আজকে আমরা আলাউদ্দিন আল আজাদের সাহিত্যজীবন ও ছোটগল্প রচনার পটভূমি আলোচনা করবো। যা আলাউদ্দিন আল আজাদের ছোটগল্পে জীবনবোধের রূপ রূপান্তরের অন্তর্গত।

আলাউদ্দিন আল আজাদের সাহিত্যজীবন ও ছোটগল্প রচনার পটভূমি
আলাউদ্দিন আল আজাদ (জন্ম-১৯৩২) বাংলাদেশের একজন উল্লেখযোগ্য সব্যসাচী লেখক। গল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ, সমালোচনা প্রভৃতি সাহিত্যের নানা রূপাঙ্গিকে তাঁর রয়েছে অবাধ ও স্বচ্ছন্দ বিচরণ। পঞ্চাশের দশকে তরুণ প্রতিশ্রুতিশীল ছোটগল্পকার হিসেবে তিনি খ্যাতির শীর্ষে ছিলেন। শিল্পী কালের কন্ঠস্বর। মেধাবী ও নিষ্ঠাবান শিল্পীর সৃজনকর্মে থাকে সময়ের নানা বর্ণিল ঘটনার ঘনঘটা। তাঁর সৃজনী প্রতিভা বিকাশের ক্ষেত্রে চারপাশের পরিবেশ পালন করে মুখ্য ভূমিকা।
আলাউদ্দিন আল আজাদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। তাঁর ছোটগল্পে চিত্রিত জীবনের রূপ-রূপান্তরের স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে হলে প্রথমেই শিল্পীর জীবনবোধ, শিল্পরুচি ও চেতনালোকের মৌল প্রবণতাসমূহ ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। কেননা ব্যক্তিসত্তার আন্তরজাত বৈশিষ্ট্য এবং কালধর্মের প্রভাবজাত চেতনাগুচ্ছের সমাহারেই গড়ে ওঠে শিল্পীর নিজভুবন ।
পারিবারিক উত্তরাধিকার ও শৈশবজীবন
শিল্পীর নান্দনিক মনস্তত্ত্ব গড়ে ওঠার পেছনে পারিবারিক উত্তরাধিকার মুখ্য বিচার্য না হলেও এর একটা প্রভাব সংগোপনে কাজ করে। পারিপার্শ্বিক পরিমণ্ডলে শিল্পীসত্তার শিকড় হয় প্রোথিত ও বর্ধিত, যা থেকে বিশাল মহীরুহের সম্ভাবনার বিস্তার ঘটে। আলোচ্য শিল্পী আলাউদ্দিন আল আজাদ বৃহত্তর ঢাকা জেলার বর্তমান নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার অন্তর্গত রামনগর পিতৃভূমিতে, ১৯৩২ সালের ৬ই মে, বাংলা ১৩৩৯ সনের ২২শে বৈশাখ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন।
পৌরাণিক পরিচিতিতে প্রসিদ্ধ ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী ছায়াসুনিবিড় সবুজ শ্যামলিমায় তিনি শৈশব ও কৈশোর অতিক্রম করেছেন। তাঁর পিতার নাম গাজী আবদুস সোবহান আর মাতা আমেনা খাতুন। তিনি চারবোনের পর জন্মগ্রহণ করেন। ফলে পিতামাতার আর আনন্দের সীমা ছিল না। মা পরমযত্নে তাঁকে লালনপালন করতে শুরু করেন এবং শিশুপুত্রের নাম রাখেন বাদশাহ। কিন্তু বাদশাহের দুর্ভাগ্য, মাত্র আঠারো মাস বয়সে তিনি মাতৃহারা হন।
এরপর দাদির স্নেহ-মমতায় তিনি বেড়ে ওঠেন। বাবাও বেশিদিন বেঁচে থাকেননি। মাত্র দশ বছর বয়সে আলাউদ্দিন আল আজাদ হন পিতৃহারা। শৈশবেই এক ভয়াবহ নিঃসঙ্গতার স্বীকার তিনি। সমবয়সীদের সঙ্গে খেলাধুলা কিংবা হৈ চৈ তাঁর ভালো লাগত না। দাদির কাছে থাকতেন, নানা সময়ে তিনি তাঁকে ভৈরব ও ব্রহ্মপুত্র পারের নানা লোককাহিনী ও রূপকথার কেচ্ছা শোনাতেন।
তখন থেকেই কিশোর মনে গল্প বা কাহিনীর প্রতি অনুরাগ জন্মে। এই গল্প শোনার বাসনা ও গল্পানুরাগ উত্তরকালে তাঁর সাহিত্যবোধ সৃজনে পালন করেছে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা। এছাড়া তাঁর বাড়ির এক চাচার লেখা বেশ কিছু ছড়া ও কবিতার খাতা তিনি হাতে পান। অপরদিকে তাঁর মাতামহ শাহ আমানত আলি একজন জনপ্রিয় মরমী লোককবি ছিলেন বলে জানা যায়।

অধ্যয়ন ব্যাপ্তি ও কর্মজীবন
আলাউদ্দিন আল আজাদ খুব কম বয়সে পিতামাতার স্নেহবঞ্চিত হন। শুরু হয় তাঁর একাকী ও নিঃসঙ্গ সংগ্রামী জীবনের পথচলা। লেখাপড়ার মধ্যেই তিনি সকল হারানোর সান্ত্বনা খুঁজেছেন। বইকে করলেন নিত্যসঙ্গী, গভীর অধ্যবসায়ী হয়ে উঠলেন তিনি। ‘বর্ষাকালে কচুরীপানার স্তূপের ওপরে বইখাতাপত্র রেখে, সেটা ঠেলে নিয়ে নদী সাঁতারে ওপারে উঠে চার মাইল দূরের বিদ্যালয়ে গিয়ে ক্লাশ করতেন। মেধাবী ছাত্র হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে ছাত্র-শিক্ষক মহলে।
তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় ১৯৩৭ সালে রামনগর জুনিয়র মাদ্রাসায়। এখানে তিনি ১৯৪২ সাল পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। ১৯৪৩ সালে ভর্তি হন নারায়ণপুর শরাফতউল্লাহ উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়ে। এ বিদ্যালয় থেকে তিনি ১৯৪৭ সালে প্রবেশিকায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর গ্রাম ছেড়ে তিনি শহরে চলে আসেন, উদ্দেশ্য একটাই ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উচ্চ মাধ্যমিক পড়া। বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল। কিন্তু আর্থিক কারণে তা সম্ভব হয় নি।
‘লোজিং থেকে পড়তে হবে বলে বিজ্ঞান নিলেন না। আর্টস বিভাগে ঢাকা ইন্টার কলেজে ভর্তি হলেন। আলাউদ্দিন আল আজাদ ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে ভর্তি হন ১৯৪৭ সালে এবং ১৯৪৯ সালে দ্বিতীয় বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি হলেন প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী বাংলা বিভাগে। এ বিভাগ থেকে ১৯৫৩ সালে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে তিনি স্নাতক সম্মান ডিগ্রি লাভ করেন।
পরের বছর অর্থাৎ ১৯৫৪ সালে এম.এ. পরীক্ষায়ও তিনি প্রথম শ্রেণী লাভ করেন এবং নিয়মিত পরীক্ষার্থীদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করেন। উল্লেখ্য প্রাইভেটে এম.এ. পরীক্ষা দিয়ে মুনীর চৌধুরী সে বছর প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়েছিলেন। আলাউদ্দিন আল আজাদ বৈদেশিক বৃত্তি নিয়ে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পি.এইচ.ডি. ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৭০ সালে। তাঁর অভিসন্দর্ভ ছিল * A study of life and short poems of Iswarchandra Gupta”। এছাড়া তিনি ১৯৮৩ সালে অরগান বিশ্ববিদ্যালয় হতে তুলনামূলক সাহিত্যে উচ্চ প্রশিক্ষণও গ্রহণ করেন।
আলাউদ্দিন আল আজাদ অধ্যয়নকালীন সময়ে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গেও সরাসরি সংশ্লিষ্ট ছিলেন। দেশ বিভাগের পরবর্তীকালে দেশের চলমান প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মী ছিলেন। তিনি ঢাকা ইন্টার কলেজ ছাত্র সংসদের সাহিত্য সম্পাদক ও বার্ষিকী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন ১৯৪৭-৪৯ পর্যন্ত এছাড়া জেনারেল সেক্রেটারি ছিলেন সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ইউনিয়নের (১৯৫৩-১৯৫৪)।
এরপর ঢাকা জেলা যুবলীগ সভাপতি ও সহ সভাপতি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের (১৯৫৭-৬০)। বাংলাদেশ শান্তি পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন। শান্তি পরিষদের সদস্য হিসেবে কলকাতায় অনুষ্ঠিত শান্তি সম্মেলনে যোগ দিতে গিয়ে তিনি কিছুদিনের জন্য কারাবরণ করেন। পাকিস্তানের প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততা তাঁর সাহিত্য চর্চায় প্রভাব বিস্তার করেছে।
আলাউদ্দিন আল আজাদের কর্মজীবন বৈচিত্র্যময়। জীবিকার প্রয়োজনে ছাত্রাবস্থায় তিনি সংবাদ পত্রে খণ্ডকালীন চাকুরি করেছেন। অধ্যয়ন শেষে তিনি পরিপূর্ণভাবে কর্মময় জীবন শুরু করেন অধ্যাপনার মধ্য দিয়ে। তিনি নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজ (১৯৫৫), ঢাকা জগন্নাথ কলেজ (১৯৫৬- ৬১), সিলেট এম সি কলেজ (১৯৬২-৬৮), চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে (১৯৬৪- ৬৭) অধ্যাপনা করেন।
তিনি ঢাকা কলেজে প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেন ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত। মস্কোতে বাংলাদেশ দূতাবাসে ছিলেন ১৯৭৬ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি উপদেষ্টার দায়িত্বে ছিলেন ১৯৮২ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত। তাঁর কর্মজীবনের শেষ পদটি ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন ১৯৮৯ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত। এছাড়া তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নজরুল প্রফেসর ও নজরুল গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালকের দায়িত্বে নিযুক্ত থাকেন ১৯৯০ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত।

আলাউদ্দিন আল আজাদ নিরলসভাবে সাহিত্য চর্চা করেছেন। অজস্র সৃজনীসম্ভার নিয়ে তিনি বাংলাদেশের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। এর প্রতিদানে তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতিস্বরূপ নানা পুরস্কার পেয়েছেন। বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৪), ইউনেস্কো পুরস্কার (১৯৬৪), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৭১), আবুল কালাম শামসুদ্দিন সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৩), আবুল মনসুর আহমদ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪), লেখিকা সংঘ পুরস্কার (১৯৮৪), একুশে পদক (১৯৮৬), শেরে বাংলা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৭), পূরবী পদক (১৯৮৯), লোক ফোরাম স্বর্ণপদক (১৯৯০), দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ স্বর্ণপদক (১৯৯৪), ম্যান অব দি ইয়ার বায়ো গ্রাফিক্যাল ইনস্টিটিউট যুক্তরাষ্ট্র (১৯৯১), প্রভৃতি সম্মানজনক পুরস্কারে ভূষিত হন।
আলাউদ্দিন আল আজাদের সাহিত্য জীবন ও ছোটগল্প রচনার পটভূমি বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান কথা সাহিত্যিক আলাউদ্দিন আল আজাদ। প্রগতিশীল, মানবমুখী ভাবধারায় তিনি নিরলসভাবে লিখেছেন। যে সকল সৃজনশীল ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের সাহিত্যকে পরিপুষ্ট করেছেন, তাঁদের মধ্যে তিনি অন্যতম।
বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকে তিনি সাহিত্যক্ষেত্রে আবির্ভূত হন। গত পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে তিনি সাহিত্যচর্চা করে বাংলাদেশের সাহিত্য ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। ছোটগল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, কবিতা, নাটক ও শিশুতোষ রচনাসহ সাহিত্যের নানা শাখায় তাঁর উজ্জ্বল উপস্থিতি। মেধা ও মননশীলতায় একজন শিল্পীর নান্দনিক মনস্তত্ত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে সময় ও সমাজ পালন করে মুখ্য ভূমিকা।
আলাউদ্দিন আল আজাদ পূর্ববাংলার এক প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কলকাতার নানা পত্রিকায় লেখা পাঠাতেন। তাঁর সাহিত্যচর্চায় হাতে খড়ি মাত্র তেরো বছর বয়সে। এ সময়ের লেখা মূলত কিশোর বয়সের কচিবোধ থেকে। তাঁর প্রথম মুদ্রিত রচনা ‘নিমন্ত্রণ’। এটি ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় ছোটদের পাততাড়ি বিভাগে ছাপা হয়।
১৯৪৩ সালে তেরশ পঞ্চাশ সালের দুর্ভিক্ষের পরে গ্রামের নবান্ন উৎসবে যোগদানের জন্য পরিচালক স্বপন বুড়োকে লেখা একটি চিঠির অংশ বিশেষ। সাহিত্যের প্রতি অপরিসীম অনুরাগ থেকে প্রথম লিখেছেন ‘আবেগ’ নামে একটি প্রবন্ধ। তাঁর রচিত প্রথম সাহিত্যিক রচনা ‘আবেগ’ কলকাতার প্রখ্যাত ‘মাসিক সওগাত’ পত্রিকায় ১৩৫৩ বঙ্গাব্দে শ্রাবণ মাসে প্রকাশিত হয়।
আলাউদ্দিন আল আজাদের লেখা প্রথম ছোট গল্পের নাম হল ‘জানোয়ার’। ১৩৫৩ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে ‘মাসিক সওগাত’ পত্রিকায় ছাপা হয়। এই গল্পের কাহিনী গ্রামের এক কৃষক ও তার পুত্রকে ঘিরে। বছরের শুরুতে নতুন বই কিনে দিতে অপারগ বাবা পুত্রকে মারধোর করে। অবশেষে পুত্রটি মারা গেলে বাবা পুত্রশোকে উন্মাদ হয়ে যায়। তাঁর কচিহাতের লেখা দুটি সাহিত্যবোদ্ধাদের দৃষ্টি কাড়ে।
সমকালের বিশিষ্ট কথা সাহিত্যিক শামসুদ্দীন আবুল কালাম ‘জানোয়ার’ গল্পটি পড়ে মুগ্ধ হন এবং প্রশংসা করে লিখেছেন, “লেখা ছাড়বেন না; আপনার গল্পে যে অভিজ্ঞতা, শক্তি ও সম্ভাবনা লক্ষ্য করেছি, তাতে আমাদের সাহিত্য ভবিষ্যতে বিপুল সমৃদ্ধি লাভ করবে তাতে আমি নিঃসন্দেহ”।”
আলাউদ্দিন আল আজাদ কিশোর বয়সে বিশ্বসাহিত্যের খ্যাতিমান লেখকদের রচনার সঙ্গে পরিচিত হন। গ্রামের ক্লাবের লাইব্রেরি থেকে পাঠ করেন নানা বিখ্যাত গ্রন্থ। নান্দনিক মনোগঠন ও শৈল্পিক প্রেরণা যেসব গ্রন্থ থেকে পেয়েছেন তার মধ্যে অন্যতম হল ‘ঠাকুরমার ঝুলি’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গল্পগুচ্ছ’, মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’ এবং রুশ গল্পকার ম্যাক্সিম গোর্কির ছোটগল্প।
গোর্কির ছোটগল্পের শ্রেণীচেতনা তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এই বিপ্লবী লেখকের রচনা আলাউদ্দিন আল আজাদের চেতনাকে আন্দোলিত করে। এ কারণে তিনি নিজেই বলেছেন “হঠাৎ করে, হ্যাঁ হঠাৎ করেই বলবো, গোর্কির ছোটগল্প আমার চোখের সামনে এক আলাদা দুনিয়ার দরোজা খুলে দিল” গ্রামের স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাশ করার পর আলাউদ্দিন আল আজাদ ঢাকা শহরে পাড়ি জমান। আধুনিক নাগরিক জীবন ও রুচিবোধের সঙ্গে তাঁর পরিচিতি ঘটে।
উচ্চ মাধ্যমিক পড়াশোনা করেন ঢাকা শহরে। এ সময়ে ঢাকা ও কলকাতার নানা পত্র পত্রিকায় তাঁর প্রবন্ধ, গল্প, কবিতা প্রকাশিত হয়। বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য নতুন প্রতিভা শক্তি নিয়ে আবির্ভূত হন। সে সময়ে প্রকাশিত কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কবিতা ‘প্রত্যাবর্তন’, ‘চোখ’, ‘একটি রাতের চোখ’, ‘বৌদির জন্য কবিতা’, ‘হাসি’, প্রভৃতি। ‘চাকা’ নামের বিখ্যাত ছোটগল্পটি ‘রাঙাপ্রভাত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
তাঁর সাহিত্যচর্চার এই প্রাথমিক পর্যায়ে প্রবন্ধের সংখ্যাই বেশি। গদ্যের প্রতি আদি অনুরাগের কারণে লিখেছেন নানা প্রবন্ধ। মেধা ও মননের প্রকৃষ্ট চর্চার স্থল প্রবন্ধে তাঁর অকৈশোরের জীবনবোধ, বিশ্বাস ও মর্মচৈতন্যের প্রকাশ ঘটেছে। আলাউদ্দিন আল আজাদের সমসাময়িক খ্যাতিমান কবি হাসান হাফিজুর রহমান, কথাশিল্পী আব্দুল গাফফার চৌধুরী প্রমুখ শিল্পীর লেখাও তখন নানা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতো।
পঞ্চাশের দশকে আলাউদ্দিন আল আজাদ একজন তরুণ প্রতিশ্রুতিশীল লেখক হিসেবে আবির্ভূত হন। এ দশকে প্রকাশিত গল্প গ্রন্থগুলো হল ‘জেগে আছি’ (১৯৫০), ধানকন্যা (১৯৫১) ও মৃগনাভি’ (১৯৫৩)। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘জেগে আছি’। এই গ্রন্থ প্রকাশের এক ইতিহাস রয়েছে। বন্ধুদের সহযোগিতায় নিজেই গ্রন্থটি প্রকাশের উদ্যোগ নেন। আর্থিক অসঙ্গতির কারণে থেমে থাকেনি তাঁর গ্রন্থ প্রকাশের বাসনা।
“বন্ধু আব্দুল হান্নানের মায়ের কাছ থেকে ৮০ টাকা কর্জ নিলেন, পাণ্ডুলিপি প্রেসে দিলেন। প্রচ্ছদ করেন এখনকার প্রখ্যাত শিল্পী তখনকার ঢাকা ইন্টার ও পরে ঢাকা আর্ট স্কুলের ছাত্র আমিনুল ইসলাম। ছবিটা ছিল লাল ইটের দেয়ালে সাটানো একটি পোস্টার, লেখা জেগে আছি। ইটের দেয়ালটা আমিনুল কাঠ খোদাই করে দিয়েছিলেন। মাঝের লেখাটার জন্য সীসার ব্লক করাতে হয়েছিল।
MS – এই প্রথম গল্পগ্রন্থটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চাশের দশকের তরুণ গল্পকার হিসেবে তাঁর নাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি প্রতিবাদী চেতনায় গল্প লিখে চমক সৃষ্টি করে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিলেন। গ্রামীণ পটভূমিতে যেমন কৃষক জনতার প্রতিরোধ মহাজনদের বিরুদ্ধে তেমনি শহরের পটে সামরিক শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে।
এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য গল্পগুলো হল ‘মহামুহূর্ত’, শিষ ফোটার গান’, ‘একটি সভ্যতা’, কয়লা কুড়ানো দল’, ‘অসমাপ্ত’, ‘মোচড়’ ‘চেহারা’ প্রভৃতি। পঞ্চাশের দশকের গল্প বিষয়বৈচিত্র্যে অনন্য। দেশ বিভাগ, দাঙ্গা, মন্বন্তর প্রভৃতি ঘটনাকে নিয়ে লিখেছেন ‘চুরি’, ‘একটি কথার জন্ম’ ও ‘রোগ মুক্তির ইতিবৃত্ত’ প্রভৃতি। বিষয় ও শৈলীতে তাঁর এ দশকের গল্পগুলোকে স্বর্ণযুগ ও সমৃদ্ধির কাল হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র ও ধলেশ্বরী বিধৌত বিশাল জনপদের বিচিত্র সব মানুষের জীবনধারা তাঁর গল্পে রয়েছে।
আলাউদ্দিন আল আজাদ পঞ্চাশের দশকে গল্পরচনায় যে সময় ও সমাজকে ধারণ করেছেন তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এ পর্বে গ্রাম বাংলার মানুষের বাস্তব সমস্যা, শোষণ বঞ্চনা, শ্রেণীবৈষম্য, বিশ্বাসবোধ প্রভৃতি স্থান পায়। কৃষকশ্রেণীর প্রতিবাদ ও বিদ্রোহ গল্পের মূল উপজীব্য হয়ে দাঁড়ায়। হিন্দু- মুসলমান নির্বিশেষে পল্লীর কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষ সামন্ততান্ত্রিক ও মহাজনী শোষণে জর্জরিত ছিল।

গ্রাম-গঞ্জে কৃষি কাঠামোর মধ্যে নিরীহ কৃষককুল শোষকদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। লেখকের প্রত্যক্ষলব্ধ জীবনবোধ ও মানুষ সম্পর্কে তাঁর ভাবনা গল্পে প্রাধান্য পেয়েছে। পঞ্চাশের দশকে দেশীয় ও আন্ত- জাতিক নানা ঘটনা আলোড়িত করেছে সর্বমহলকে। ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত চলা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ক্ষয়, ধ্বংসলীলা, এর ফলে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ, ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত-পাকিস্তানের জন্ম, এরই প্রভাবজাত দাঙ্গা ও মানবিক সংকটময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে তিনি শৈশব ও কৈশোর অতিক্রম করেন।
১৯৪৭ সাল ভারতীয় উপমহাদেশের জন্য অতি তাৎপর্যপূর্ণ। ধর্মের ভিত্তিতে জন্ম নেয় ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র। দেশবিভাগ এ দুদেশের সমাজকে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দেয়। বাসস্থান ও খাদ্যের অভাবে উদ্বাস্তুদের মধ্যে দেখা দেয় চরম হতাশা। আলাউদ্দিন আল আজাদের পঞ্চাশের দশকের গল্পে এই মানবিক সংকট শিল্পরূপ লাভ করে। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে আলাউদ্দিন আল আজাদের পূর্বে যে সকল শিল্পীর / আগমন ঘটেছে তাঁদের দ্বারা তিনি অনেকটা প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত হয়েছেন।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ফলে সৃষ্ট মানবিক অবক্ষয়, পঞ্চাশের মন্বন্তর, পাকিস্তান আন্দোলন, রাজনৈতিক চালবাজি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং দেশ বিভাগ প্রভৃতি নিয়ে যে সকল শিল্পী লিখেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৭৯), আবুল ফজল (১৯০৩-৮৩), আবুল কালাম শামসুদ্দীন (১৮৯৭), আবু রুশদ (১৯১৯) সিকান্দার আবু জাফর (১৯১৯-১৯৭৫), শামসুদ্দীন আবুল কালাম (১৯২৬-৯৮) সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ (১৯২২-১৯৭১), শওকত ওসমান (১৯১৭-১৯৯৮) আবু জাফর শামসুদ্দীন (১৯১১-১৯৮৮) প্রমুখ।
এসব লেখকদের অনেকেই গ্রামীণ জীবন থেকে শিল্পের উপকরণ সংগ্রহ করেছেন। শামসুদ্দীন আবুল কালামের গল্পে গরীব নিম্নবিত্ত মানুষের প্রাত্যহিক জীবন ঠাঁই পেয়েছে। প্রগতিশীল সমাজভাবনা ও সংস্কারমুক্ত জীবনপ্রত্যয় নিয়ে লিখেছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ও আবু জাফর শামসুদ্দিন।
শিল্পীর শিল্পী হয়ে উঠার আগে যেমন তাঁর সঙ্গে সমাজের একটি সম্পর্ক থাকে, তেমনি শিল্পী হয়ে ওঠার পরেও তাঁর সঙ্গে সমাজের একটি নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হয়। আলাউদ্দিন আল আজাদও এর ব্যতিক্রমী কোনো শিল্পী নন। ১৯৪৭ সাল থেকে তিনি ঢাকা শহরে বসবাস করেন। পূর্ব পাকিস্তানের সকল কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা মহানগরীর এক সংগ্রামমুখর পরিস্থিতির মুখোমুখি তিনি দাঁড়ান।
নব্য স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তানে পূর্ব পাকিস্তানকে যেন নব উপনিবেশ ছাড়া আর কিছুই এখানকার অধিবাসীদের কাছে মনে হল না। যে আশা-আকাঙক্ষা নিয়ে এদেশের মানুষ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিল, তার প্রতিফলন ঘটে নি। পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের বাকস্বাধীনতা, অর্থনৈতিক মুক্তি ও সাংস্কৃতিক বিকাশের পথ রুদ্ধ হল। এ সময় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে অভিন্ন রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে সরকারের আসল রূপ প্রকাশ পায়।
১৯৪৮ সালে বাংলাকে উপেক্ষা করে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণায় স্তম্ভিত হয় বাংলা ভাষাভাষী। কেননা পাকিস্তানের ৫৬% ভাগ মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। ফলে প্রতিবাদ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এদেশের সচেতন মহল। রাষ্ট্রভাষার দাবিতে শুরু হয় নানা কর্মসূচি, নানা পরিকল্পনা, জন্ম নেয় নানা সংগঠন। বুদ্ধিজীবী সচেতন শ্রেণীর মধ্যেও ভাষার প্রশ্নে মেরুকরণ ঘটল।
এক পক্ষের আদর্শ হয়ে দাঁড়ায় মুসলমান, পাকিস্তান ও উর্দুভাষা। অপরপক্ষ মাতৃভাষা বাংলা ও বাঙালির চেতনায় উদ্দীপিত। এরূপ পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রযন্ত্র নানা ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। বেছে নেয় নানা দমন-পীড়ন ও নির্যাতনের পথ। আলাউদ্দিন আল আজাদ পঞ্চাশের দশকের গল্পে এই উত্তাল সময় স্থান করে নিয়েছে। মূলত ভাষার দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
তিনি তখন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের মেধাবী ছাত্র। একই সঙ্গে বামপন্থী প্রগতিশীল রাজনীতির সক্রিয় কর্মী ও সংগ্রামী মিছিলের অগ্রনায়ক। তখন সোভিয়েত রাশিয়ার সমাজতন্ত্র দ্বারা এদেশের অনেক তরুণ উদ্বুদ্ধ হন। রুশ বিপ্লবের চেতনা বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগিয়ে তোলে । এ সময় পর্বে আলাউদ্দিন আল আজাদ বিশ্বসাহিত্যের বিপ্লবী মনীষীদের তাত্ত্বিক গ্রন্থাবলির প্রতি অনুরক্ত হয়ে সমাজবাদী আদর্শকে গ্রহণ করেন।
মূলত এই চেতনা পাকিস্তান রাষ্ট্রের পরিপন্থী ছিল। তাঁর সময়ে আরেক সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব মুনীর চৌধুরীও (১৯২৫-৭১) সরাসরি ভাষা আন্দোলন ও বামপন্থী রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, আধা ঔপনিবেশিক আধা সামন্ততান্ত্রিক পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে পূর্ব পাকিস্তানে প্রগতিশীল নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জাগরণ ঘটে। ১৯৫২ সালে সংঘটিত হয় ইতিহাস সৃষ্টিকারী ভাষা আন্দোলন।
এদেশের মানুষের দাবির মুখে মাতৃভাষা বাংলা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করে। আমাদের রাজনীতি এবং সমাজ-সংস্কৃতির অন্তর্ভুবনে ভাষা আন্দোলন সঞ্চার করেছে স্বাধিকারপ্রত্যাশী চৈতন্য। তখন পাকিস্তানি শাসকবর্গের শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে এই এলাকার বহুস্থানে সরকার পক্ষের সঙ্গে শ্রমিক-কৃষকদের সংঘর্ষ হয়। দিনে দিনে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়তে থাকে।
এই ভূখণ্ডের দীর্ঘ রাজনৈতিক ও সামাজিক ইতিহাসের মধ্যে শিল্পী আলাউদ্দিন আল আজাদ বেড়ে ওঠেন। তিনি অবলোকিত জীবনের রূপায়ণ করেছেন তাঁর সাহিত্যে। এ সময়ে রচিত তাঁর গল্প ও কবিতার জীবন জিজ্ঞাসা ব্যাপকভাবে পাঠক সমাদৃত হয় ভাষা আন্দোলনের কালে তাঁর মতো অনেক শিল্পীর চৈতন্যের মর্মে জিজ্ঞাসার উদয় হয়। ভাষার লড়াই বাঙালির দেশজ সংস্কৃতিবোধের জাগরণ ও বিকাশ ঘটায়।
এই ধারায় নতুন কালে অনেক শিল্পীর জন্ম হয়। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন সরদার জয়েনউদ্দীন (১৯১৮-৮৬) মিরজা আব্দুল হাই (১৯১৯-৮৪), শাহেদ আলী (১৯২৫) আৰু ইসহাক (১৯২৬), আশরাফ সিদ্দিকী (১৯২৭), শহীদ সাবের (১৯৩০), আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী (১৯৩১), শহীদুল্লাহ কায়সার (মৃত্যু ১৯৭১), হাসান হাফিজুর রহমান (১৯৩২-৮৩), মুনীর চৌধুরী (১৯২৫-৭১), জহির রায়হান (১৯৩৩-৭২), সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫-), বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর (১৯৩৬) প্রমুখ।
আলাউদ্দিন আল আজাদ ষাটের দশকেও ছোটগল্পকার হিসেবে খ্যাতির শীর্ষে ছিলেন।
এ দশকে তাঁর সমাজসচেতন দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে মানব মনের অন্তর্বিশ্লেষণ যা প্রধানত ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব দ্বারা প্রভাবিত। এ পর্বে তিনি ছোটগল্পে নর-নারীর পারস্পরিক কামনা বাসনার বিচিত্র দিক বিশ্লেষণে অধিক মনোযোগী। এ ধারার উল্লেখযোগ্য ছোটগল্পগ্রন্থগুলো হল ‘অন্ধকার সিঁড়ি’ (১৯৫৮), ‘উজান তরঙ্গে’ (১৯৫৯), ‘যখন সৈকত’ (১৯৬৭) প্রভৃতি।

ষাটের দশক নানা কারণে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। উক্ত সময়পর্বে আলাউদ্দিন আল আজাদ অনেকাংশে গহনচারী শিল্পী এ দশকে ব্যাপকভাবে ঘটে রাষ্ট্রযন্ত্রের নানা ষড়যন্ত্র। জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন ঘটনার সাক্ষ্য ষাটের দশক। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন এবং ১৯৫৮ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের ষড়যন্ত্রে যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভার পতন হয়। ফলে সামরিক জান্তা আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে নেয়।
এ সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন, তাঁরা একটি চাপের মধ্যে অবস্থান করলেন। আলাউদ্দিন আল আজাদ লেখাপড়া শেষ করে কলেজে চাকুরি নেন । ১৯৫৫ সাল থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি তোলারাম, জগন্নাথ ও চট্টগ্রাম কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৬১ সালে তিনি স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন করে কারারুদ্ধ হন। এই মর্মে মুচলেকায় ছাড়া পান যে, তিনি বামপন্থী রাজনীতি করবেন না এবং সরকার বিরোধী কোন আন্দোলনে যোগ দেবেন না।
প্রখ্যাত নাট্যকার মুনীর চৌধুরীও একই ভাবে জেল থেকে ছাড়া পান। তৎকালীন পরিস্থিতির কারণে আলাউদ্দিন আল আজাদ বিপ্লবী চেতনা থেকে সরে আসেন। এ পর্যায়ে তিনি মানুষের অন্তঃঅসঙ্গতি সন্ধানে ফ্রয়েডীয় মনোবিকলন ও লিবিডো ধারণায় আকৃষ্ট হলেন। এ সময়ে প্রকাশিত তাঁর উপন্যাস ‘তেইশ নম্বর তৈলচিত্র (১৯৬০) ও ‘কর্ণফুলী’ (১৯৬২) ব্যাপক সাড়া জাগিয়ে তোলে। ষাটের দশকে আলাউদ্দিন আল আজাদ জীবনঘনিষ্ঠ বেশ কিছু নাটক লিখেছেন। ‘মরক্কোর যাদুকর’ (১৯৫৯), ‘মায়াবী প্রহর’ (১৯৬৩) ও ‘ধন্যবাদ’ প্রভৃতি নাটক তখন ডাকসুসহ দেশের বিভিন্ন কলেজের সাংস্কৃতিক উৎসবে মঞ্চস্থ হত।
সত্তরের দশক ও তার পরবর্তীকালে আলাউদ্দিন আল আজাদ সাহিত্য ক্ষেত্রে পূর্বের ন্যায় সক্রিয়। সত্তরের দশকে ছোটগল্প শিল্পী হিসেবে আলাউদ্দিন আল আজাদ অনেকটা উজ্জীবিত। এ পর্যায়ে রচিত গল্পে নতুন করে প্রতিবাদী ও প্রতিরোধী চেহারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে । স্বাধীনতার স্বপ্ন ও মানবিকবোধের তীব্রতা এ সময়ের গল্পের মূল প্রসঙ্গ। এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায় ‘রূপান্তর’ ও ‘নীরবতা’ দুটি গল্পের নাম।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে প্রকাশিত তাঁর গল্পগ্রন্থগুলো হল “আমার রক্ত, স্বপ্ন আমার’ (১৯৭৫), ‘জীবন জমিন’ (১৯৮৮) প্রভৃতি। পরবর্তী কালে তাঁর গল্পের কয়েকটি সংকলন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। যেমন ‘নির্বাচিত ‘গল্প’ (১৯৮৫), শ্রেষ্ঠগল্প’ (১৯৮৭), ‘মনোনীত গল্প’ (১৯৮৫)। নব্বইয়ের দশকে আলাউদ্দিন আল আজাদ উপন্যাস ও কবিতা রচনায় সক্রিয় কিন্তু ছোটগল্পে নিষ্প্রভ। সময়ের আবর্তনে নানা সংগ্রাম ও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ সত্তর ও আশির দশক অতিক্রম করে।
১৯৬৬ সালের ছয়দফা কর্মসূচি, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন প্রভৃতি ঘটনায় পূর্ব পাকিস্তানে বিরাজ করে উত্তাল পরিস্থিতি। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করেও ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে যাওয়ার পূর্বেই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে পূর্ব বাংলার নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার প্রতিশ্রুতি ফাঁকা বুলিতে পরিণত হয়।
২৫শে মার্চ ঢাকার নিরীহ জনসাধারণকে পাক বাহিনী নির্বিচারে হত্যা করে। ২৬শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে ও দুই লক্ষ মা- বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে এদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। আলাউদ্দিন আল আজাদ মুক্তিযুদ্ধের পূর্বে অর্থাৎ ১৯৬৭ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত লন্ডনে অবস্থান করেন পি.এইচ.ডি-র জন্য। স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন।
মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথা নিয়ে লিখেছেন প্রবন্ধ-নিবন্ধ, কবিতা, গল্প ও উপন্যাস। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭২ সালে আলাউদ্দিন আল আজাদ সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে দেশে ও বিদেশে কর্মে নিযুক্ত হন। আশির দশকে ও পরবর্তীকালে তাঁর রচিত ছোটগল্পে নাগরিক জীবনের সংকট, মধ্যবিত্তের সংগ্রাম, উচ্চবিত্তের বিলাসী জীবন প্রভৃতি আধুনিক মানুষের জীবনযন্ত্রণা মুখ্য হয়েছে।
আলাউদ্দিন আল আজাদের পরবর্তীকালের শিল্পীদের মধ্যে যারা মুক্তিযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, সমাজের বিভেদ, নারী নির্যাতন, নাগরিক জীবনের গলদ, গ্রামীণ সমাজের চিত্র মুক্তচিন্তার আলোকে সার্থকতার সঙ্গে কথা সাহিত্যে তুলে ধরেছেন তাঁরা হলেন আহমদ রফিক (১৯২৯), শওকত আলী (১৯৩৬), বশীর আল হেলাল (১৯৩৬), হাসান আজিজুল হক (১৯৩৯), রিজিয়া রহমান (১৯৩৯), রাহাত খান (১৯৪০), বুলবন ওসমান (১৯৪০), রশীদ হায়দার (১৯৪১), আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (১৯৪৩-৯৮), আহমদ ছফা (১৯৪৩), আবুল মান্নান সৈয়দ (১৯৪৩), সেলিনা হোসেন (১৯৪৭), হুমায়ুন আহমদ প্রমুখ।
বাংলা কথাসাহিত্যের খ্যাতিমান লেখক আলাউদ্দিন আল আজাদ । তাঁর বিপ্লবী জীবনদৃষ্টি সংগ্রামী মানুষের মধ্যে এক সময় আশার বাণী জাগিয়েছিল। পঞ্চাশের দশকে গণমুখী সাহিত্যচর্চায় তিনি অবিস্মরণীয় শিল্পী, ষাটের দশকে মনোগহনের রূপকার আর সত্তরের দশকে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় স্মৃতি রচনায় তিনি উৎফুল্ল। সর্বোপরি মানুষ ও মানুষের সমাজই তাঁর সৃষ্টির প্রেরণা। তাঁর জীবন ও সাহিত্যকর্ম একই সুতায় বাঁধা। এ প্রসঙ্গে শিল্পীর নিজের দেওয়া বক্তব্য উল্লেখযোগ্য।
“ছোটবেলা থেকেই আমার জীবন ও সাহিত্য অবিচ্ছেদ্য। সতেরো বছর বয়সে প্রকাশিত আমার প্রথম গল্পগুচ্ছ ‘জেগে আছি’র গল্পগুলোতে যে শ্রেণীযুদ্ধের প্রতিচ্ছবি তারও একই কারণ, আমার সাহিত্য আমার অভিজ্ঞতা ও আত্মচরিত”। ”
গ্রাম বাংলার বিশাল জনপদ, নদীবাহিত সমতল ভূমি, পাহাড়ী জনপদ, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত সকল শ্রেণীর সুখ-দুঃখ, ব্যথা বেদনা, বিশ্বাস আলাউদ্দিন আল আজাদ রূপায়ণ করেছেন। তাঁর সাহিত্যভাবনা মানবতা ও প্রগতিশীলতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে আবদ্ধ। তাঁর সাহিত্যচিন্তার মূল্যায়ন প্রসঙ্গে অধ্যাপক আহমদ কবিরের মন্তব্য এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।
“ভাষা আন্দোলনের গণমুখী ও স্বদেশপ্রেমী সাহিত্যধারার লেখক তিনি । বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ তাকে প্রেরণাদীপ্ত দায়িত্ববান শিল্পীর ভূমিকা গ্রহণে উজ্জীবিত করেছে। তাঁর আদর্শবোধ ও প্রগতিশীলতা তাকে এক সময় পৌঁছে দিয়েছিল সেই অবস্থানে যেখান থেকে একদিকে তিনি ভবিষ্যতের সমাজ গড়ার প্রত্যয় খুঁজে পান, অন্যদিকে মানুষের মনোলোকের গহীন রহস্যে বিশেষ প্রণোদনা অনুভব করেন। লিবিডো বা জৈবিক কামনার মানবিক দীক্ষাও তাঁর কৌতূহলের বিষয়। সবকিছু মিলিয়ে মানুষ ও মানুষের সমাজ ও সম্পর্ক তাঁর সাহিত্য ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু।