বিশ্বাসী এবং মৃত্যুর পর পূর্বকৃত কর্মের ফলাফলে আস্থাশীল।
তাদের বিশ্বাস জন্মের সময় ঈশ্বর যতটুকু খাদ্য বরাদ্দ করে দেন তা ফুরিয়ে গেলেই মানুষের মৃত্যু ঘটে। সাঁওতাল সম্প্রদায়ে কোনো নবজাতক শিশুর মৃত্যু ঘটলে তাকে অনানুষ্ঠানিকভাবে মাটিতে পুঁতে ফেলার রীতি প্রচলিত।
বিবাহের ক্ষেত্রে সাঁওতালরা নিজ গোত্রের বাইরে বিয়ের ঘোর বিরোধী। সাঁওতাল কৌমে নানাপ্রকার বিয়ে প্রচলিত থাকলেও অভিভাবকদের মাধ্যমে বিয়ে আয়োজনের প্রথাই বেশি প্রচলিত। ডাল্টনের মতে, ‘with such freedom of intercourse, it follows that marriages are generally love matches, and, on the whole, happy ones; but it is considered more respectable if the arrangements are made by the parents or gurdians without any acknowledge reference to the young people, The price to be paid for the girl, overgain five rupees. ২০
সাঁওতাল সমাজে বিবাহের মাধ্যমে পাত্রীর গোত্রান্তর ঘটে। সাধারণত একটি বিয়েই অধিক প্রচলিত, সঙ্গত কারণে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি সাপেক্ষে দ্বিতীয় বিয়ে করা যেতে পারে। বিবাহের রীতি-পদ্ধতি অনেকটা হিন্দুদের মতোই। আদিবাসী এই সমাজে নারীকে যথেষ্ট মর্যাদার সঙ্গে দেখা হয়। ধান-দূর্বা, সিঁদুরের ব্যবহার এবং বিয়ের দিন বর-কনের উপবাস থাকা ইত্যাদি হিন্দু রীতির অনুসরণে সম্পন্ন হয়। শিক্ষিত সমাজের মতো সাঁওতালদের দাম্পত্য-সম্পর্কও বেশ দৃঢ়। স্বামীকে সাঁওতাল নারীরা দেবতারূপে কল্পনা করে।

চার
সাঁওতালদের জীবনধারার সঙ্গে মিশে আছে একটি ঐন্দ্রজালিক প্রক্রিয়া। কারণ আদিবাসী জনগোষ্ঠী নিজেদের সুবিধা মত প্রকৃতিকে কাজে লাগানোর জন্য যেসব উপায় অবলম্বন করে তার মূলে রয়েছে ঐন্দ্রজালিক বিশ্বাস । প্রাচীনকালে সাঁওতালরা শিকারের উপরই নির্ভরশীল ছিল। দলবদ্ধভাবে তীরধনুক নিয়ে তারা শিকারে যেত। সাঁওতালদের মধ্যে জেলে শবর বা নিষাদ এবং কিরাতও আছে।
বনের ফলমূল, শিকার করা পাখি ও পশুর মাংস খেয়ে তারা অতীতে জীবনধারণ করত। উত্তরকালে সামস্তশ্রেণি সাঁওতালদের দিয়ে উষর ভূমি চাষযোগ্য করে তোলে। সাঁওতালরা পরিশ্রমী বলে তাদের জমি পত্তন দিয়ে কৃষিকাজে নিযুক্ত করত ওই শ্রেণি। ফলে একসময় কৃষিই তাদের প্রধান পেশায় রূপান্তরিত হয়। সাঁওতাল কৌমে মেয়ে-পুরুষ একত্র কৃষিতে অংশ নেয় ।
তবে মাটি কর্ষণের কাজটি মূলত পুরুষদের এবং বীজ বোনা ও ফসল তোলার কাজটি মেয়েদের। কেননা, মেয়েদেরকে সাঁওতালরা উর্বর শক্তির উৎস বলে বিশ্বাস করে। আর অধিক ফসলের প্রত্যাশায় তারা এ কাজটি করে থাকে। সাঁওতাল সমাজে কৃষির মঙ্গলাকাঙ্ক্ষায় যত পূজা পার্বণ হয় তা মেয়েরাই সম্পন্ন করে।
অধিকাংশ সাঁওতাল কৃষিজীবী হলেও সামাজিক-রাজিৈতক বাস্তবতার পীড়নে অনেক সাঁওতালকে চা-বাগানের কুলির কাজও নিতে হয়েছে। অধিক পরিশ্রমী হিসেবে সাঁওতাল নারী-পুরুষ উভয়েরই যথেষ্ট সুখ্যাতি আছে। গোত্রভেদে কাজের ক্ষেত্রে সাঁওতালদের কিছু বাধা-নিষেধ আছে। এ ক্ষেত্রে তারা অনেকটা ধর্মীয় বিশ্বাসের অনুসারী।
সাঁওতালরা যথেষ্ট সৌন্দর্য ও পরিচ্ছন্নতা প্রিয়। তাদের ঘর-বাড়ি, মেঝে, ঘরের দেওয়াল, বাড়ির আঙিনা সবকিছু বেশ পরিষ্কার ও শিল্পশোভন হয়ে থাকে। সমগ্র আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে সাঁওতাল সংস্কৃতিই সবচেয়ে সমৃদ্ধ। ইতিহাসের এক বিশেষ পর্যায় থেকে সাঁওতাল সম্প্রদায়ের প্রধান খাদ্য হয়ে ওঠে ভাত। বনের আলু সিদ্ধ করেও তারা খায়।
এ ছাড়া মাছ, কাঁকড়া, শূকর, ইঁদুর, মুরগি, কাঠবিড়ালি, গোসাপ, পাখি, লাল পিপড়া, বন্যপ্রাণী প্রভৃতি তারা আদিকাল থেকে এখনো খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। সাঁওতালদের মধ্যে মাংস শুকিয়ে খাওয়ার প্রবণতাও লক্ষণীয়। তাদের কিছু ট্যাবু (Taboo) রয়েছে। যেমন, হাঁসদাকরা হাঁস খায় না, মুরমরা নীল গাভীর মাংস খাওয়া থেকে বিরত থাকে, কিসকুরা গোত্রভুক্ত ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বিয়ে দেয় না, কোনোকোনো গোত্র টিকটিকি মারে না, আতপ চাল খায় না।
এসব ট্যাবু তারা মেনে চলে। মদ এদের প্রিয় পানীয়। স্থানীয় ভাষায় এরা মদকে হাড়িয়া বলে। সাঁওতালরা ভাত বা মহুয়া ফুলের রস পচিয়ে নিজেরাই মদ তৈরি করে। মদ সম্পর্কে সাঁওতাল সমাজে অনেক গাথা- উপগাথা প্রচলিত আছে। তারা পূজা-পার্বণ, নাচ-গান, বিয়ে সব অনুষ্ঠানেই প্রচুর মদ পান করে।
সাঁওতাল গোত্রগুলোর মধ্যে তাদের পূর্বপুরুষ কিংবা টোটেম সম্পর্কিত ধারণা ভিন্ন রকমের। যেমন, হাঁসদা গোত্রের উদ্ভব হাঁস থেকে। হেমবরম সুপারি থেকে, মুরমু নীল গাভী থেকে, মারনদী ঘাস থেকে এবং টুডু বাদ্যকর থেকে উদ্ভূত। সাধারণত হাঁসকেই সাঁওতালদের টোটেম হিসাবে ধরা হয়। ”
পাঁচ
প্রায় সব আদিবাসী সমাজব্যবস্থাতেই একটি স্বকীয় সামাজিক কাঠামো থাকে। কৌমের প্রত্যেককে সুশৃঙ্খলভাবে স্ব-স্ব সমাজ-ব্যবস্থার বিধি-বিধান মেনে চলতে হয়। গোষ্ঠী-সংস্কৃতি যেহেতু সমাজ-সংহতির নিয়ামক সেহেতু গোষ্ঠী-প্রধানকে অবজ্ঞা করবার সাহস সমাজের কারো কারো না।
সাঁওতাল সমাজ-ব্যবস্থায়ও ওই রকম প্রশাসনিক ধারা প্রাচীনকাল থেকেই বিরাজমান। সাঁওতালদের গ্রাম প্রধানদের নাম ‘মাঝি’, উপ-প্রধান ‘পরামানিক’, মাঁঝির কর্মাধ্যক্ষ ও গ্রামবাসীর নৈতিক অভিভাবক হলেন ‘যোগ-মাঁঝি’, প্রধান পূজারীর নাম ‘নায়েক’, উপ-পূজারীর নাম ‘কুমুদ নায়েক’ আর রয়েছে ‘গোড়াইৎ পেয়াদা’- — যে ঊর্ধ্বতন সবার আদেশ পালন করে। সাঁওতাল সমাজ এই প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে বেশ নির্বিঘ্নে এবং শান্তিপূর্ণভাবে পরিচালিত হয়।
তাদের সরল আরণ্যক সমাজে জীবন-যাপনের জন্য যা চাহিদা তা অরণ্যচারী আদিম এই সন্তানেরা বন- জঙ্গল থেকেই সংগ্রহ করে নেয়। সভ্যতার আলোকপাতের ফলে উত্তরকালে আর্থনীতিক বোধ, সম্পত্তির ধারণা, স্বাধিকার চেতনা ইত্যাদি মৌল বিষয়গুলি তাদের চেতনালোকে আলোড়ন তোলে। নিজস্ব লোকবিশ্বাস কেন্দ্রিক সমাজে কৃষি ও শিকারনির্ভর সমাজজীবন যথেষ্ট স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ ছিল সাঁওতালদের । অরণ্যপ্রীতি তাদের মধ্যে প্রবল।
ফলত অরণ্যত্যাগে তারা বরাবরই অনাগ্রহী। এই অরণ্যপ্রীতিকে তাদের নিজ্ঞান দেশাত্মবোধের বহিঃপ্রকাশরূপে ধরে নেয়া যায়। যে কোনো সমাজ-ব্যবস্থায়ই ভাঙন বা বিবর্তনের মূলে কাজ করে আর্থনীতিক ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তন। ইতিহাসের এক বিশেষ পর্বে সাঁওতাল সমাজ-ব্যবস্থায়ও এই ভাঙনের বীজ রোপিত হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক ভারসাম্যহীনতা সাঁওতাল সমাজ-ব্যবস্থার ভাঙনে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।২৬
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর প্রহসনমূলক যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের মাধ্যমে গোটা ভারতবর্ষে ব্রিটিশ বানিজ্যশক্তির প্রতিনিধি প্রতিষ্ঠান ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একাধিপত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। ” দেওয়ানী লাভ থেকে কালক্রমে তারা রাজশক্তিতে অধিষ্ঠিত হয়। শুরু হয় তাদের পুঁজিবাদী বাণিজ্য ও আর্থনীতিক আগ্রাসন।
আর্থ-রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোলুপ দৃষ্টি সমগ্র ভারতবর্ষের ন্যায় রাজমহল থেকে হাজারীবাগ ও মুঙ্গেরের সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তার লাভ করে। ওই সময় থেকেই কোম্পানির অর্থলোভী কর্মচারি ও তাদের দেশীয় পুঁজিবাদী বাণিজ্য-সহায়ক মহাজন ও জমিদার শ্রেণি সরলমনা আদিবাসী পাহাড়ি কৌম গোষ্ঠীগুলোর উপর সীমাহীন শোষণ চালাতে থাকে।
বীরভূম, বাঁকুড়া, ভাগলপুর, বর্ধমান, মেদেনীপুরের পশ্চিমাংশ ও ময়ূরভঞ্জের শ্বাপদ সংকুল অরণ্য অঞ্চল পর্যন্ত কোম্পানি-শাসনের জান্তব থাবা বিস্তার লাভ করে। জমিদার, মহাজন এবং কোম্পানির কর্মচারি-শ্রেণির কাছে সরল বিশ্বাসী আরণ্যক সাঁওতাল জনগোষ্ঠী অসহায় জিন্মিতে পরিণত হয়। ফলে ভাঙন ধরে তাদের স্বকীয় সমাজ-সংস্কৃতিতে পরিবর্তন আসে ধর্মীয় ও সামাজিক জীবনাচারে।
১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কর্নওয়ালিশ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন’ প্রণয়ন করলেন। এই আইনের বাস্তবায়নের ফলে অরণ্যচারী সাঁওতালগোষ্ঠী অবাধ কর্ষণযোগ্য জমি ও জঙ্গলের উপর তাদের অধিকার হারায়। অথচ জঙ্গলকে সর্বদা তারা নিজেদের সম্পত্তি মনে করত এবং একে স্বাধীনভাবে ব্যবহার করা প্রাপ্য অধিকার বলে জানত। জঙ্গল ও জমির ওপর অধিকার হারানোয় তাদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
ওই সময়পর্ব থেকেই জীবন ধারণের জন্য তারা মরিয়া হয়ে মহাজন জমিদার-রাজকর্মচারি ও সমতলবাসীর অস্থাবর সম্পত্তি লুটতরাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে। ‘চিরস্তায়ী বন্দোবস্ত’ আইন বাস্তবায়নের পর প্রাণান্ত শ্রমের বিনিময়ে জঙ্গল পরিষ্কার করে চাষযোগ্য জমি তৈরি করেছে সাঁওতালরাই, অথচ তারা ওই জমি থেকে ক্রমশ উচ্ছেদ হতে থাকে। ফলে সমগ্র সাঁওতাল কৌমে ক্রমান্বয়ে অসন্তোষ ও বিক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে।

এরও আগে, ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দে ক্যাপ্টেন ব্রুক আদিবাসী পাহাড়িয়াদের দমন করবার জন্য সসৈন্যে অগ্রসর হয়েছিলেন। কিন্তু সাঁওতালরা অরণ্যের ভিতর থেকে তীর ছুঁড়ে কয়েকজন সৈন্য হত্যা করে ইংরেজ বাহিনীকে ফিরে যেতে বাধ্য করে। ১৭৭৯ খ্রিস্টাব্দে ক্লিভল্যান্ড ভাগলপুরের কালেক্টর নিযুক্ত হয়ে আসেন। তিনি সাঁওতালদের অসন্তোষ দূর করবার জন্য কৌশল অবলম্বন করেন। সরল বিশ্বাসী মানুষগুলির মন জয় করে তাদের আয়ত্তে আনতে প্রয়াসী হন তিনি এবং কিছুটা সাফল্যও লাভ করেন।
পরবর্তীকালে শাসক শ্রেণি শাসন ও শোষণ প্রক্রিয়া সহজতর করবার জন্য একটি পাহাড়ি উপনিবেশ স্থাপনে প্রয়াসী হয়। নাম রাখা হলো দামিন-ই-কোহ’, যার অর্থ পাহাড়ের প্রান্তদেশ। প্রথমে অরণ্যচারী সাঁওতালরা তাদের স্বাধীন বিচরণ ক্ষেত্র ছেড়ে নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে আবদ্ধ হতে চায়নি। কিন্তু বণিকের মানদণ্ড শাসকের রাজদণ্ডে পরিণত হতে কালবিলম্ব ঘটল না।
অমানুষিক নির্যাতন শুরু হলো সাঁওতালদের ওপর। বিদেশী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হলো সাঁওতালরা। নেতৃত্ব দিল তিলকা মাঝি। সাঁওতালদের ওপর দেশীয় শাসক ও শোষক গোষ্ঠীর অন্যায়-অত্যাচারের চরম প্রতিশোধ গ্রহণে তারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হল এবং নিজেদের সংঘবন্ধ করে অনেকটা আধুনিক গেরিলা যুদ্ধের প্রক্রিয়ায় শাসক শ্রেণিকে ভীত ও অতিষ্ঠ করে তুলল।৩২
রিডল্যান্ডের মৃত্যুর পর সাঁওতালদের ওপর ইংরেজদের অত্যাচার নির্যাতন বর্ণনাতীতভাবে বৃদ্ধি পায়। তখন বিদ্রোহী আদিবাসীদের ধরার জন্য অরণ্য চষে বেড়ায় ব্রিটিশ সৈন্য। কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে না পেলে ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে তারা ক্ষান্ত হতো। এ-সময় সাঁওতালদের সঙ্গে কোম্পনি সৈন্যের খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়, অনেক সাঁওতাল ওইসব যুদ্ধে ধরা পড়ে, অনেকে নিহত হয়।
এ-ধরনেরই এক যুদ্ধে সাঁওতাল বিদ্রোহের আদি নেতা তিলকা মাঁঝিকে ধরে ব্রিটিশ সৈন্যরা পাশবিক নির্যাতনের পর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে। কিন্তু এতে বিদ্রোহ প্রশমিত হয় না, বরং বিস্তার লাভ করল সর্বত্র। এ সময় শাসকগোষ্ঠী কিঞ্চিৎ অনুধাবন করতে সমর্থ হয় যে, চাপিযে দেওয়া পীড়নমূলক অর্থনীতির কুপ্রভাবেই আদিবাসী মানুষ মরণযন্ত্রণায় আর্তনাদ করে উঠেছে।
স্বীয় সমাজ-ব্যবস্থা, জীবিকার্জন পদ্ধতি, ধর্ম ও জীবনাচরণের ওপর আঘাত প্রতিহত করবার জন্য অরণ্যবাসী মানুষ দ্রোহাগির স্ফূলিঙ্গে পরিণত হয়। সুচতুর ইংরেজরা এর প্রতিক্রিয়ায় সাময়িকভাবে বিদ্রোহীদের বীরভূমের পাহাড় ও জঙ্গল কেটে চাষাবাদের সুযোগ করে দেয়। সাঁওতালরা এভাবেই ‘দামিন-ই কোহ’র পূর্বপ্রান্তে সগড়ডাঙা, পিপড়া ও আমগাছিয়াতে প্রথম গ্রাম তৈরি করল।
১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে দুমকা ও ১৮১৮ সালে গোড্ডা মহকুমাতেও বসতি স্থাপন করল তারা। ইতোমধ্যে তাদের নতুন করে গড়ে তোলা এইসব আবাসস্থলেও হিন্দু জমিদার ও মহাজনরা নিজেদের ভূমিলোলুপ হাত প্রসারিত করে। তারা ক্রমাগত পাহাড়ি এলাকা অধিগত করতে থাকায় ‘দামিন-ই কোহ’র চারপাশে সীমানা নির্ধারণ করবার দায়িত্ব দেওয়া হয় জন পেটিওয়ার্ডের ওপর।
১৮৩২-৩৩ খ্রিস্টাব্দে পিলপা দ্বারা স্থায়ীভাবে ‘দামিন-ই-কোহ’ অঞ্চল গঠিত হয়। এই ‘দামিন-ই-কোহ’ অঞ্চলে গোত্র পঞ্চায়তের মাধ্যমে একটি বিশেষ সমাজকাঠামো তৈরি ও চালু হয়। সাঁওতালদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে অল্পদিনের মধ্যেই এই অঞ্চল ঐশ্বর্যমণ্ডিত হয়ে উঠলে ঘটনাচক্রে বিচ্ছিন্ন সাঁওতালরা দলে দলে জড়ো হয়ে বৃহত্তর সাঁওতাল গোষ্ঠী পুনর্গঠনে সক্ষম হয়। কিন্তু ব্রিটিশ রাজনীতি ও অর্থনীতির লাগামহীন স্বার্থপরতার অপরিহার্য পরিণাম হিসাবে এখানেও হিন্দু মহাজন ও ব্যবসায়ীদের আবির্ভাব ঘটে।
ফলত সরল আদিবাসীরা পুনরায় জড়িয়ে পড়ে জটিল আর্থনীতিক ফাঁদের আবর্তে। দাদন, বন্ধক, নিলাম, ঠিকা মুজুরি, সুদ ও তেজারতি ইত্যাদি আর্থনীতিক কুটিলতায় ইতিহাসের এই পর্বে সাঁওতালরা ক্রমান্বয়ে জমি শস্য মহিষ সবকিছু হারিয়ে বংশানুক্রমে কৃতদাসে পরিণত হতে থাকে। এই সময় থেকেই সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও হোওঁ প্রভৃতি আদিবাসী গোষ্ঠী পুনরায় সংক্ষুব্ধ হতে থাকে।
সাঁওতালদের শ্রমলব্ধ লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের সবটাই স্থানান্তরিত হতে থাকে ইংরেজ কুঠি মহাজন ও ব্যবসায়ীদের ঘরে। জমি তৈরির সময় তাদেরকে নিষ্কর জা ভোগের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও, পরে প্রতিশ্রুতির বরখেলাপ করে তাদের চাষবাসের জমির ওপর ব্যাপকহারে করারোপ করা হয়। দামিন-ই কোহ থেকে ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে খাজনা আদায়ের পরিমাণ ছিল ২০০০ টাকা। কিন্তু ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৪৩৯১৮ টাকা ১৩ আনা ৫॥ পয়সায়।” এই তথ্য থেকেই শোষণ আর নিপীড়নের মাত্রা অনুধাবনযোগ্য।

ছয়
সাঁওতালদের বহুদিনের পুঞ্জীভূত যন্ত্রণার ঐতিহাসিক বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে। এ-সময় সাঁওতাল কৃষকদের বিদ্রোহ ও বিক্ষোভ প্রতিরোধে সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হয় ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনী। সমগ্র ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসে এটি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা।
সাঁওতাল কৌমের যুগলভ্রাতা সিধু ও কানহুর নেতৃত্বে প্রথমে সাঁওতালেরা আক্রমণ করে জমিদার মহাজনদের, পরে ইংরেজ সৈন্যদের। সংগ্রামে পরাস্ত হলেও তারা কৃষকসভার মাধ্যমে পরবর্তীকালে আবার সংগঠিত হতে থাকে। সাঁওতাল কৃষকদের সঙ্গে অন্যান্য কৃষকরাও ওই বিদ্রোহে একাত্মতা ঘোষণা করেছিল। ফলে সাম্প্রদায়িকতার সীমানা ছাড়িয়ে বিদ্রোহ সার্বজনীন রূপ লাভে সক্ষম হয়। ৩৭
ডাব্ল ডাব্লু হান্টার তাঁর দ্য অ্যানালস অব রুরাল বেঙ্গল গ্রন্থে সাঁওতাল বিদ্রোহ সম্বন্ধে লিখেছেন, ‘সমতল ভূমি দিয়ে কলিকাতা অভিমুখে যাত্রার সাধারণ নির্দেশ শিবিরে প্রচারিত হয় এবং ১৮৫৫ সনের ৩০ শে জুন এই বিশাল অভিযাত্রা শুরু হয়। নেতাদের শুধু দেহরক্ষীর সংখ্যাই ছিল ৩০ হাজার জন। এটি পৃথিবীর প্রথম এবং বৃহৎ গণ-অভিযান ছিল।৩৮
আদিবাসীরাই ভারতবর্ষের প্রকৃত স্বদেশী। তাদের আত্মত্যাগ ইতিহাসের এক অম্লান অধ্যায়। বুর্জোয়া ঐতিহাসিকেরা সাঁওতালদের এই আত্মত্যাগের ইতিহাসকে ‘হাঙ্গামা’ বলে প্রচার করেছেন। তাঁদের ভাষায় এটি ছিল আদিম ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। কিন্তু ইতিহাস কখনো চাপা থাকে না।
ডি. বাঘবাইয়া ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের সাঁওতাল বিদ্রোহ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘বিভিন্ন আদিম জাতির সঙ্গে সংগ্রামের অঙ্গ হিসাবে নানা জটিলতার কিছুটা পূর্ব অভিজ্ঞতার পর ব্রিটিশ ইন্ডিয়া কোম্পানির সরকারকে সম্ভবত বৃহত্তম আদিবাসী অভ্যুত্থানের, ১৮৫৫ সালের সাঁওতাল জাতির বিদ্রোহের সম্মুখীন হতে হলো। এর আগে অবধি ব্রিটিশরা জানত না আদিবাসীদের সঙ্গে সংঘাতের অর্থ কি, সুতরাং এবার ব্রিটিশদের এই সমস্যা মোকাবেলা করবার জন্য খুব ভাল ভাবে তৈরি হতে হলো। এ জন্যই আমরা দেখতে পেলাম সাঁওতালদের সঙ্গে এবং প্রায় একই সময় এ দেশের আরেকটি উপজাতি, মুন্ডাদের সঙ্গে আচরণে ব্রিটিশরা আরো বেশি সতর্ক, আরো বেশি যত্নবান হয়েছে।৩৯
সাঁওতাল বিদ্রোহ বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। স্বদেশ, স্বজাতি ও স্বসংস্কৃতির প্রতি সরল প্রকৃতির এই মানুষদের ছিল প্রগাঢ় মমত্ববোধ। স্বরাজ প্রতিষ্ঠার জন্যই সাঁওতালরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিল। স্বাধীনচেতা এ গোষ্ঠী কোনোদিন পরাধীন থাকতে চায়নি। সামগ্রিক অবস্থা এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল যে, সেদিন সাঁওতালদের বিদ্রোহ করা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। ওই বিদ্রোহের সময়ে সাঁওতালদের জীবন কতটা সংকটাপন্ন ছিল এবং তাদের দেশপ্রেম কতটা গভীরে প্রোথিত ছিল তার প্রমাণ মেলে সমসাময়িক একটি গানে—
আমরা প্রজা, সাহেব রাজা, দুঃখ দেবার যম
তাদের ভয়ে হটবো মোরা এমনি নরাধম ?
মোরা শুধু ভুগবো?
না, না মোরা রুখবো
এ গানের মধ্যে সাঁওতালদের সামগ্রিক চেতনার আপোষহীন সংগ্রাম আর স্বরাজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্নই প্রতিফলিত হয়েছে। সারল্য, শ্রমনিষ্ঠা, সত্যনিষ্ঠা এবং স্বাধিকার চেতনা ছিল সাঁওতালদের মজ্জাগত প্রবণতা। সাঁওতাল বিদ্রোহের সূচনা থেকেই তাদের মধ্যে সচেতনভাবে স্বাধিকারবোধ কাজ করেছিল। পুলিশ মহাজন আর শাসক শ্রেণির অত্যাচারের স্মৃতি তাদের মধ্যে দেশপ্রেমকে প্রবলতর করে তোলে। এ কথা বলা বাহুল্য যে, সাঁওতালরা বিদ্রোহ করেছিল স্বাধীনতার জন্য।
পরবর্তীকালে ডব্লিউ জি আর্চার লিখেছেন— ‘এটা এখন সকলেই স্বীকার করেন যে, সাঁওতাল বিদ্রোহের একটা গভীরতর, অন্ততপক্ষে অতিরিক্ত কারণ হচ্ছে সাঁওতালদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা : যখন তাদের মাথার উপর কোনো উৎপীড়ক প্রভু চেপে বসেনি সেই প্রাচীন অতীত দিনের স্বপ্ন হয়তোবা প্রাগৈতিহাসিক যুগের সেই স্মৃতি, যখন কোনো কোনো পণ্ডিতের মতে সাঁওতালরা নিজেরাই ছিল গাঙ্গেয় উপত্যকার একচ্ছত্র প্রভু এবং আর্য আক্রমণকারীদের দ্বারা তখনও সেখান থেকে তাড়া বিতাড়িত হয়নি।
যাই হোক না কেন, কোনো কোনো সময় সাঁওতালদের মধ্যে ‘খেরওয়াড়ী’ নামে একটা আন্দোলন দেখা যায়। ‘খেরওয়াড়ী’ সাঁওতালদের প্রাচীন নাম এবং সাঁওতালদের মনে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত হয়ে আছে সেই অতীত দিনের স্মৃতি, যখন তারা চম্পা দেশে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে বাস করত; কাউকে খাজনা বা কর দিতে হত না, কেবল সর্দারগণকে সামান্য কিছু বার্ষিক খাজনা দিলেই চলত।’ এর থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, সাঁওতালদের বিদ্রোহ সাম্রাজ্যবাদী শোষক ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে পরিকল্পিত এবং সচেতন সংগ্রাম।
এটা কোনো আকস্মিক ঘটনামাত্র নয়। কালিক-গতিধারায় বিশ্বের সবকিছুতেই আসে বিবর্তন। বিশ্বরাজনীতি, অর্থনীতি, সভ্যতার নতুন নতুন যান্ত্রিক উদ্ভাবন সর্বোপরি মানুষের জীবনধারায়ও আসে পরিবর্তন। আরণ্যক সমাজেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। বাংলার স্বাধীনতা হৃত হওয়ার পর থেকে আদিবাসীদের উপর নেমে আসে অকথ্য নির্যাতন। বিপর্যস্ত হতে থাকে তাদের স্বাভাবিক জীবনগতি।
ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার আগ্রাসনে সাঁওতালদের সামগ্রিক জীবনে দেখা যায় ব্যাপক পরিবর্তন। বহুমাত্রিক আর্থনীতিক শোষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় তারা। প্রাচীনকাল থেকে যে নৃ-গোষ্ঠী ভূমিনির্ভর আরণ্যক জীবনে অভ্যস্ত, ভূমি থেকে উন্মলিত হয়ে তারা পেশা পরিবর্তনে বাধ্য হয়। জমিদার, মহাজন ও শাসক শ্রেণির শোষণের ফলে হাজার বছরে গড়া ঐতিহ্যিক জীবনধারা থেকে বিচ্যুত হয়ে তারা ভূমিহীন শ্রমজীবীতে রূপান্তরিত হয়। ব্রিটিশ সরকার প্রবর্তিত ভূমি আইন সাঁওতালদের শোষণের সহজ শিকারে পরিণত করে।
যা তাদেরকে আদি পেশা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। সাঁওতাল তথা আদিবাসী সম্প্রদায়ের ওপর আরেকটি বড় আঘাত ছিল ব্রিটিশ সরকারের বন সংরক্ষণ নীতি। ওই নীতিবলে বনের ওপর আদিবাসীদের সার্বিক অধিকার হরণ করা হয় অন্যায়ভাবে।
জীবিকার জন্য অনন্যোপায় হয়ে সাঁওতালরা তখন থেকে কৃষিজীবী থেকে শিল্প-কারখানা ও বাসা-বাড়ির মুজুরে পরিণত হয়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্ত জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়। অরণ্য-নির্ভর মানব সন্তান অরণ্যের জন্মগত অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে এভাবেই।