সৈয়দ শামসুল হকের গণনায়কের শৈলিবিচার

গণনায়কের শৈলিবিচার রচনাটি সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যনাটক : ইতিহাস, সমাজ, রাজনীতি ও শিল্প [পিএইচডি অভিসন্দর্ভ] এর অংশ। গবেষনাটির অথোর জান্নাত আরাসোহেলী। এই অভিসন্দর্ভের (পিএইচডি) বিষয় বাংলা নাটক – ইতিহাস ও সমালোচনা। প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষাবর্ষ: ২০১৭-২০১৮। গবেষণাকর্মটি সাহিত্যের শিক্ষার্থীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় আমরা সাহিত্য গুরুকুলে পুন-প্রকাশ করলাম।

 

গণনায়কের শৈলিবিচার

 

গণনায়কের শৈলিবিচার

উইলিয়াম শেকসপিয়রের জুলিয়াস সিজার নাটকের ছায়াবলম্বনে রচিত গণনায়ক নাটকটি শিল্পবিচারে সৈয়দ শামসুল হকের অন্যতম নান্দনিক সৃষ্টিকর্ম। জুলিয়াস সিজার নাটকটি মূলত ট্রাজেডি নাটক; যেখানে বিপুল মানুষের সমর্থন, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা সত্ত্বেও প্রশাসনের কতিপয় দুস্কৃতকারী, ক্ষমতালোভী সিনেটরদের হাতে নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয় রাষ্ট্রপ্রধান জুলিয়াস সিজারকে। কিন্তু সৈয়দ শামসুল হক রচিত গণনায়কে উপস্থাপিত হয়েছে শেকসপিয়রের নাটকের অনুরূপ চরিত্র রাষ্ট্রপ্রধান ওসমানের করুণ মৃত্যু।

একটি সার্থক এবং বহুল পরিচিত ট্রাজেডি নাটককে আধুনিক কাব্যনাটকের বৈশিষ্ট্যে রূপান্তর করতে স্বভাবতই নাট্যকারকে কিছু বিন্যাসগত পরিবর্তন, পরিমার্জন করতে হয়েছে। যেমন: শেকপিয়রের নাটকটি পঞ্চাঙ্কের; যেখানে প্রথম চারটি অঙ্কে তিনটি করে দৃশ্য রয়েছে, এবং শেষ অঙ্কে চারটি দৃশ্য বিদ্যমান। অপরদিকে গণনায়ক নাটকে নাট্যকার পঞ্চাঙ্কের মূল সংগঠন ঠিক রাখলেও দৃশ্যবিভাজনে ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছেন।

বস্তুত ভিনদেশি কাহিনিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় ঢেলে সাজিয়ে, ট্রাজেডি নাটকের ফর্ম ভেঙে, চরিত্রের বিকাশ ও পরিণতির প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের মাধ্যমে সৈয়দ হক একটি মৌলিক নাটকই রচনা করেছেন। নাট্যকার অবশ্য নাটকে শেকপিয়রের প্রভাব সবসময় স্বীকার করেছেন। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন :

অনুবাদ কী রকম আমি তোমাকে বলি, একজন মেকানিক যখন একটি ঘড়ির সব যন্ত্রপাতি খুলে টেবিলের ওপর ছড়িয়ে রাখে, পরে আবার তা জোড়া দিয়ে একটি ঘড়ি তৈরি করে, অনুবাদ ঠিক তাই। একটা লেখার যন্ত্রাংশ সব খুলে সাজিয়ে রাখতে হয়, পরে আবার তা জোড়া দিয়ে একটি লেখা তৈরি করতে হয় অনুবাদের মাধ্যমে। এটা করতে গিয়ে আই লার্নট এ লট এবাউট টেকনিক, অব প্রেজেন্টিং […] অল স্টেজ । তিনি তো চার শ’ বছর আগে গত হয়েছেন, মাটির সঙ্গে মিশে গেছেন, কিন্তু আমার শিক্ষক হিসেবে আমার কাঁধের ঠিক পিছনে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন। কাজেই সেটার প্রভাব পড়ল। ‘

জুলিয়াস সিজার এবং গণনায়ক নাটকের তুলনামূলক আলোচনার মাধ্যমে সৈয়দ শামসুল হকের রচনার নতুনত্ব, অভিনবত্ব উপলব্ধি করা যেতে পারে। উল্লেখ্য, নিম্নে উইলিয়াম শেকসপিয়রের জুলিয়াস সিজার এবং সৈয়দ শামসুল হকের গণনায়ক নাটকের তুলনামূলক একটি আলোচনা উপস্থাপনের মাধ্যমে উভয় রচনার মৌলপার্থক্য, চরিত্রায়ণ কৌশল, প্লট, আঙ্গিকগত পার্থক্য উপস্থাপন করা হলো:

জুলিয়াস সিজারের প্রথম অঙ্ক, প্রথম দৃশ্যটি আবর্তিত হয়েছে ফ্লোরিয়াস ও মেরুলাস নামক দুজন নগরপাল এবং বিভিন্ন পেশার কয়েকজন শ্রমজীবী নাগরিককে নিয়ে। অন্যদিকে গণনায়কের প্রথম দৃশ্যে পাত্রপাত্রী দুজন

– স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সিকান্দার ও তথ্যমন্ত্রী মির্জা। এখানে অবশ্য উল্লসিত জনতার উপস্থিতি আছে, কিন্তু সেটি জুলিয়াস সিজার নাটকের শ্রমী চরিত্রগুলোর মতো সক্রিয় অংশগ্রহণকারী নয়। অর্থাৎ জুলিয়াস সিজারে চরিত্রগুলো অন্যচরিত্রের সঙ্গে যেখানে সরাসরি কথোপকথনে অংশগ্রহণ করেছে, গণনায়কে সেখানে জনতার কর্মকাণ্ড উপস্থাপিত হয়েছে তথ্যমন্ত্রী মির্জা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সিকান্দারের আক্ষেপ-মিশ্রিত কথোপকথনে।

স্থানের ক্ষেত্রেও দুটি নাটকে পার্থক্য রয়েছে এখানে। জুলিয়াস সিজারের প্রথম দৃশ্যের ঘটনাস্থান রোম নগরীর একটি রাজপথ। অন্যদিকে গণনায়ক নাটকের প্রথম দৃশ্যের স্থান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সিকান্দারের দপ্তর ও একটি জানালা যেখান দিয়ে জনতা দেখা যায়। তবে বিষয়বস্তুর বিবেচনায় দুটি দৃশ্যের বিষয় একই।

লুপারক্যাস (রোমান নববর্ষ) উৎসবের দিনে শত শত জনতা ছুটে এসেছে সিজারকে এক নজর দেখার আশায়, আর গণনায়কে ‘বাংলার মুক্তি দিবসে’ হাজারো জনতা ছুটে এসেছে দেশবন্ধু ওসমানের গলায় মালা পরাতে। কিন্তু উভয় দৃশ্যেই রাজকর্মকর্তাদের নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা ও অবিশ্বাস সুস্পষ্ট।

জুলিয়াস সিজার নাটকে প্রথম অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যের ঘটনাস্থান হিসেবে দেখানো হয়েছে রোমের একটি খেলার মাঠ বা আমোদ- প্রমোদের জন্য খোলা উন্মুক্ত স্থান, যেখানে একটি মঞ্চ রয়েছে। কিন্তু গণনায়কে নাট্যকার ঘটনাটি আরও রসঘন করে তুলতে স্থান হিসেবে ব্যবহার করেছেন সরাসরি রাষ্ট্রপতি ওসমানের বাসভবনের বিশ্রাম-কক্ষকে ; যেখানে আগে থেকেই বসে আছেন প্রধানমন্ত্রী হুমায়ুন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সানাউল্লাহ।

 

গণনায়কের শৈলিবিচার

 

এ দৃশ্যের অনেকগুলো সংলাপেই লক্ষ করলে দেখা যায়, গণনায়ক এবং জুলিয়স সিজারের হুবহু সাদৃশ্য রয়েছে। যেমন জুলিয়াস সিজারে ব্রুটাসকে দেশপ্রেমের দোহাই দিয়ে রাষ্ট্রপ্রধান সিজারের বিরুদ্ধে উসকে দেয়ার চেষ্টা করছে প্রধান ষড়যন্ত্রকারী কেসিয়াস। তেমনি গণনায়ক নাটকে প্রধানমন্ত্রী হুমায়ুনকে দেশপ্রেম, গণতন্ত্র ও স্বেচ্ছাচারিতার প্রসঙ্গ তুলে রাষ্ট্রপতি ওসমানের বিরুদ্ধে সুকৌশলে উদ্দীপ্ত করে তুলেছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী সানাউল্লাহ। জুলিয়াস সিজার নাটকে ব্রুটাসের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে কেসিয়াসের উচ্চারণ :

কেসিয়াস। তাহলে, বন্ধু ব্রুটাস, শোনো –

যেহেতু তুমি নিজেকে দেখতে পাও না।

দর্পণে প্রতিবিম্বিত প্রতিচ্ছবির মতো স্পষ্ট করে,

আমিই হব তোমার দর্পণ,

দেখাব তোমাকে, যা তুমি দেখতে পাও না ।

কিন্তু, আমার প্রতি সন্দিগ্ধ হয়ো না যেন।

আমি যদি বোকার মতো হাসতাম,

অথবা নতুন নতুন বন্ধুর কাছে প্রতিদিন

প্রণয়-শপথ উচ্চারণ করতাম,

অথবা, গাঢ় বন্ধুত্বের পরেও রটাতাম কুৎসা তাদের নামে

অথবা, যাকে তাকে নেমন্তন্ন করে খানাপিনা

গালগল্প করতাম।

তাহলে ভাবতে পারতে, এ লোকটা কত না বিপজ্জনক ! (জুলিয়াস সীজার, পৃ- ১৫)

অন্যদিকে গণনায়ক নাটকে প্রধানমন্ত্রী হুমায়ুনের উদ্দেশ্যে প্রধান ষড়যন্ত্রকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী সানাউল্লাহর আত্মপক্ষ সমর্থন করে দেয়া বক্তব্য :

সানাউল্লাহ :

শুনুন তবে,

নিজেই যখন জানেন যে বিম্বিত না হলে নিজেকে

আপনি ঠিক দেখতে পান না, তাই আমি আপনার আয়না,

ফুটিয়ে তুলবো অবিকৃত আপনারই স্বরূপ, যা এখনো

আপনার অগোচরে। সন্দেহ করবেন না আমাকে ।

হতাম যদি কোনো পত্রিকার ভাড়াটে লেখক, , কিংবা

সংসদের এমন সদস্য যিনি নির্বাচনের আগে

যে দলের নৌকো উদ্দাম তাতেই গিয়ে চড়ে বসেছেন,

অথবা এমন কেউ যিনি বন্ধুত্বে মুখর, কিন্তু

পুলিশকে গোপনে তথ্য যোগাত সর্বার্থে, সংক্ষেপে

যদি আমাকে দেখে থাকেন এ সব ভণ্ডপীরের দঙ্গলে,

তাহলে, কেবল তাহলেই, বিষময় আমার সঙ্গ,

এই সিদ্ধান্ত করবেন। (কাব্যনাট্যসমগ্র: ২৩৯)

লক্ষ করলে দেখা যাবে যে, উপর্যুক্ত দুটি সংলাপে বিষয়গত সাদৃশ্য থাকলেও সৈয়দ শামসুল হক স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছেন। কেসিয়াস নিজের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে যেসব দৃষ্টান্ত প্রয়োগ করেছেন, তা নিছকই কেবল ব্যক্তি মানুষের অন্তর্গত দ্বিমুখী চরিত্রের প্রকাশক।

অন্যদিকে, সৈয়দ হক গণনায়ক নাটকে সানাউল্লার সংলাপের মাধ্যমে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও সামাজিক বিনষ্টির চিত্র চমৎকার ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর লিখিত একটি মাত্র সংলাপে দলকানা সাংবাদিক, স্বার্থান্ধ, নীতিহীন সাংসদ, বন্ধুর ছদ্মবেশে বিশ্বাসঘাতক গুপ্তচর কিংবা ধর্মকে ব্যবসা বানিয়ে যে-সকল পির সমাজে পসার সাজিয়ে বসে – তারা সকলেই একই কাতারে চলে এসেছে। বলা যায় সৈয়দ শামসুল হক রাজনৈতিক-পরীক্ষামূলক কাব্যনাটকের মান বজায় রেখেছেন।

সৈয়দ শামসুল হক যেহেতু শেকস্পিয়রের ক্লাসিক ট্রাজেডির আদলে রাজনৈতিক কাব্যনাটক লিখেছেন, তাই চরিত্র ও সংক্ষিপ্ত সংলাপের সংক্ষেপের রচনাকে আরও বেশি বস্তুনিষ্ঠ ও সংহত করে তুলেছেন, এবং সঙ্গত কারণেই শেকস্পিয়রকর্তৃক ব্যবহৃত উপমা-অলঙ্কার কিংবা ইতিহাসের ঘটনা এদেশের প্রেক্ষাপটে ঢেলে সাজিয়েছেন।

যেমন, সিজার ও ক্যাসিয়াসের শৈশব-কৈশোর বর্ণনা করতে গিয়ে শেকসৃপিয়র ঝড়ের দিনে টাইবার নদীতে নিছকই দুই বন্ধুর কৌতূহলবশত ঝাঁপিয়ে পড়া, তীব্রস্রোতে ভেসে যাবার মুহূর্তে ক্যাসিয়াসকর্তৃক সিজারকে বাঁচানোর ঘটনায় হোমারের ইলিয়ডের চরিত্র – ট্রয় নগরীর বৃদ্ধ এঙ্কিসেস ও রোম – নগরীর পূর্বপুরুষ ইনিয়াসের তুলনা করেছেন।

একই ঘটনা বর্ণনা করতে সৈয়দ শামসুল হক বেছে নিয়েছেন এদেশের মেঘনা নদী ও বৈশাখী ঘূর্ণিঝড়কে। গ্রিক মিথোলজির উদাহরণের স্থানে তিনি ব্যবহার করেছেন ভারতীয় মুঘল ইতিহাসের রাজ্যহারা বাদশা হুমায়ুন এবং তাকে বিপদ থেকে রক্ষাকারী ভিস্তিওয়ালার ঐতিহাসিক ঘটনা । অর্থাৎ সবকিছুই তিনি এদেশীয় প্রেক্ষাপটে ঢেলে সাজিয়েছেন।

জুলিয়াস সিজার নাটকের সিনেটর সিসেরো হলেন গণনায়ক নাটকের প্রবীণ কৃষক নেতা কাশেম আলী। এবং ক্যাঙ্কা চরিত্রের ভূমিকা পালন করেছেন তথ্যমন্ত্রী মির্জা। ক্যাঙ্কার জবানিতে যেমন জানা যায় সিজার অতিরিক্ত জনস্রোতের চাপে অসুস্থ হয়ে মৃগীরোগে আক্রান্ত হয়, ঠিক তেমনি তথ্যমন্ত্রী মির্জা এসে জানান, অতিরিক্ত গণজোয়ারে ওসমান তার পুরোনো পাকস্থলীর ক্ষতের ব্যথায় অস্থির হয়ে গেছেন।

উল্লেখ যে, বঙ্গবন্ধুর ছায়া নির্মাণ করতেই হয়তো লেখক মৃগীরোগের স্থানে পেটের পীড়ার কথা উল্লেখ করেছেন। কেননা, বঙ্গবন্ধু দীর্ঘকাল পেটের অসুখে ভুগেছেন।

জুলিয়াস সিজারে প্রথম অঙ্কের তৃতীয় দৃশ্যটি সংঘটিত হয়েছে রোমের রাজপথে। অন্যদিকে গণনায়কে এ দৃশ্য সংঘটনের স্থান পররাষ্ট্রমন্ত্রী সানাউল্লাহর বাড়ি। তবে দুটি নাটকের মঞ্চনির্দেশে শব্দ ও আলোর ব্যবহার একই; রাত্রিকাল এবং বজ্রবিদ্যুতের শব্দসংবলিত ঝড়ের আবহ।

এটি মূলত একটি প্রতীকী ব্যবহার। আসন্নবিপদ বা ট্রাজিক পরিণতি সম্পর্কে দর্শককে আগাম পূর্বাভাস দেওয়া এবং গভীর ষড়যন্ত্রের মুহূর্ত ফুটিয়ে তুলতে সৈয়দ শামসুল হক শেকসৃপিয়রের মতোই বজ্রনিনাদিত আলো ও ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ আবহ প্রয়োগ করেছেন।

তবে ঝঞ্ঝা- বিক্ষুব্ধ আবহাওয়া ও তার পেছনে দেবতাদের ভূমিকা নিয়ে কেসিয়াস-ক্যাঙ্কার পারস্পরিক আলাপ সৈয়দ শামসুল হক বাহুল্য বিবেচনায় সুকৌশলে এড়িয়ে গেছেন। বরং রাজনৈতিক নাটক লেখার সূত্র ধরে ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে এনেছেন পচিশে মার্চ কালরাত্রির নির্মম ঘটনা ও পরবর্তী দিনের দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার। জুলিয়াস সিজারে কেসিয়াস যখন ক্যাঙ্কার উদ্দেশ্যে প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম নিয়ে দার্শনিক উক্তি করেছে :

যখন আকাশের বুকে এইসব তাণ্ডব নৃত্য দেখো,

তুমি ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে যাও ।

[…] কিন্তু কখনো কি এসবের প্রকৃত তাৎপর্য খুঁজেছ ?

….. মানুষকে সতর্ক করবার জন্য, ভয় দেখানোর জন্য

এ সবই দেবতাগণের অভিপ্রেত। (জুলিয়াস সিজার, পৃ. ২৩)

অন্যদিকে সৈয়দ শামসুল হক বর্তমান প্রকৃতিকে ব্যাখ্যা করেছেন ইতিহাসের আলোকে :

আমি অনেকবার দেখেছি, মীর্জা, বায়ু এবং বস্তুপুঞ্জ

নিরাসক্ত নয়, মানুষের উত্থান পতনে তারা

নিস্পৃহ দর্শক নয়। মনে পড়ে একাত্তর সালের কথা,

পঁচিশে মার্চ, রাত এগারোটা থেকে অতর্কিত আক্রমণ,

বাংলার বক্ষস্থল ঝাঁঝরা হলো একটানা গুলিবর্ষণে

বিরামহীন বাহাত্তর ঘন্টা, গোলার আঘাতে,

ধসে পড়ল ছাত্রাবাস, মৃতের চিৎকারে বিদীর্ণ হলো আকাশ,

বাজারে জনপদে একের পর এক অগ্নিকাণ্ড

যেন বিশাল সব মশাল এক আশাহীন অন্ধকারে,

তারপর অবিরল ধারায় নামল বৃষ্টি বারুদের গন্ধ ডুবিয়ে,

আগুন নিবিয়ে, রাজপথে লাশগুলোকে ধৌত করে

যেন প্রস্তুত করে শেষ সৎকারের জন্যে ।

না মীর্জা, প্রকৃতি মানুষেরই একান্ত আত্মীয়। আনন্দে ঝলমল করে,

শোকে ক্রন্দন করে, বিক্ষোভে গর্জন করে, যেমন এখন। (কাব্যনাট্যসমগ্র : পৃ.২৪৮)

দ্বিতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্যের ঘটনাস্থান দুটি নাটকেই মোটামুটি কাছাকাছি। জুলিয়াস সিজারে এ দৃশ্যটি রচিত হয়েছে ব্রুটাস চরিত্রের বাড়ি সংলগ্ন বাগানে। আর গণনায়কে এর স্থান ব্রুটাসের ছায়া-চরিত্র প্রধানমন্ত্রী হুমায়ুনের বসবার ঘর। উভয় নাটকেই দৃশ্যটি শুরু হয়েছে যথাক্রমে ব্রুটাস ও হুমায়ুনের সংলাপের মাধ্যমে। দুজনেই তাদের ব্যক্তিগত কর্মচারীকে সম্বোধন করে প্রথম সংলাপ উচ্চারণ করেছেন।

 

গণনায়কের শৈলিবিচার

 

উল্লেখ্য যে, জুলিয়াস সিজার নাটকে ব্রুটাসের কর্মচারী লুসিয়ায়ের ছায়া-চরিত্র বা প্রতিরূপ গণনায়ক নাটকে হুমায়ুনের কর্মচারী আকবর। এ দৃশ্যে ব্রুটাস ও হুমায়ুনের আত্মদ্বন্দ্ব প্রায় একই। ব্রুটাস যেমন সিজারকে ভালোবাসে, কিন্তু সিজারের চিরস্থায়ী ক্ষমতার অভিলাষ দেশের অকল্যাণ বয়ে আনতে পারে এই চিন্তায় ক্ষতবিক্ষত হয়। গণনায়ক নাটকে রাষ্ট্রপতি ওসমানকেও হুমায়ুন অনুরূপ ভালোবাসে, কিন্তু তার একনায়কতান্ত্রিক আচরণে উদ্বিগ্ন।

দুজনের এই আত্মদ্বন্দ্ব প্রকাশে ভাষাগত দিক দিয়ে সৈয়দ শামসুল হক যেমন শেকস্পিয়রের হুবুহু অনুসরণ করেছেন আবার কিছুক্ষেত্রে শেকসপিয়রের উপমার বাইরে গিয়ে মূলভাব ঠিক রেখে নিজস্ব সৃজনশীলতা কাজে লাগিয়ে নতুন উপমা সৃষ্টি করেছেন। যেমন শেকসপিয়র সিজার সম্পর্কে ব্রুটাসের ভাবনা প্রকাশে লিখেছেন :

It must be by his death. And for my part

I know no personal cause to spurn at him,

But for the general. He would be crowned:

How that might change his nature, there’s the question.

It is the bright day that brings forth the adder,

And that craves wary walking.

সৈয়দ শামসুল হক এ অংশটির হুবুহু অনুবাদ করে লিখেছেন :

মৃত্যুই একমাত্র উত্তর। ব্যক্তিগত আমার কোনো বিবাদ নেই ।

কথা হচ্ছে দেশের কল্যাণ। তাঁকে করা হবে আজীবন

রাষ্ট্রপতি। ফলে, কতটা তিনি বদলাবেন সেটাই প্রশ্ন।

প্রখর উত্তাপেই গর্ত ছেড়ে বেরোয় গোক্ষুর। ( কাব্যনাট্যসমগ্র : ২৫০)

কিন্তু এই স্বগতোক্তির শেষের দিকে শেকসৃপিয়র সিজারকে হত্যা করার পক্ষে ব্রুটাসের মুখ দিয়ে যে দৃষ্টান্ত প্রয়োগ করেছেন, সৈয়দ শামসুল হক তা না করে এদেশের প্রেক্ষাপটে দৃষ্টান্ত প্রয়োগ করেছেন । শেকপিয়রের মূল রচনা :

And therefore think him as a serpent’s egg,

Which, hatched, would, as his kind, grow

mischievous,

And kill him in the shell. (Act 2 / Scene 1 )

সেখানে সৈয়দ শামসুল হক এই সর্পডিম্বের উদাহরণ বাদ দিয়ে নিজস্ব সৃজনশীলতা প্রয়োগ করে লিখেছেন :

কে বলতে পারে ?

বীজ থেকেই বিরাট বটগাছ

শংকিত সম্ভাবনা থেকেই ভয়াবহ নৈরাজ্যের অবতারণা।

বুদ্ধিমান গৃহস্থ দেয়ালের সামান্য ফাটলে বটের চারা

কখনো বাড়তে দেয় না। ক্ষিপ্র হাতে উপড়ে ফ্যালে। (কাব্যনাট্যসমগ্র : ২৫০)

জুলিয়াস সিজার নাটকের অন্যতম চরিত্র – জনৈক দৈবজ্ঞ সিজারকে সচেতন করে তুলতে ১৫ মার্চ তারিখের কথা উল্লেখ করেছিলেন, কিন্তু সৈয়দ শামসুল হক এদেশের সাধারণ মানুষের জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাসের সাথে মিল রেখে সেই দিনটিকে বানিয়েছেন অঘ্রানের কৃষ্ণা দশমী।

জুলিয়াস সিজারে ব্রুটাস যখন কর্মচারী লুসিয়াসকে তারিখ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছে, সে তখন এককথায় জানিয়ে দিয়েছে – তার জানা নেই তারিখ । – কিন্তু সৈয়দ শামসুল হক এদেশের মানুষের দ্বৈতস্বভাব নিয়ে চমৎকার এক স্যাটায়ার প্রয়োগ করেছেন হুমায়ুনের কর্মচারী আকবরের সংলাপের মাধ্যমে। যে জাতি রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিজাতি- বিভাষীর সঙ্গে এত লড়াই করল, রক্ত দিল, তারাই তাদের প্রাত্যহিক দিন-ক্ষণ গণনায় এদেশীয় রীতি ভুলে ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে যাচ্ছে। আকবরের তাৎপর্যপূর্ণ উক্তিটি উল্লেখ করা যেতে পারে :

আকবর।

বাংলা রাষ্ট্রভাষা হলে হবে কি, সাহেব ?

সকলেই ইংরেজি মাস গোণে। আমিও তাই। (কাব্যনাট্যসমগ্র : ২৫১)

সমাজের অপেক্ষাকৃত নিম্নস্তর থেকে উঠে আসা এমন একটি চরিত্রের এমন নিবিড় পর্যবেক্ষণ, দর্শক-চেতনায় অদ্ভুত এক দ্যোতনা সৃষ্টি করতে পেরেছে। এখানেই সৈয়দ শামসুল হকের অনন্যতা।

এ দৃশ্যে দুটি নাটকেই কেসিয়াস ও সানাউল্লাহ চরিত্রের মাধ্যমে যথাক্রমে ব্রুটাস ও হুমায়ুনকে রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে তুলতে জনতার চিঠি-প্রেরণের মিথ্যে তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। প্রধান ষড়যন্ত্রকারীরা জানে, জনতার মধ্যে তাদের নিজেদের তেমন গ্রহণযোগ্যতা নেই।

এমনকি নেতার কাছাকাছি যেতে না পারলেও তাকে হত্যা করা দুরূহ হবে। সেকারণেই তারা এমন জনপ্রিয় চরিত্র বেছে নিয়েছে যারা নেতা এবং জনতা উভয়েরই আস্থাভাজন। দুটি নাটকেই দেখা যায় সিজার ও ওসমান প্রধান ষড়যন্ত্রকারী কেসিয়াস ও সানাউল্লাহ সম্পর্কে নেতিবচিক ধারণা পোষণ করতেন। কিন্তু ব্রুটাস ও হুমায়ুনে তাদের ভরসা ছিল প্রবল। দুটি চরিত্রই তাদের নেতা সম্পর্কে ভেতরে ভেতরে দোদুল্যমান ছিল।

সেটিকে আরও একটু উস্কে দিতেই জনগণের চিঠি পাঠানোর মিথ্যে তথ্য উপস্থাপিত হয়েছে। কেসিয়াস এবং তার সঙ্গীদের মুখ ঢেকে অন্ধকারে আসা প্রসঙ্গে আত্মদ্বন্দ্বে বিক্ষুব্ধ ব্রুটাস যেখানে অন্ধকার ও ষড়যন্ত্র নিয়ে দার্শনিক উক্তি করেছে, শামসুল হক সেখানে হুমায়ুনের মুখে জুড়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের যাবতীয় ষড়যন্ত্রের ইতিহাস। ব্রুটাস এবং হুমায়ুনের সংলাপ পর্যবেক্ষণ করলেই বিষয়টি সুষ্পষ্ট হবে :

ব্রুটাস। এরা সেই ষড়যন্ত্রীর দল!

এ ষড়যন্ত্র!

রাত্রিকালই ত যতরকম দুষ্কর্ম অবাধে

ঘটানোর প্রকৃষ্ট সময়!

এ গভীর রাত্রেও যদি তোমার এত

লজ্জা মুখ দেখাতে,

দিনের আলোকে তবে কোথা পাবে অন্ধকার গুহা,

যেখানে লুকোবে তোমার দানবীয় মুখটি ! […] ঘোর নরকেও এত

অন্ধকার নেই যে তোমার মুখ ঢাকা পড়বে। (জুলিয়াস সিজার, পৃ. ২৭-২৮)

অন্যদিকে গণনায়ক নাটকে একই প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী হুমায়ুনের উক্তি :

বাংলার ইতিহাসে ষড়যন্ত্রের তো অভাব নেই।

জনগণ যখন ঘুমে শিথিল, প্রান্তর যখন পূর্ণিমায় বিবশ,

তখনি তো আঘাত, তখনি তো কলঙ্ক লেপন। তবে,

এক শতাব্দীতে চট্টগ্রামে জ্বলন্ত বিদ্রোহ,

মার্চের একটি দিনে ঢাকার সেনানিবাসে যদি

গণহত্যার চক্রান্ত, সেই মার্চেরই অন্যদিনে

রান্নারবাগে গতিরোধ। (কাব্যনাট্যসমগ্র- ২৫২)

 

গণনায়কের শৈলিবিচার

 

হুমায়ুন যখনই রাষ্ট্রনেতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র নিয়ে আত্মদ্বন্দ্বে ভুগছিলেন, তখনই এই বলে নিজেকে প্রবোধ দিয়েছেন যে, ব্যক্তি করে ষড়যন্ত্র, সমষ্টি করে বিপ্লব। এ দৃশ্যে সৈয়দ শামসুল হক যেমন শেকপিয়রের মূল রচনার অনুসরণ করেছেন, তেমনি স্বাতন্ত্র্য্যও বজায় রেখেছেন নিজস্ব সংযমবোধ ও মেধার পরিচয় দিয়ে। এখানেও জুলিয়াস সিজারের বেশ কিছু দীর্ঘ সংলাপ নাট্যকার সংক্ষিপ্তাকারে ভাবানুবাদ করেছেন।

আবার, বেশ কিছু সংলাপ অনুবাদ না করে বরং মূল নাটক থেকে সেগুলিকে বাদ দিয়েছেন। চরিত্র নির্বাচনেও সৈয়দ শামসুল হকের গ্রহণ-বর্জন, নতুন করে চরিত্র বিনির্মাণ ও সংযোজন লক্ষণীয়। যেমন, গণনায়ক নাটকে তিনি এ দৃশ্যে ফজলুল হক চরিত্রের সংলাপে সীমান্তরক্ষী ব্রিগেডিয়ার খান চরিত্রের উল্লেখ করেছেন, জুলিয়াস সিজারে এমন কোনো সামরিক চরিত্রের উপস্থিতি বা প্রসঙ্গ লক্ষ করা যায় না।

পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর ভূমিকার প্রতি ইঙ্গিত করেই হয়ত নাট্যকার এই চরিত্রটি যুক্ত করেছেন।

শেকস্পিয়রের জুলিয়াস সিজার নাটকে ব্রুটাসের স্ত্রী পোর্শিয়ার উল্লেখ আছে। এমন কি আলোচ্য দৃশ্যেও বেশ বড়ো একটি অংশ জুড়ে আছে ব্রুটাস-পোর্শিয়ার একান্ত ব্যক্তিগত দাম্পত্য সংলাপ। পঞ্চাঙ্কের ট্রাজিক নাটকে এরকম শাখাকাহিনি বাহুল্য মনে না হলেও সৈয়দ শামসুল হক কাব্যনাট্য রচনায় মূল ঘটনার বাইরে গিয়ে এমন দুই চরিত্রের সম্পর্ক ও সংলাপকে হয়তো অন্তরায় ভেবেছেন।

সে কারণে হুমায়ুনের স্ত্রীর কোনো সংলাপ গণনায়ক নাটকে পাওয়া যায় না। নাটকের শেষদিকে শুধু জানা যায়, দুই সামরিক বাহিনীর মুখোমুখি সংঘর্ষে হুমায়ুনের স্ত্রী-সন্তান একসাথে নিহত হয়েছে। আর এসব কারণেই গণনায়কে জুলিয়াস সিজারের অনুসৃতি সত্ত্বেও এটি অনুবাদ নাটক না হয়ে বরং সার্থক মৌলিক কাব্যনাটকের মর্যাদা পেয়েছে।

দ্বিতীয় অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যের ঘটনাস্থান উভয় নাটকেই এক। এ দৃশ্যটির চরিত্রাঙ্কন ও সংলাপ প্রায় সব কিছুই নাট্যকার শামসুল হক উইলিয়াম শেকসপিয়রের অনুসরণে করেছেন। যেমন : জুলিয়াস সিজারের এ দৃশ্যে স্ত্রী ক্যালিফোর্নিয়া গতরাতে তার দেখা দুঃস্বপ্ন ও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়াকে অমঙ্গল মনে করে বারবার সিজারকে সিনেটের সভায় যেতে নিষেধ করেছেন, গণনায়কেও নাট্যকার রাষ্ট্রপতির স্ত্রীকে একই স্বপ্ন দেখিয়ে মোটামুটি একই ভাষায় অনুরোধ করিয়েছেন।

তবে জুলিয়াস সিজারে শেকসৃপিয়র এ দৃশ্যের জন্য যে ভৃত্য চরিত্রটি রেখেছেন, গণনায়কে শামসুল হক তেমন কোনো চরিত্র রাখেননি। তিনি এখানে জুলিয়াস সিজারের অন্যতম সিনেটর চরিত্র দেসিয়াসের আদলে নির্মাণ করেছেন উত্তর বাংলার নেতা রংপুরের দাউদ চৌধুরীকে।

দেসিয়াস এবং দাউদ চৌধুরী উভয়েই যথাক্রমে সিজার ও ওসমান হত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িত। এবং সেই ষড়যন্ত্রের কৌশল হিসেবে উভয়েই তার নেতাকে স্ত্রীর স্বপ্নদৃশ্য আমলে না নিয়ে আজীবন রাষ্ট্রপতির মুকুট পরার জন্য সিনেট বা সংসদ ভবনে যেতে প্রভাবিত করেছে।

জুলিয়াস সিজার নাটকে সেকালের প্রথা অনুসারে সিনেটে যাবার আগে পশুবলিদানের উল্লেখ করা হয়েছে, যেটি বিংশ শতাব্দীর আধুনিক যুগের বাস্তবতায় সৈয়দ শামসুল হক এড়িয়ে গেছেন। পশুবলি এবং ভূত-প্রেত-দৈত্য-দেবতা নিয়ে অলৌকিক সংলাপগুলো অনুবাদে তিনি বর্জন করেছেন।

উইলিয়াম শেকসৃপিয়রের নাটকে দ্বিতীয় অঙ্কের তৃতীয় দৃশ্যের পরিসর অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। এ-দৃশ্যে আর্তেমি নামক একটি চরিত্র পত্রমারফত সিজারকে ব্রুটাস, কেসিয়াসদের যাবতীয় ষড়যন্ত্র ফাঁস করে সিজারকে আসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে চেয়েছে। সৈয়দ শামসুল হক এই দৃশ্যটি না রেখে সরাসরি তৃতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে চলে গেছেন। এবং জুলিয়াস সিজারের দ্বিতীয় অঙ্কের তৃতীয় দৃশ্যের নতুন চরিত্র আর্তেমির এই সতর্কবার্তা প্রথম অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যের মতো বরিশালের সদস্য নরেন্দ্রনাথকে দিয়ে উচ্চারণ করিয়েছেন।

এছাড়াও শেকস্পিয়র তাঁর নাটকে দ্বিতীয় অঙ্কের চতুর্থ দৃশ্য সংযোজন করেছেন, যেখানে ব্রুটাসের স্ত্রী পোর্শিয়া ও তাদের ভৃত্য লুসিয়াসের সংলাপ রয়েছে। এছাড়াও তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে সিজারকে আগে থেকেই মার্চের পনেরো তারিখ সম্পর্কে সচেতন ও সাবধান করে দেয়া দৈবজ্ঞব্যক্তি।

এরা প্রত্যেতেই আসন্ন বিপদ নিয়ে শঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন। সৈয়দ শামসুল হক যেহেতু গণনায়ক নাটকে ব্রুটাসের স্ত্রী চরিত্রের পৃথক কোনো প্রতিরূপ নির্মাণ করেননি, তাই স্বভাবতই এই দৃশ্যটি এড়িয়ে গেছেন কাব্যনাট্য সংহত করার প্রয়োজনে। এই দৃশ্যের বক্তব্য তিনি তাঁর পরবর্তী দৃশ্যের ভাবের সঙ্গে একীভূত করে নাটকটিকে সুসংহত করে তুলেছেন।

উভয় নাটকের তৃতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্যের ঘটনাস্থান প্রায় একই। দুটি নাটকেই যথাক্রমে দৈবজ্ঞ, আর্তেমি, এবং নরেন্দ্র তাদের প্রাণের নেতাকে আসন্ন বিপদ সম্পর্কে বারবার সতর্ক করতে চেয়েছে, কিন্তু শত্রুপরিবেষ্টিত রাষ্ট্রনায়কগণ বন্ধুরূপী শত্রুর মধুবাক্যে বিভ্রান্ত হয়ে এদের কথা আমলে নেয়নি। যার কারণেই নেমে এসেছে এমন হৃদয়বিদারক ট্রাজিক পরিণতি।

এখানে সিজারের মৃত্যুদৃশ্যের অনুরূপ করেই সৈয়দ শামসুল হক ওসমানের মৃত্যুদৃশ্য নির্মাণ করেছেন। জুলিয়াস সিজারে যেমন কারাগারে আটক এক সভাসদের ভাইয়ের মুক্তির দাবিতে সবাই সিজারের ঘনিষ্ঠ হতে চায় এবং তাঁকে উত্তেজিত করে অসতর্ক করে ফেলে, গণনায়ক নাটকেও তেমনি সংসদ সদস্য ফজলুল হকের কারাগারে আটক দেশদ্রোহী সাংবাদিক ভাইয়ের মুক্তির দাবি তোলা হয়। কিন্তু ওসমান কিছুতেই রাজি না হওয়ায় তথ্যমন্ত্রী মির্জা প্রথমে ওসমানের দেহে ছুরি বসিয়ে দেয়।

জুলিয়াস সিজারে এ কাজ করেছিল সিনেটর ক্যাঙ্কা। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্রেও তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী তাহেরউদ্দিন ঠাকুর জড়িত ছিলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মোশতাকবাহিনীর সঙ্গে তার যুক্ত থাকা এর প্রমাণ বহন করে।

উল্লেখ্য যে, উভয় নাটকেই ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ছুরিকাঘাতে মারা গেছেন রাষ্ট্রনেতা। বিংশ শতাব্দীর প্রেক্ষাপটে ছুরির থেকে বন্দুকের গুলিই অধিক প্রাসঙ্গিক ও বাস্তব বলে আমাদের কাছে মনে হতে পারে। শামসুল হক যখন এ নাটকটি অবরুদ্ধ বাস্তবতায় রচনা করেছিলেন তখন অন্তরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিচ্ছবি থাকলেও সামরিক শাসকের চোখ রাঙানির ভয়ে সরাসরি প্রকাশের সুযোগ ছিল না।

একারণে মূল রচনার অনেক কিছু সময়ের বিচারে নতুন করে সৃষ্টি করলেও হত্যাদৃশ্য ও হত্যার উপকরণে পরিবর্তন ঘটাননি। কিন্তু একালের দর্শকের মনে এই বাস্তবতার বিষয়ে যাতে প্রশ্ন না জাগ্রত হয় সেকারণে হত্যা-পূর্ববর্তী ষড়যন্ত্রমূলক আলোচনায় খুনি চরিত্রগুলোর মাধ্যমে যুক্তি দেখিয়েছেন যে, সংসদভবনে গুলির আওয়াজে সমস্যা হতে পারে। অতএব ছুরিকাঘাতই উত্তমপন্থা। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী হুমায়ুনের একটি সংলাপ উল্লেখ করা যেতে পারে :

আর এটাও স্থির হোক, কোন অস্ত্র ? না, পিস্তল নয় ।

ছুরিতে । কারণ, তা নিঃশব্দ। প্রথমত, জনতা থাকবে

সংসদ ভবনের বাইরে, গুলির শব্দে ছড়িয়ে পড়বে আতঙ্ক,

তৎক্ষণাৎ, কারণ, তারা বুঝবে না ভেতরে কি হচ্ছে। (কাব্যনাট্যসমগ্র : ২৫৬)

সিজার ও ওসমান উভয়েই নির্ভীক, বীর চরিত্র। মৃত্যুর ভয় তাদের নেই। তাদের সবচেয়ে বড়ো কষ্ট ঘনিষ্ঠ বন্ধুর বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতারণা। যে কারণে তারা অন্যদের আঘাতে যতটা না কষ্ট পেয়েছেন, তার থেকে অধিক কষ্ট পেয়েছেন ব্রুটাস কিংবা হুমায়ুনের বিশ্বাসঘাতকতায়। তাই বিদায় বেলায় তাদের শেষ সংলাপ :

সিজার : ব্রুটাস! তুমিও! যাক তবে সিজারের প্রাণ! (জুলিয়াস সিজার : ৪৩)

ওসমান : তুমি? হুমায়ুন? – তাহলে, এভাবেই ? (কাব্যনাট্যসমগ্র : ২৬৫)

ওসমানের মৃত্যু-পরবর্তী দৃশ্যগুলোর ঘটনাপুঞ্জে সৈয়দ হক মোটামুটি শেকস্পিয়রকেই অনুসরণ করেছেন। তবে উইলিয়াম শেকসপিয়র রচিত নাটকের বৃহৎ সংলাপগুলোতে তিনি মূলবক্তব্য ঠিক রেখে অপেক্ষাকৃত সংক্ষিপ্ত করে রচনা করেছেন। যেমন, সিজারের মৃত্যুর পর কেসিয়াস ও ব্রুটাসের সংলাপ ছিল নিম্নরূপ :

কত কত ভবিষ্যৎ যুগে

কত নব-নব রাজ্যে, কত-কত অজ্ঞাত ভাষায় ।

মোদের এ নাট্যরঙ্গ অভিনীত হবে পুনর্বার।

[…] পম্পির বেদীতলে,

পড়ে আছে মূল্যহীন ধুলোর মতোন,

সিজারের মৃতদেহ। কত রঙ্গমঞ্চে

এই দেহ হতে, ভবিষ্যতে

কতবার রক্তপাত হবে কে জানে ? […]

যতবার হবে রক্তপাত, ততবার লোকেরা বলবে,

আমরা এই গুটিকয়জন স্বাধীনতা আনলাম দেশে।’

সেখানে সৈয়দ শামসুল হক সংক্ষিপ্ত ও সুসংহত করে লিখেছেন :

তবে তাই হোক । পৃথিবীতে আর কত কাল কত দেশে

আর কত বিচিত্র ভাষায় বারবার অভিনীত হবে এ নাটক ?

[…] ব্যক্তির বিলয় হবে নিতান্ত ধুলায়। […]

ব্যক্তির পতন থেকে মহা-অভ্যুদয়।

যুগে যুগে মুক্তিদাতা, নির্ভীক, দুর্জয়

বলে চিহ্নিত আমাদেরই পরিচয়। (কাব্যনাট্যসমগ্র: ২৬৬)

 

গণনায়কের শৈলিবিচার

 

তৃতীয় অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যে সভাকক্ষে দাঁড়িয়ে ব্রুটাস যেমন জনগণের উদ্দেশ্যে বক্তৃতার মাধ্যমে সিজারকে হত্যার উপযুক্ত যৌক্তিকতা বোঝাতে চেয়েছে, গণনায়ক নাটকে হুমায়ুনও একই কাজ করেছেন। উভয় নাটকেই জনতার চরিত্র একই। যারা একটা সময়ে ব্রুটাস বা হুমায়ুনের বক্তব্যে আশ্বস্ত হয়ে সিজার হত্যা-ন্যায়সিদ্ধ ও যৌক্তিক মনে করেছে, তারাই আবার পরক্ষণে এন্টনিও বা রশীদ আলীর যুক্তিতে মুগ্ধ হয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে।

এখানেও অধিকাংশ সংলাপ সৈয়দ শামসুল হক জুলিয়াস সিজারের সংলাপের অনুসরণে রচনা করেছেন। কিন্তু তিনি এর মধ্যেই দেখিয়েছেন নিজস্বতার চমক। যেমন শেকপিয়র জনতা চরিত্রের পৃথক পৃথক মত কিংবা মতবিরোধ তেমন একটা দেখাননি। জনতা ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায় সবাই মিলে প্রায় একই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেখানে। কিন্তু গণনায়ক নাটকে জাতীয় সংসদের সদস্যদের মধ্যে সুস্পষ্ট কোন্দল দেখিয়েছেন সৈয়দ হক, যা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতার মৃত্যু-পরবর্তী সময়ে বিভ্রান্ত জনগণের পৃথক পৃথক মতাদর্শের প্রমাণ বহন করে। প্রাসঙ্গিক সংলাপ নিম্নে উল্লেখ করা হলো :

প্রথম : সমগ্র উত্তর বাংলা হুমায়ুনের পেছনে আছে ।

দ্বিতীয়: উত্তর বাংলা ওঁর একার সম্পত্তি নয়, আর

বর্তমান পরিস্থিতিতে আঞ্চলিকতার উস্কানি

বরদাশত করা হবে না । (কাব্যনাট্যসমগ্র : ২৭৪)

সৈয়দ শামসুল হক রশীদ আলীর বক্তব্যের মাধ্যমে ওসমানের যে প্রতিরূপ নির্মাণ করেছেন তাতে বঙ্গবন্ধুর স্বরূপই অধিক সুস্পষ্ট হয়েছে। ঘাতক কর্তৃক বঙ্গবন্ধু হত্যার ফলে লেখকের অন্তর্গত শোক এ অংশে যেন অনুবাদের ঊর্ধ্বে উঠে নতুন এক মাত্রায় অভিষিক্ত হয়েছে।

উইলিয়ম শেকস্পিয়র তাঁর নাটকে এ দৃশ্যে কেবল অক্টাভিয়াস সিজারের রাজধানীতে আসার খবর ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু সৈয়দ শামসুল হক বাস্তবতার নিরিখে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল চৌধুরী, এয়ার মার্শাল আমিন এবং পুলিশ প্রধানের সম্মিলিত উদ্যোগের কথা বলেছেন। এ দৃশ্যে তাঁর বর্ণনা যেন পঁচাত্তর-উত্তর কালের শত্রুপরিবেষ্টিত অবরুদ্ধ বাংলাদেশের বাস্তব পরিস্থিতিই মনে করিয়ে দেয়।

তৃতীয় অঙ্কের তৃতীয় দৃশ্যের মাধ্যমে উইলিয়াম শেকস্পিয়র দেখিয়েছেন – রাজনৈতিক ডামাডোলে পড়ে, ক্ষমতার পালাবদলে বরাবরই কিছু হুজুকে গোষ্ঠীর আবির্ভাব হয়। এরাই নানান গুজবে কান দিয়ে তুচ্ছ কারণে কিছু নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। মূল জুলিয়াস সিজারের বেশ কিছু দৃশ্য যেখানে সৈয়দ শামসুল হক ভেবেচিন্তে এড়িয়ে গেছেন, সেখানে এই দৃশ্যটির গুরুত্ব অনুধাবন করে তা সংযোজন করেছেন গণনায়ক নাটকে।

তবে দৃশ্যটিকে একালের সমাজব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করে তুলতে কিছু কিছু পরিবর্তন এনেছেন তিনি। যেমন নাগরিকদের স্থানে এনেছেন তরুণ ছাত্রসমাজকে। এদেশের আন্দোলন-সংগ্রামে ছাত্রসমাজের ভূমিকা স্মরণ করেই হয়তো লেখক ভেবেছেন জনগণের স্থানে ছাত্রসমাজ সংযোজিত করলে দৃশ্যটি দর্শক-পাঠক মহলে অধিকতর বাস্তব হয়ে ধরা দেবে।

জুলিয়াস সিজারে যেমন জনগণ সিনার কবিসত্তার পরিচয় পেয়ে তার কবিতাকে রাবিশ বলে আরও উত্তেজিত হয়েছে, গণনায়কে সেখানে কবি যখন জানিয়েছেন, ছাত্রদের আন্দোলনের কিছু স্লোগান তার হাতে রচিত, এমনকি পাঠ্যপুস্তকের কিছু জনপ্রিয় কবিতার রচয়িতাও তিনি, তখন হুজুকে-ছাত্রসমাজ তাকে দুরূহ কবিতা লেখার অভিযোগ তুলে হত্যা করছে :

সিকান্দার :

না, না, আমি কবি, কবি সিকান্দার আলি।

তোমাদের কলেজে আমার কবিতা পড়ানো হয়। পড়োনি?

তৃতীয় (ছাত্র) : তবে তোর দুর্বোধ্য কবিতার জন্যই তোকে খতম করা চাই। ( কাব্যনাট্যসমগ্র : ২৮১)

চতুর্থ অঙ্কের প্রথম দৃশ্য থেকেই মূলত গণনায়কের কাহিনির সঙ্গে জুলিয়াস সিজারের ঘটনাবলির সুস্পষ্ট দূরত্ব লক্ষ করা যায়। সৈয়দ শামসুল হক এ পর্যায়ে খুব ক্ষীণ ভাবেই শেকস্পিয়রকে অনুসরণ করেছেন। তিনি বরং সংলাপ, চরিত্রের বিকাশ ও পরিণতি অঙ্কনে নতুনমাত্রা যোগ করেছেন।

জুলিয়াস সিজারের এ দৃশ্যে এন্টনি, অক্টাভিয়াস ও লেপিডাস তিনজন মিলে আলোচনার মাধ্যমে শত্রুদের তালিকা তৈরি করেছে ; কারা – সিজারকে হত্যার ষড়যন্ত্রে জড়িত ছিল এবং পরিবর্তিত রাজনীতির প্রেক্ষাপটে কারা এখন তাদের শত্রু। এখানে অক্টাভিয়াস ও এন্টনির মধ্যে একটি চমৎকার বোঝাপড়া লক্ষ করা গেছে। কিন্তু গণনায়ক নাটকে এ পর্যায়ে মঞ্চে নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছেন সামরিক একনায়ক জেনারেল চৌধুরী।

তিনি যদিও প্রকাশ্যে ওসমানের পক্ষের লোক বলে নিজেকে পরিচয় দিচ্ছেন, কিন্তু ভেতরে ভেতরে নানান কূট-কর্মকাণ্ডে সুস্পষ্ট করেছেন নতুন করে তাঁর দেশ দখলের ষড়যন্ত্র। জেনারেল চৌধুরী ওসমানের ব্যক্তিগত সহচর রশীদ আলীকে ছেড়ে কথা বলেননি। একে একে বহু রাজনৈতিক নেতাকে বন্দি করেছেন তিনি।

কাউকে কাউকে ক্রসফায়ারের কথা বলে হত্যা করেছেন। স্বীয় স্বার্থ হাসিলের কারণে প্রবীণ নেতা কাশেম আলীকে পর্যন্ত সুকৌশলে বন্দি করে রেখেছেন। শেষপর্যন্ত তাঁকে দলে টানতে ব্যর্থ হয়ে জেলের অভ্যন্তরে হত্যা করেছেন।

জুলিয়াস সিজার নাটকের চতুর্থ অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যে সিজার হত্যার প্রধান দুই ষড়যন্ত্রকারী কেসিয়াস ও ব্রুটাসের মধ্যে তুমুল মতানৈক্য দেখা যায়। প্রকৃতপক্ষে যা তাদের অপরাধ-প্রবণ দুর্বল মানসিকতারই প্রমাণ। সৈয়দ শামসুল হক তাঁর সৃষ্ট কাব্যনাটকে শেকস্পিয়র রচিত ছোট্ট এই দৃশ্যটির পৃথক অনুবাদ করেননি।

তিনি জুলিয়াস সিজার নাটকের চতুর্থ অঙ্কের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দৃশ্য একীভূত করে গণনায়কের দৃশ্য রচনা করেছেন। এখানে তিনি ব্রিগেডিয়ার খান নামক একটি নতুন চরিত্র সৃষ্টি করেছেন, যিনি ক্ষমতার এ দ্বন্দ্বে আর্মির বিরুদ্ধে গিয়ে সানাউল্লাহ-হুমায়ুনদের পক্ষ সমর্থন করেছেন।

এ দৃশ্যে দেখা যায় সানাউল্লাহর আইনবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে হুমায়ুন বেশ বিরক্ত। অপরদিকে সানাউল্লাহও হুমায়ুনের নির্লিপ্ত আচরণে ক্ষিপ্ত। কেননা হুমায়ুনকে নিয়ে সানাউল্লাহ যে দুর্বার নেতৃত্বের আশা করেছিল, হুমায়ুন তার কিছুই করতে পারছে না; ফলে আজ তাদের অপরাধীর মতো পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। আর হুমায়ুন ভাবছে – সে সানাউল্লাহর প্রতারণার শিকার হয়েছে।

বস্তুত, বিশ্বাসঘাতক চরিত্রগুলি ইতিহাসে বারবার এভাবেই প্রতারিত হয়। পলাশির প্রান্তরে সিরাজদ্দৌলার প্রধান সেনাপতি মীরজাফর সিরাজদ্দৌলার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে তিনমাসও ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। আবার পঁচাত্তরের বিশ্বাসঘাতক মোশতাক বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বেইমানি করে অল্প কিছুদিন মাত্র ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছে। বস্তুত, স্বীয় ঘৃণ্যকর্মের জন্য ভেতরে ভেতরে একসময় ক্ষয়ে যায়। প্রকৃতি এদের ক্ষমা করে না। এই বিষয়টি লেখক বেশ ভালোভাবেই উপস্থাপন করতে পেরেছেন আলোচ্য নাটকে।

 

গণনায়কের শৈলিবিচার

 

গণনায়ক নাটকে সীমান্তরক্ষী ব্রিগেডিয়ার খান যখন এসে জানায় – সাভারে সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার সেনাদের সম্মুখ যুদ্ধে হুমায়ুনের স্ত্রী-সন্তান নিহত হয়েছে, তখন হুমায়ুন একেবারেই ভেঙে পড়েন। একদিকে দীর্ঘদিনের সহকর্মী, নেতা ওসমানকে বিনাদোষে হত্যা করার অপরাধবোধ, অন্যদিকে সানাউল্লাহর প্রতারণা, তদুপরি পরিবার পরিজন হারানোর শোকে তিনি একেবারেই বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়েন।

এমতাবস্থায় তার বিবেকই ছায়ারূপ ধারণ করে তার সামনে আবির্ভূর্ত হয়ে জানায় যে, এখন একমাত্র স্বেচ্ছামৃত্যুই পারে হুমায়ুনকে এই ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব, অপরাধবোধের যন্ত্রণা থেকে মুক্ত করতে। মূলত, কাব্যনাটকের সংজ্ঞানুসারে বাহ্যিক ঘটনাবলির তুলনায় ব্যক্তির অন্তরের দ্বন্দ্বই যদি প্রধান বিবেচ্য হয়ে থাকে, তবে এ নাটকে হুমায়ুনই সেই ট্রাজিক চরিত্র, যে পলে পলে আত্মদ্বন্দ্বে জর্জরিত হয়েছে। তিনি ন্যায়বান হয়েও অন্যায় করেছেন, আবার সেই অন্যায় করার কারণে অনুশোচনায় দগ্ধ হয়েছেন। ভৃত্য আকবরের বাঁশির সুরেই ধ্বনিত হয়েছে তার বুকের করুণ আর্তনাদ,

হাহাকার : বাঁশির ভেতরে চাপা একটা কান্না,

সেই কান্নায় অবসন্ন হয়ে গেল সমস্ত পৃথিবী । […]

শুধু আমার চোখে ঘুম আসে না। বুকের ভেতর কান্নার একটা পাথর, তবু গলে না  – (কাব্যনাট্যসমগ্র :২৯৩)

অবশেষে তার বিবেক ছায়ারূপে এসে তাকে তার মুক্তির পথ জানায় :

তোমাকে জানাতে চাই যে মৃত্যুই তোমারও উদ্ধার,

যেমন আমার। (কাব্যনাট্যসমগ্র : ২৯৪)

বস্তুত ছায়া চরিত্রটির আত্মপরিচয় শুনে আপাতবিচারে মনে হতে পারে সে মৃত ওসমানের প্রেতাত্মা। কেননা – হুমায়ুনকে সে নিজের পরিচয় দিয়েছে তোমার পূর্বগামী বলে, এবং ইঙ্গিত দিয়েছে তার অপমৃত্যুর। কিন্তু আমাদের বিবেচনায় এটি আসলে হুমায়ুনের বিবেক, যেটি প্রতিনিয়ত ওসমানকে অন্যায়ভাবে হত্যা করার অনুশোচনায় দগ্ধ হয়েছে।

তাই স্ত্রী-স্বজন হারিয়ে হুমায়ুন যখন দুর্বলচিত্ত, তখন রাতের আলো-আঁধারিতে সে ছায়ারূপে সামনে এসেছে। হুমায়ুনের নিজের অন্তরই এই বলে শান্তি খুঁজে নিতে চেয়েছে যে – স্বেচ্ছামৃত্যু ছাড়া এই দুঃসহ দহন থেকে, অপরাধপ্রবণ অন্তর থেকে তাঁর মুক্তি নেই।

ছায়া চরিত্রের এমন উপস্থিতি মুনীর চৌধুরীর (১৯২৫-১৯৭১) কবর (১৯৬৬) নাটকেও দেখা যায়, যেখানে কবরস্থানের অন্ধকারে, ভৌতিক পরিবেশে নেশাগ্রস্ত নেতা ও পুলিশ অফিসার হাফিজের বিবেক লাশরূপে একে একে উঠে এসে তাদের হিংস্র, স্বার্থান্ধ, কুৎসিত চেহারা তুলে ধরেছে। অ্যাবসার্ড নাটকের এই ফর্মটি এখানে স্বল্পপরিসরে হলেও সার্থকভাবে প্রয়োগ করতে পেরেছেন সৈয়দ শামসুল হক।

পঞ্চম অঙ্কের প্রথম দৃশ্যের প্রারম্ভে শেকস্পিয়র একটি যুদ্ধের দৃশ্য দেখিয়েছেন। ফিলিপি নামক প্রান্তরে একদিকে কেসিয়াস ব্রুটাসের দল অন্যদিকে অক্টাভিয়াস-এন্টিনিওর সৈন্যরা সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। ক্লাসিক ট্রাজেডি নাটকের ক্ষেত্রে যুদ্ধদৃশ্য অত্যন্ত স্বাভাবিক মনে হলেও, আধুনিক কাব্যনাট্যে এমন দৃশ্য বেমানান মনে হয়।

কেননা কাব্যনাট্যের বিষয় ব্যক্তির অন্তর্লোকের ঘাত-সংঘাতের উপস্থাপনা, বহিলোকে সংঘটিত যুদ্ধ নয়। সে কারণে গণনায়ক নাটকে লেখক সরাসরি যুদ্ধদৃশ্য এড়িয়ে গেছেন। যুদ্ধের বর্ণনা তিনি জেনারেল ও রশীদের পারস্পরিক সংলাপের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন।

মূলত, শেকস্পিয়র তাঁর জুলিয়াস সিজার নাটকের পঞ্চমাঙ্কের পাঁচটি দৃশ্যজুড়ে নতুন-পুরাতন কুশীলবদের যুক্ত করে বিশাল এক যুদ্ধদৃশ্য দেখিয়েছেন। এই যুদ্ধের ফলস্বরূপ সিনেটর কেসিয়াস মারা যান। সিনেটর ব্রুটাস পরাজিত হন, , কিন্তু সেনাদের হাতে বন্দি হবার পূর্বে নিজেই নিজের তরবারির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। কিন্তু গণনায়ক নাটকের পরিণতি সম্পূর্ণ আলাদা।

এ অংশে নাট্যকার সৈয়দ হক শেকপিয়রের প্রদর্শিত পথে না হেঁটে, দেশের বিদ্যমান বাস্তব এবং ভবিষ্যৎ কল্পনার সমন্বয়ে পুরোটাই নিজের মতো করে রচনা করেছেন। এখানে দেখানো হয়েছে – যুদ্ধ হয়েছে মূলত সীমান্তরক্ষী ব্রিগেডিয়ার খান ও দেশের সমর- – প্রধান জেনারেল চৌধুরীর সেনাদের মধ্যে।

রাজনীতিবিদগণ এখানে ক্রীড়নক মাত্র। জুলিয়াস সিজারে দেখা গেছে, অক্টাভিয়াসের নেতৃত্ব মেনে সিজারবন্ধু এন্টনিও তাকে সাহায্য করেছেন; যার রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্ষমতায় বসার কোনো অভিলাষ ছিল না। কিন্তু গণনায়কে রশীদ আলীর মনেও রয়েছে ক্ষমতারোহণের সুপ্ত বাসনা।

তাই কিছু সিদ্ধান্ত অন্যায় জেনেও তিনি জেনারেল চৌধুরীর প্রশংসা করেছেন। কিন্তু ক্ষমতালিপ্সু, চতুর জেনারেলর অন্তর্লোকে লালন করেছেন ভিন্ন বাসনা। যুদ্ধশেষে তিনি যখন রশীদ আলীকে বলেছেন :

অবিলম্বে সিদ্ধান্ত নেয়া প্রয়োজন, কিভাবে সরকার হবে,

কি হবে কাঠামো, কর্ণধার কারা; অবিলম্বে জানানো দরকার

দেশের মানুষকে যারা উৎকর্ণ হয়ে আছে এইটুকু আশ্বাস পেতে

যে, ষড়যন্ত্র নির্মূল, নিশ্চিহ্ন ঘাতক, হঠাৎ জলোচ্ছাসে

ভেসে যাওয়া নৌকোর হাল স্ব-স্থানে আবার বহাল, নেতৃত্ব

এখনো অটুট। (কাব্যনাট্যসমগ্র : ২৯৬)

প্রত্যুত্তরে রশীদ আলী যখন দেশ শাসনে সংসদ ডেকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করার পরামর্শ দেন, তখনই বেরিয়ে আসে জেনারেলের আসল চেহারা। তিনি দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গকে আরও একবার চরম অপমান করে বলেন :

অর্থাৎ আবার সেই

যে কোনো বাতাসে যে কোনো দিকে অবনত ব্যক্তিদের ভিড়।

[…] যে কোনো প্রভুর কৃপাভিক্ষায় যারা উদগ্রীব, তাদের নিয়ে

সরকার তো দূরের কথা, ডাকাতের একটা দল পর্যন্ত

গঠন করা যায় না। (প্রাগুক্ত)

রশীদ আলী তবু নিজের অপমানের এমন স্পষ্ট ইঙ্গিত পেয়েও নির্লজ্জের মতো ক্ষমতায় বসার শেষ আশা ছাড়েননি। তিনি বরং ক্ষমতাপ্রাপ্তির ক্ষীণ আশা নিয়ে জেনারেলের কথায় সুর মিলিয়ে গেছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত জেনারেল তাকে জানিয়েছেন – রশীদ আলী নয় রাষ্ট্রের ক্ষমতায় বসার সবচেয়ে উপযুক্ত ব্যক্তিত্ব ওসমানের বিধবা স্ত্রী।

রাষ্ট্রপরিচালনায় তাঁর অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার অভাব থাকলেও জনগণের আবেগকে পুঁজি করার জন্য ওসমানের বিধবা স্ত্রীর বিকল্প আর কেউ হতে পারেন না। অতঃপর রশীদ আলী বুঝতে পারেন, একজন দুর্বলচিত্ত ব্যক্তিত্বকে রাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগদান করে সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল চৌধুরী নেপথ্য থেকে নিজেই সরকার ও দেশ পরিচালনা করতে চান ।

পঞ্চম অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যে নাট্যকার পলাতক সানাউল্লাহ এবং হুমায়ুনের শেষ পরিণতি দেখিয়েছেন। এ পর্বে দেখা যায়, পরাজিত দুই প্রধান ষড়যন্ত্রকারী নিজেদের মধ্যেই আত্মকলহে লিপ্ত। হুমায়ুন এখন পুরোপুরিই হতাশায় নিমজ্জিত, কিন্তু যুদ্ধে হেরেও সানাউল্লাহ এখনো হাল ছেড়ে দিতে নারাজ।

 

গণনায়কের শৈলিবিচার

 

তিনি মনে করেন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে এই পলায়ন তার কাছে মূলত ‘পশ্চাদপসরণ, নতুন করে ব্যুহ রচনা’র কৌশল। ফলে তিনি নানান কথার ফুলঝুরিতে অনুশোচনায় দগ্ধ, আত্মদ্বন্দ্বে পরাভূত, হতাশায় নিমজ্জিত হুমায়ুনকে আবারও উজ্জীবিত করার চেষ্টা করে গেছেন। হুমায়ুনকে হতাশা ভুলে জেগে ওঠার আহবান জানিয়ে তিনি বলেছেন :

ঘুমিয়ে আছেন নেতা। তাকিয়ে দেখুন একবার।

দেশের উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম –

একেবারে অন্তঃস্থল থেকে প্রবল একটা প্রাণ চঞ্চল হয়ে উঠেছে,

অচিরেই সমস্ত কিছু ডুবিয়ে শোনা যাবে একটা বিস্ফোরণ,

ধসে যাবে অচলায়তন। বলা নিষ্প্রয়োজন,

মানুষের ভালবাসার চেয়ে তীক্ষ্ণ কোনো অস্ত্র নেই,

আর সেই অস্ত্রই আপনার হাতে; (কাব্যনাট্যসমগ্র : ৩০১ )

সানাউল্লাহ বিশ্বাস করেন, ওসমানের পর হুমায়ুনের ওপরই এদেশের সাধারণ জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে। তাই তাকে জাগ্রত করে তুলতে পারলেই নিজের ক্ষমতা দখলের পথ মসৃণ হবে। কিন্তু হুমায়ুন ততক্ষণে ওসমানকে হত্যার অনুশোচনায় ধ্বস্ত; স্ত্রী-পরিজন হারিয়ে নিঃস্ব। এমনকি সানাউল্লার নানান অনৈতিক কর্মকাণ্ডে তার ওপর থেকেও আস্থা উঠে গেছে তার।

তিনি বুঝতে পেরেছেন সানাউল্লাহ যে দেশের মঙ্গলের কথা বলে বলে তাকে এই বিদ্রোহের পথে টেনে এনেছেন সে-পথ সঠিক নয়। কিন্তু এখন আর ফিরে যাবারও পথ নেই। এই যে দ্বন্দ্বাত্মক বাস্তবতা, হাহাকারদীর্ণ অনুশোচনা, এটিই তাকে কাব্যনাটকের অন্যতম সার্থক চরিত্রের মর্যাদা দান করেছে। হুমায়ুনের ভেতরে এই আত্মদ্বন্দ্ব চমৎকার একটি রূপকের মাধ্যমে চিত্রিত করেছেন লেখক :

সংশয়ের দীর্ঘ একটা করাতে অনবরত কেটে চলেছেন বন্ধন;

তরুণ কোনো প্রেমিকের মতো দাঁড়িয়ে আছেন

সত্যরক্ষার স্বরচিত গম্ভীর ভেতরে। (প্রাগুক্ত)

হতাশার করাল গ্রাস থেকে হুমায়ুন কিছুতেই আর নিজেকে আশার আলোয় টেনে তুলতে পারেন নি। তবে তিনি বিশ্বাস করেন, তিনি নিজে দেখে যেতে না পারলেও একদিন এই সাধারণ মানুষের হাতেই বাংলার প্রকৃত মুক্তি সম্ভব হবে। দার্শনিকের দৃষ্টিতে সানাউল্লাহকে তিনি বলেন – হয়তো তারা বিপ্লবের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠন করে প্রশাসনসন্ত্রের চালিকা শক্তি হবেন। কিন্তু ইতিহাসের নিয়ম দুর্লঙ্ঘ্য।

তারা যেমন রাষ্ট্রপতি ওসমানের বিরুদ্ধে একদিন ষড়যন্ত্র করেছিলেন, তেমনি ভাবে হয়তো একদিন তাদের বিরুদ্ধেও অন্য কেউ ষড়যন্ত্র করবেন। অনুশোচনা-কাতর হুমায়ুনের নবজাগ্রত অভিজ্ঞানের মাধ্যমে নাট্যকার যেন ইতিহাস আর ভবিতব্যকে দর্শকের সামনে উপস্থাপন করে তাদের চেতনালোককে নাড়া দিতে চেয়েছেন :

ধরা যাক যুদ্ধে জয় হবে।

[…] তারপর বিজয়ীর বেশে ঢাকা যাবো, সরকার হবে,

জনতার প্রতিনিধি নিয়ে আবার সংসদ হবে,

ময়দানে বক্তৃতা হবে,

দেয়ালে পোস্টার পড়বে,

রাজপথে মিছিল বেরুবে, প্রতিপক্ষ মাথাচাড়া দেবে,

অন্য কারো বিপ্লব, অন্য কারো অভ্যুত্থান হবে।

আর আমি অন্য কোনো রশীদ আলিকে

আবারও সুযোগ দেবো বক্তৃতার যে কোনো সময়ে,

অন্য কোনো সানাউল্লাহকে বাধা দেবো বিচ্যুতি থেকে,

অন্য কোনো, সশস্ত্র সংগ্রামে আবারো প্রকাশ পাবে সংশয় আমার ।

তখন তো মনে হবে আপনাদের নেতা-

গুরুভার, সহজে বহনযোগ্য নয়, সহজেও ত্যাগ করা সম্ভব নয়। অতএব,

এই ভালো, এখুনি বিদায়। (কাব্যনাট্যসমগ্র: ৩০৫)

হুমায়ুনের এই বাস্তবমুখী বক্তব্য মূলত লেখকের অন্তর্জাত দর্শন ও বিশ্বাসেরই প্রতিফলন। কেননা বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস এমনই বিপ্লব আর সংগ্রামের নামে বিশ্বাসঘাতকতা আর প্রতারণার পৌনঃপুনিক কাহিনি মাত্র। হুমায়ুনের সংলাপের মাধ্যমে রাজনীতির পুনরাবর্তিত ইতিহাসর প্রসঙ্গ উপস্থাপনের মাধ্যমেত তিনি যেন বাংলাদেশের আগাম রাজনীতির সম্ভাব্য গতিপথ অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। এতেই বোঝা যায় নান্দনিক শিল্পবোধের পাশাপাশি তাঁর রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, ইতিহাসজ্ঞান, সমাজতাত্ত্বিক চেতনা কতটা প্রখর ও তীব্র ছিল।

হুমায়ুনের ভগ্নহৃদয় আর নিঃসীম হতাশাবোধ প্রত্যক্ষ করে সানাউল্লাহ বুঝতে পারেন – রাজনীতির দাবাখেলা তাঁকে দিয়ে আর সম্ভব নয়। কেননা ‘অর্ধেক হৃদয় নিয়ে বিপ্লব চলে না।’ তাই হতাশহৃদয় সানাউল্লাহ নিজের পিস্তল দিয়ে হুমায়ুনকে গুলি করে হত্যা করেন, এবং নিজে এক প্রবল শোক আর শঙ্কা প্রতীক্ষার প্রহর গুণতে থাকেন। অতঃপর আকবরের ‘বাঁশিতে কোনো ছিদ্র নেই” এই প্রতীকী সংলাপের মধ্য দিয়ে নাটকের যবনিকাপাত ঘটে ।

শেকসপিয়রের জুলিয়াস সিজারে সানাউল্লাহর প্রতিরূপ কেসিয়াসের মৃত্যু ঘটে যুদ্ধপ্রান্তরে। আর হুমায়ুনের ছায়াচরিত্র ব্রুটাস নিজেই নিজের তরবারি দিয়ে আত্মহত্যা করেন। কিন্তু নাট্যকার সৈয়দ হক হুমায়ুন ও সানাউল্লাহর পরিণতি চিত্রাঙ্কনে নিজস্ব বোধ ও প্রতীতি প্রয়োগ করেছেন।

তিনি দেখিয়েছেন – যে সানাউল্লার কথায় মোহাবিষ্ট হয়ে একদিন ওসমানকে হত্যা করেছিলেন হুমায়ুন, নিয়তির পরিহাসে সেই সানাউল্লাহর পিস্তলেই হুমায়ুনের মৃত্যু ঘটলো। হতে পারে সানাউল্লাহর পতনও এভাবে ঘটবে অন্য কোনো বিশ্বাসঘাতক ক্ষমতালিপ্সুর ষড়যন্ত্রে।

এভাবেই চলতে থাকে রাজনীতির প্রবাহ। ইতিহাসের ঘটনাবলি এভাবেই পুনরাবৃত্ত হয়। সৈয়দ শামসুল হকের সার্থকতা এখানেই। একটি ক্লাসিক ট্রাজেডি নাটককে তিনি সমকালীন রাজনীতির সঙ্গে সমীকৃত করে অসাধারণ প্রজ্ঞায় পুনর্নির্মাণে সক্ষম হয়েছেন। অনুবাদ হয়েও তাই এটি হয়ে উঠেছে মৌলিক কাব্যনাটক। জনৈক সমালোচক এ নাটকের বিষয়বস্তু প্রসঙ্গে বলেন :

বাঙালির অবিসংবাদী গণনায়ক শেখ মুজিবুর রহমানকে কতিপয় স্বার্থবাজ, অপরিণামদর্শী, ক্ষমতালোভী ব্যক্তিকর্তৃক হত্যার ষড়যন্ত্র, হত্যা, অভ্যুত্থান, প্রতি-অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে পরিণামে সামরিক বাহিনীর প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্রক্ষমতার নিয়ন্ত্রক হয়ে যাওয়ার রাজনৈতিক ঘটনাস্রোত – বিষয়ের দিক দিয়ে এ নাটকের বঃিস্রোত। অর্ন্তবাস্তবতায় এ নাটক তৃতীয় বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রেরই রাজনৈতিক জীবনভাষ্য ।

গণনায়ক নাটকের চরিত্রায়ণে লেখক মূলত তিন ধরনের চরিত্র নির্মাণ করেছেন। রাষ্ট্রপতি ওসমানের শারীরিক উপস্থিতি এ নাটকে স্বল্পপরিসরে হলেও তিনিই এ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র। তাঁকে ঘিরেই বাকি চরিত্রগুলির ভাবনা-চিন্তা, ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া আবর্তিত হয়েছে। ওসমান চরিত্রকে কেন্দ্র করে অন্যান্য চরিত্রের গতিবিধি পরিচালিত হয়েছে প্রধানত তিনভাবে : প্রথমত যারা ওসমান চরিত্রের সরাসরি বিরোধিতা করে ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়ে তাকে হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করেছে।

 

গণনায়কের শৈলিবিচার

 

এ দলে আছে তথ্যমন্ত্রী মির্জা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী সানাউল্লাহ, প্রধানমন্ত্রী হুমায়ুনসহ অনেকেই। আরেকটি দলে আছেন তাঁরাই, যাঁরা ওসমানকে সমর্থন করেছেন; যেমন, রশীদ আলি, কাশেম খাঁ চরিত্রগুলি। আরেকদলে আছেন তাঁরা, যাঁরা ওসমানকে সমর্থন করলেও তাঁর অবর্তমানে চাতুর্যের সঙ্গে তাঁর ইমেজকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় আরোহণ করেছেন। সামরিক বাহিনীর প্রধান জেনারেল চৌধুরী মূলত এমন একটি চরিত্র।

গণনায়ক যেহেতু শেকপিয়রের জুলিয়াস সিজার নাটক দ্বারা প্রভাবিত, সেহেতু মূল নাটকের কিছু চরিত্রের প্রভাব এ নাটকে থাকাটা স্বাভাবিক। কারণ সৈয়দ শামসুল হক এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের পটে জুলিয়াস সিজার নাটকের নাট্যক্রিয়া ঢেলে সাজাতে চেয়েছেন। তিনি নিজেই ‘সবিনয় নিবেদন’ অংশে বলেছেন :

অনুবাদ আমি করিনি, রূপান্তরিত রচনাও একে বলা যাবে না; আমি বরং বহু পূর্বে গত এক অগ্রজের সঙ্গে বসে সচেতনভাবে নতুন একটি রচনায় হাত দিয়েছি। শেকস্পিয়র রচিত কিছু চরিত্র, কিছু দৃশ্য বর্জন করেছি; আবার নতুন কিছু অংশ রচনা করেছি, কিছু চরিত্রের নতুন লক্ষণ ও পরিণতি দিয়েছি; এসবই করেছি আমার অভিজ্ঞতা এবং সিদ্ধান্তগুলো স্থাপিত করার জন্যে। ( কাব্যনাট্যসমগ্র : ২২৯ )

গণনায়ক নাটকে নাট্যকার সর্বমোট একুশটি চরিত্রের ক্রিয়াশীলতা প্রদর্শন করেছেন । এর মধ্যে সতেরোটি আছে একক চরিত্র, আর চারটি দলীয় চরিত্র। উল্লেখ্য যে, এ নাটকের দলীয় চরিত্রের ভূমিকা ঠিক গ্রিক নাট্যধারার কোরাসের মতো নয়; কিংবা পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়ের গ্রামবাসী, বা নূরলদীনের সারাজীবনের লালকোরাস, নীলকোরাসের মতো নয়।

সেসব নাটকে দলীয় চরিত্রের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা গেছে – দলীয় চরিত্রগুলি একক চরিত্রের প্রভাবকেও ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু আলোচ্য নাটকে দলীয় চরিত্রগুলোর ভূমিকা পার্শ্বচরিত্রের অনুরূপ, এবং তারা ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিত্ব করায় নাটকে তাদের উপস্থিতি ও ভূমিকা স্বল্প পরিসরে ব্যাপ্ত।

ফলে পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়ের গ্রামবাসীর মতো নাটকে আদ্যোপান্ত প্রভাব বিস্তার করার সুযোগ তাদের ছিল না। যেমন : ছাত্রদল চরিত্রটি একটি দৃশ্যে এসে একটি দৃশ্যেই হারিয়ে গেছে। সংসদ সদস্য, প্রহরীগণ, মুক্তিযোদ্ধা চরিত্রগুলির ভূমিকাও তেমনি খাপছাড়া দু একটি দৃশ্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।

রাজনৈতিক নাটকের বৈশিষ্ট্যানুসারে এ নাটকের প্রধান দ্বন্দ্ব আবর্তিত হয়েছে একক চরিত্রগুলির নীতি ও আদর্শের ভিন্নতা এবং রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের চক্রান্ত নিয়ে। একক চরিত্রগুলি তাই এখানে অধিক প্রভাব বিস্তারক। দলীয় চরিত্রগুলি এদের সহায়ক শক্তি হিসেবে আবর্তিত। বস্তুত একক চরিত্রের ব্যবহারের শিকার দলীয় চরিত্র। যেমন, তথ্যমন্ত্রী মির্জার ধারণা – জনগণ রমণীর মতো। আবার জনগণ সম্পর্কে পররাষ্ট্র মন্ত্রী সিকান্দার বলেছেন, জনগণ ‘বেশ্যার মতো। যার হৃদয়ে একমুহূর্ত দাঁড়ায় না / কোনো অনুভূতি, স্থায়ী হয় না কোনো বেদনা, আচ্ছন্নতা।’

বস্তুত ‘কাব্যনাট্যে সাধারণত যন্ত্রণাবিদ্ধ আধুনিক মানুষের বেদনাবোধ ও সূক্ষ্ম মানসিকতার উপস্থাপন প্রক্রিয়া চলে। সৈয়দ শামসুল হক সচেতনভাবে গণনায়ক কাব্যনাটকে রাজনৈতিক ক্ষমতালিপ্সার মর্মভেদী বেদনাবোধ বিকারগ্রস্ত মানসিকতার উন্মোচন করেছেন। এ-নাটকটি যে প্রতিকূল সময় ও পরিবেশে তিনি রচনা করেছিলেন, সেই সময়ে এটিকে মঞ্চে আনার মতো সাহস কোনো নাট্যদল করতে পারেনি। সৈয়দ হকের ইতঃপূর্বেকার দুটি কাব্যনাটক প্রযোজনা করেছিল দেশের স্বনামধন্য দুটি নাট্যদল।

কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তারাও এ-নাটক প্রযোজনা প্রসঙ্গে দীর্ঘকাল নির্লিপ্ত থেকেছে। পরবর্তীকালে আতাউর রহমানের এক লেখনী মারফত জানা যায়, অধুনাবিলুপ্ত ‘চক্রবাক’ নামক একটি নাট্যদল এটিকে ঢাকার মঞ্চে এনেছিল। সম্ভবত পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনৈতিক ঘাত-প্রতিঘাত আর ক্ষমতার পালাবদলে রাজনীতি নির্ভর এ নাটকটিকে মঞ্চে এনে নতুন করে কেউই আর নিজেদের বিতর্কে জড়াতে চাননি।’

কিন্তু সময়ের সাথে সাথে পঁচাত্তরের ধাক্কা কাটিয়ে সাধারণ মানুষ অচিরেই সোচ্চার হতে শুরু করে। ফলে আশির দশকের শেষের দিকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে, এবং তৎসূত্রে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীশক্তি রাজাকার-আলবদরদের ঘৃণ্যভূমিকা বেশি করে আলোচনায় উঠে আসে।

কিন্তু এতৎসত্ত্বেও সৈয়দ হকের অন্যান্য নাটকের মতো এ নাটকটি মঞ্চে উপস্থাপিত হতে পারেনি। নাট্যজন লিয়াকত আলী লাকী গণনায়ক নাটকে নাট্যকারের সাহসিকতা এবং আশির দশকে নাটকটি মঞ্চায়নের একটি প্রচেষ্টার কথা জানিয়ে লিখেছেন :

১৯৭৫-এর বর্বরোচিত ঘটনার পর আমরা শিল্প-সাহিত্যের ভূমিকা বা শিল্পী, কবি, সাহিত্যিকদের অনুভূতি অনুসন্ধান করেছি। […] নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক-সহ অনেকে প্রতিবাদের ভাষা নিয়ে সাহসী পদচারণায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন।

আমরা সাহসী হয়ে শিল্প নিয়ে নেমে পড়েছিলাম পথে। […] বঙ্গবন্ধুর জীবনের ছায়াপাত ঘটিয়ে শেকসপিয়রের জুলিয়াস সিজার অনূদিত নাটক গণনায়ক মঞ্চায়ন করার স্বপ্ন তৈরি হলো। সময় আশির দশকের মাঝামাঝি। জননেত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলাম। তিনি বিশেষভাবে আগ্রহী হলেন, পাঠ করলেন নাটকটি। যদিও বেশকিছুটা অগ্রসর হয়েও নাটকটি মঞ্চস্থ করা যায়নি।’

সৈয়দ শামসুল হকের অন্যান্য নাটকে যেমন মঞ্চাভিনয় সম্পর্কে নাট্যকারের সুষ্পষ্ট নির্দেশনা মেলে, আলোচ্য নাটকে সেভাবে মঞ্চনির্দেশনা প্রত্যক্ষ করা যায় না। তবে দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে নাট্যকার দৃশ্য, সময় ও চরিত্রের অবস্থান সম্পর্কে ছোট ছোট বাক্যে নির্দেশনা প্রদান করেছেন। তবে পূর্ববর্তী কাব্যনাটকগুলোর মতো নাট্যপরিচালকের জন্য কোনো নির্দেশনা তিনি রেখে যাননি।

এর সম্ভাব্য দুটি কারণ হতে পারে : প্রথমত নাট্যকার ভেবেছেন এটি বহুল পরিচিত শেকস্পিয়রিয়ান নাটকের রূপান্তরিত নাটক যেহেতু, সেহেতু এটিকে মঞ্চে আনার জন্য নতুন করে নির্দেশনার প্রয়োজন নেই। আবার হতে পারে, পঁচাত্তর-উত্তর অস্থির সময় ওঅবরুদ্ধ রাজনৈতিক পরিবেশে এ নাটকটির মঞ্চায়ন নিয়ে তিনি নিজেই সন্দিহান ছিলেন।

তবে উদ্দেশ্য যাই হোক, তাঁর গণনায়ক নাটকটি সৃজনক্ষমতাগুণে অনুবাদ নাটকের খোলস কাটিয়ে বিষবস্তুর সাদৃশ্য থাকা সত্ত্বেও পরিপূর্ণ একটি মৌলিক রাজনৈতিক কাব্যনাটক হিসেবে বাংলা সাহিত্যে বিশেষ স্থান দখল করে আছে।

সৈয়দ শামসুল হক কাব্যনাটক রচনার পূর্বেই বাংলাসাহিত্যে একাধারে একজন সফল কবি ও ঔপন্যাসিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ফলে তিনি যখন কাব্যনাটক রচনায় মনোনিবেশ করেন, তখন নাটকের অভিনব প্লট সৃষ্টির পাশাপাশি নাটকের সংলাপগুলো অলঙ্কারবিন্যাসে নান্দনিক করে তোলেন। জনৈক সমালোচক গণনায়কের ভাষা ও ছন্দ সম্পর্কে নিম্নরূপ মন্তব্য করেছেন :

কাব্যনাট্যে কাব্যিক সৌন্দর্য ধরে রাখা খুব জরুরি নয়, এ কথা টি.এস. এলিয়টের মন্তব্য থেকে বলা যায়। কারণ, কবিতার স্বাদকে পাঠকের হৃদয়ে পৌঁছানোর জন্য এখানে কবিকে বেশ খানিকটা নির্মোহ থাকতে হয়। কাব্যনাট্যে নাটকের সঙ্গে মিশ্রিত অবস্থায় কবিতার সৌন্দর্য যুক্ত হয়ে থাকে। গণনায়ক কাব্যনাট্যে কাব্যসৌন্দর্যকে ধরে রাখাও কষ্টকর। […] লক্ষণীয় যে, এখানে কোনো গান বা কোৱাস নেই। নূরলদীনের সারাজীবন-এর মতো একে Musical Drama-র ফর্মে আনার চেষ্টা করেননি। শুদু গদ্যকে উপমা, উৎপ্রেক্ষা, স্বভাবোক্তি অলঙ্কারের অন্বিষ্টতায় গদ্যকাব্য করে তোলার প্রয়াসী হয়েছেন।

একজন কালোত্তীর্ণ শিল্পীর মতোই তিনি নাট্য-সংলাপের কাব্যগুণ সমুন্নত রাখার তুলনায় নাট্যগুণ বজায় রাখা ও নাট্যোৎকণ্ঠা নির্মাণে অধিকতর ব্রতী ছিলেন। এটি যেহেতু অনুবাদ নাটক, সেক্ষেত্রে মূল নাটকের সংলাপ ও ভাষার প্রভাব এখানে থাকবে সেটিই স্বাভাবিক। তবে সৈয়দ শামসুল হক ‘শেকসপিয়রের অনুকরণে গণনায়ক এর সংলাপ রচনা করলেও নাট্যকার বাংলায় রূপান্তরিত করার সময় তা নিজের করে নিয়েছেন।

বিশেষত তাঁর ভাষার গাঁথুনি প্রাতিস্বিকতায় অনন্য। আবার অনেকক্ষেত্রে শেকসপিয়রকে অনুসরণ না করেও অলংকার, চিত্রকল্প নির্মাণে নিজস্ব ভাষাবোধ ও কল্পনাশক্তি কাজে লাগিয়েছেন। বিশেষ করে চতুর্থ অঙ্ক থেকে ব্যবহৃত সংলাপের ভাষা, অলংকার-উপমা, চিত্রকল্প একান্তই তাঁর নিজস্ব রচনা। কেননা এখান থেকেই শেকস্পিয়রের কাহিনির তুলনায় তার কাহিনির ভিন্নতা শুরু হয়েছে। গণনায়কের সংলাপে ব্যবহৃত এমনই কিছু মাধুর্যমণ্ডিত উপমা, উৎপ্রেক্ষা, প্রবাদপ্রতিম বাক্যের দৃষ্টান্ত নিম্নে উপস্থাপন করা হলো :

উপমা :

১. জনগণ […] বেশ্যার মতো। যার হৃদয়ে একমুহূর্ত দাঁড়ায় না / কোনো অনুভূতি, স্থায়ী হয় না কোনো বেদনা, আচ্ছন্নতা। ( প্রথম অঙ্ক, প্ৰথম দৃশ্য)

২. বাংলার গ্রামে গ্রামান্তরে / ওসমান তখন উল্কার মতো ধাবমান, দাবানলের মতো জ্বলন্ত। (প্রথম অঙ্ক, দ্বিতীয় দৃশ্য)

৩. ভোরবেলায় পথের মোড়ে মস্তকবিহীন লাশের মতো / পড়ে থাকুন বঙ্গজননী । (পঞ্চম অঙ্ক, প্রথম দৃশ্য)

৪. যার কাজ হাড়িঠেলা, / চালাবেন তিনি আর চালিত হবে দেশ, বিনা প্রতিবাদে / জোয়াল বাঁধা মহিষের মতো মাথা নিচু করে ? (পঞ্চম অঙ্ক, দ্বিতীয় দৃশ্য)

৫. যাদুকরের মুষ্টিবদ্ধ হাত যেমন ধীরে ধীরে খুলে যায় / বেরিয়ে পড়ে পায়রা, তেমনি ওর ভেতর থেকে হঠাৎ জন্ম নিয়েছে দেশের জন্য ভালবাসা। (পঞ্চম অঙ্ক, দ্বিতীয় দৃশ্য)

৬. নদী যেমন প্রবল বেগে দক্ষিণের দিকে ধাবমান,/ বাংলার জনগণও রাজধানী ঢাকার দিকে, (প্রথম অঙ্ক, প্ৰথম দৃশ্য)

উৎপ্রেক্ষা :

১. যেনো কোনো দেশপ্রেমিক নন, তিনি তস্কর। (চতুর্থ অঙ্ক, দ্বিতীয় দৃশ্য)

২. লক্ষ লক্ষ হাত / উৎক্ষিপ্ত হলো আকাশে, যেন লক্ষ লক্ষ পতাকা এই একটি মানুষের জন্যে, (তৃতীয় অঙ্ক দ্বিতীয় দৃশ্য)

৩. কাশেম খাঁ যেন সদরঘাটে কোনো বিক্রেতা/সালসার বোতল হাতে পথচারীকে চিৎকার করে ডাকছে। ( প্রথম অঙ্ক, দ্বিতীয় দৃশ্য)

৪. রাষ্ট্রপতি ওসমানের চোখেমুখে একটা থমথমে ভাব, দলবল / যেন কঠোর কোনো শিক্ষকের পেছনে ছাত্রের পাল – / নীরব, নতমস্তক। (প্রথম অঙ্ক, দ্বিতীয় দৃশ্য)

৫. যে জিহ্বার ভাষণে / বাংলাদেশ ভাবাবেগে ভাসে, সেই জিহ্বা থেকে তখন আর্তির স্বর, যেন এক শীর্ণ বিড়াল। (প্রথম অঙ্ক, দ্বিতীয় দৃশ্য)

 

গণনায়কের শৈলিবিচার

 

রূপক / প্রতীক :

১. বুদ্ধিমান গৃহস্থ দেয়ালের সামান্য ফাটলে বটের চারা / কখনো বাড়তে দেয় না। ক্ষিপ্র হাতে উপ্রে ফেলে। (দ্বিতীয় অঙ্ক, প্রথম দৃশ্য)

২. বাঁশিতে কোনো ছিদ্র নেই। আমার দুঃস্বপ্নে দেখা / রন্ধহীন সেই বাঁশি পড়ে আছে দাবানলে দগ্ধ / এক ভয়াবহ প্রান্তরে একাকী। (পঞ্চম অঙ্ক, দ্বিতীয় দৃশ্য)

৩. সুস্থির চিত্তেই হাতে নিয়েছিলাম ছুরি / উচ্চাকাঙ্ক্ষার রশি কেটে দিতে। (চতুর্থ অঙ্ক, দ্বিতীয় দৃশ্য)

অতিশয়োক্তি :

১. সংগ্রামের জন্যে অর্থের যে প্রয়োজন, যদি সম্ভব হতো, / আমি আমার হৃদপিণ্ড গলিয়ে মুদ্রা বানাতাম, / দেহের প্রতি ফোঁটা রক্তকে রূপায় পরিণত করতাম,/ তবু দরিদ্র কৃষককে বঞ্চনা করে তার সঞ্চিত সামান্য অর্থ/ সংগ্রামের নামে, স্বাধীনতার নামে আত্মসাৎ করতাম না। (চতুর্থ অঙ্ক, দ্বিতীয় দৃশ্য)

২. উন্মোচিত করে দেখাই এই দেহ, যার ক্ষত নিজেই মুখর। / রক্ত নয়, শব্দ ঝরে এই ক্ষত থেকে, শব্দহীন অথচ মুখর। (তৃতীয় অঙ্ক, দ্বিতীয় দৃশ্য)

প্রবাদ, প্রবচন / প্রবাদপ্রতিম বাক্য :

১. অর্ধেক হৃদয় নিয়ে বিপ্লব চলে না। (পঞ্চম অঙ্ক, দ্বিতীয় দৃশ্য )

২. সময় আমাদের প্রতারিত করবে যদি / আমরা প্রতারণা করি সময়কে।(পঞ্চম অঙ্ক, দ্বিতীয় দৃশ্য)

৩. উচ্চারণ কখনো কখনো অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়। (চতুর্থ অন্ত, প্রথম দৃশ্য)

৪. সময়ের স্বভাৰ এই, সময় কাউকে সময় দেয় না। (চতুর্থ অঙ্ক, প্রথম দৃশ্য)

৫. ব্যক্তি করে ষড়যন্ত্র, / সমষ্টি বিপ্লব। (দ্বিতীয় অঙ্ক, প্রথম দৃশ্য)

৬. সত্য সর্বদাই অনুক্ত। / মিথ্যাই প্রবলভাবে ঘোষিত। (প্রথম অঙ্ক, প্রথম দৃশ্য)

৭. বড় নদী মরে গেলে, শাখা নদী এমনিতেই খুঁজে যায়। (দ্বিতীয় অঙ্ক, প্রথম দৃশ্য)

৮. গাছ যখন পড়ে যায় তার ডালে আর পাখি বাসা বাঁধে না। (দ্বিতীয় অঙ্ক, প্রথম দৃশ্য)

একটি বিশ্বখ্যাত ক্লাসিক নাটককে দেশীয় প্রেক্ষাপটে ঢেলে, তাকে আধুনিক কাব্যনাটকে রূপ দিতে সৈয়দ শামসুল হকের নিষ্ঠা ও পরিশ্রম সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। বিশেষত, সমরশাসকের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে নিজস্ব ভাবনা-চিন্তনের নিঃশঙ্ক প্রকাশের অসীম সাহস, সৈয়দ হককে স্বতন্ত্র মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। গণনায়ক নাটক সবদিক দিয়েই তাই নাট্যকারের একটি সফলতম শিল্পকর্ম ।

Leave a Comment