দ্বিতীয় পর্যায়ের গল্প (ষাটের দশক)

আজকের আলোচনার বিষয়ঃ দ্বিতীয় পর্যায়ের গল্প (ষাটের দশক)। যা আলাউদ্দিন আল আজাদের ছোটগল্পে জীবনবোধের রূপ রূপান্তরের অন্তর্গত।

 

দ্বিতীয় পর্যায়ের গল্প (ষাটের দশক)

 

দ্বিতীয় পর্যায়ের গল্প (ষাটের দশক)

ষাটের দশক পূর্ববাংলার জনসাধারণের জন্য অতি তাৎপর্যপূর্ণ একটি দশক। এ দশকের পুরোসময়ে উত্তাল রাজনৈতিক হাওয়া বয়ে যায়। বাহ্যিক চাপে এবং অভ্যন্তরীণ তাগিদে আলাউদ্দিন আল আজাদ এ সময়পর্বে অনেকটা গহনচারী শিল্পী। তবে ছোটগল্প রচনায় ষাটের দশকেও তিনি সমানভাবে দীপ্যমান। এ সময় পর্বে রচিত গল্পগুলোকে বিষয়বস্তুর ওপর ভিত্তি করে কয়েকটি শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা যায়। যেমন :

(ক) মনোগহনের বিচার বিশ্লেষণ যে সকল গল্পে প্রাধান্য পেয়েছে সেগুলো হল ‘বৃষ্টি’, ‘চুরি’, ‘পরী’, ‘পাশবিক’, ‘উজানতরঙ্গে’, ‘অন্ধকার সিড়ি প্রভৃতি।

(খ) কালিক ছাত্ররাজনীতির উত্তাল সময় যেসব গল্পে শিল্পরূপ লাভ করেছে। সেগুলো হল কয়েকটি কমলালেবু’, ‘ছেঁড়াকোট’, ‘পুনর্মিলন, ও ‘জবানবন্দী’।

(গ) গ্রামের শোষিত বঞ্চিত মানুষের প্রতিবাদী চেতনা সঞ্চারী গল্প ‘চিহ্ন’, ‘মাঝি’ ও ‘চারগুণ্ডা প্রভৃতি।

(ঘ) নাগরিক মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের টানাপোড়ন নিয়ে গল্প ‘সমতল’, ‘ছাতা’, “টেবিল ঘড়ি’, ‘কবি’, ‘আঁতুড় ঘর’, ‘উত্তাপ’ প্রভৃতি ।

আলাউদ্দিন আল আজাদ জীবন অনুসন্ধিৎসু শিল্পী । জীবনের মর্মমূলে আলো ফেলে জীবনের অন্তঃঅসঙ্গতি সন্ধানে সর্বদা তিনি ব্যাপৃত। সুবোধ ঘোষ কিংবা জগদীশগুপ্তের মতো ছোটগল্পে মানবিক কামনাবাসনা উপস্থাপনে তিনি অতি উৎসাহী। ষাটের দশকে রচিত ‘বৃষ্টি ‘ তাঁর শিল্পসফল সৃষ্টি।

‘বৃষ্টি’ গল্পটি লেখকের এক অসাধারণ নির্মাণ। বিদেশী ভাষায় অনূদিত এবং পুরস্কারপ্রাপ্ত এ গল্পটির কাহিনী অভিনব না হলেও এর উপস্থাপন কৌশল অত্যন্ত আকর্ষণীয়। বিমাতা ও সপত্নী পুত্রের আকর্ষণ-বিকর্ষণের কাহিনী এদেশে অভিনব নয় কিন্তু গল্পের বিশ্লেষণ ও পরিণামব্যঞ্জনা অসাধারণ। ‘বৃষ্টি’ গল্পটিতে একদিকে রয়েছে গ্রামীণ সমাজব্যবস্থার অন্ধ ভ্রান্ত কুসংস্কার, অপরদিকে দুর্বল শ্রেণীর প্রতি সবল শ্রেণীর কর্তৃত্বের বহিঃপ্রকাশ।

গ্রামের সম্পন্ন গৃহস্থ হাজী কলিমুল্লাহ বৃষ্টি না হওয়াকে কারো পাপের শাস্তি হিসেবে দেখেছেন। তাই তিনি খুঁজে বেড়াচ্ছেন পাপীকে। কাজের ঝি জৈগুনের মাধ্যমে সে পেয়ে যায় তার কাঙ্ক্ষিত পাত্রপাত্রীকে দরিদ্র বাতাসী ও তার মামাতো ভাই ম্যালেরিয়ার রোগী রহিমুদ্দিই সেই বিচারের বলি হয়।

বিধবা বাতাসী স্বামীর মৃত্যুর পূর্বে সন্তানসম্ভবা হয় কিন্তু হৃদয়হীন সমাজপতিরা তার আকুতি-মিনতি কানে দেয়নি। অনুমানের ওপর ভিত্তি করে হাজী সাহেব নৈতিক স্খলনের জন্য সদ্যবিধবা বাতাসী ও অসুস্থ রহিমুদ্দিকে পঞ্চাশ ঘা জুতোপেটার শাস্তি দিয়ে গ্রামছাড়া করেছে। কিন্তু তারই বাড়িতে তৃতীয়া স্ত্রী তরুণী রহিমা মিলিত হয় সপত্নী পুত্রের সঙ্গে।

অসহায় নারীর বিচার প্রক্রিয়া শেষে বীরদম্ভে বাড়ি ফিরে দেখতে পেল তরুণী ভার্যা বৃষ্টিতে ভেজার কৈফিয়ত স্বরূপ বলেছে, “বছরের পয়লাবৃষ্টি, ভিজলে খুব ভালো। এতে যে ফসল ফলবে। তিনি মানব মানবীর এই দৈহিক মিলনকে প্রকৃতি জগতের ঝড়ের উন্মত্ততার সঙ্গে একাকার করে শিল্পরূপ দিয়েছেন। যেমন:

“মেঘেদের হুড়োহুড়ি লুটোপুটি লেগে গেছে, মন্ত্রগর্জনে একেকবার কেঁপে কেঁপে উঠছে সারা পৃথিবী। একটানা ঝড়ের তীব্র বেগে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে গাছ পালা, মত্ত হয়ে কে যেন লেগেছে লুন্ঠনের উচ্ছৃঙ্খল তৎপরতায়। স্বর্গ-মর্ত্য পাতাল-মন্থন করে যেন এক মহা প্রলয়ের উচ্ছ্বসিত শব্দের ভয়ংকর সুন্দর রাগিনী।২

 

দ্বিতীয় পর্যায়ের গল্প (ষাটের দশক)

 

আলাউদ্দিন আল আজাদ তাঁর সৃষ্ট চরিত্রকে মনের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে বিচার বিশ্লেষণ করেছেন। এক্ষেত্রে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রকৃতি’, ‘চুরি’, ‘ফাঁসি’, প্রভৃতি গল্পের কথা উল্লেখ করা যায়। তিনি চুরি গল্পের প্রধান চরিত্র মাহতাবের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করেছেন। শৈশবের খেলার সঙ্গী কাজের ঝি সাজুর সঙ্গে মাহতাবের যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল দীর্ঘসময়ের ব্যবধানে তা আজ বিবর্ণ।

কেননা সাজু আজ হতদরিদ্র এক নারী আর মাহতাব অভিজাত্যের আসনে কেননা সাজু আজ হতদরিদ্র এক নারী আর মাহতাব অভিজাত্যের আসনে সমাসীন এক আইনজীবী। মানুষের সামাজিক অবস্থানের সঙ্গে মানব প্রবৃত্তির পরিবর্তন ঘটে। সে উপলব্ধিই মাহতাব করেছে। যেমন :

নিজের ব্যবহারের রূপান্তরের ছায়া দেখে, বিদেশী কায়দায় ধোপদুরস্ত, খাওয়া-দাওয়া খুঁতখুঁতে মাহতাব ও একটু বিস্মিত হয় বৈকি? তাহলে কি অস্তি- ত্বের দুটো স্তর? একটাকে সে জানে, এবং অন্যটাকে জানে না? বাইরের যে আবরণে সে বিলেত ফেরৎ তরুণ আইনজীবী সেখানে তো মাটির গন্ধও নেই, কিন্তু যেখানে কিশোরী সাজু জিহ্বা বের করে মুখ ভ্যাংচায় সেখানে তার পরিচয়? এই বুঝি সকলেরই অবস্থা। আসলে সব মানুষই নানা মানুষ”।

“একজোড়া নীলচোখ” গল্পে দেহজ কামনা বাসনার দিক প্রাধান্য পেয়েছে। শহরের তরুণ আর্টিস্ট গ্রামে যায় বন্ধুর বাড়িতে। বন্ধুর ছোট বোনের চঞ্চলতায় সে মুগ্ধ হয়। এক পর্যায়ে তাকে ভালোবাসার কথাগুলো চিঠির মাধ্যমে জানায়। কিন্তু চিঠিগুলো দেওয়ার জন্য কাজের ঝি আন্নিকে দেয়া হলে, সে চিঠিগুলো না দিয়ে নিজেই রেখে দেয় এবং আর্টিস্টের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে । মূলত একজোড়া নীলচোখ’ শেষ পর্যন্ত অতিকথকতায় পরিণত হয়েছে। এখানে লিবিডো ভাবনাই মুখ্য।

‘পরী’ গল্পটি আলাউদ্দিন আল আজাদের একটি দীর্ঘ গল্প। ধনু মোল্লা নামক এক বৃদ্ধের বিকৃত যৌন লালসার স্বীকার এক দরিদ্র গৃহবধূ। দারিদ্র্যক্লিষ্ট জীবন যাপন করে চোর রমু ও তার স্ত্রী। জীবিকার প্রয়োজনে পরী ধনু মোল্লার বাড়িতে ঝি-এর কাজ করে। একদিন স্বর্ণালঙ্কারের প্রলোভন দিয়ে পরীকে কাছে পায়। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সের স্বভাবধর্ম সব পণ্ড করে দেয়। ফলে হতাশায়, ক্ষোভে সকালে বাড়ির সকলকে ডেকে বলে যে, প্রথমা স্ত্রীকে সে স্বপ্নে দেখেছে এবং তাকে হজ্বে যাত্রার নির্দেশ দিয়ে গেছে। তার একথা বাড়ির সকলের কাছে বিশ্বাসযোগ্য না হলেও তারা মেনে নেয়।

পাশবিক’ গল্পে আলাউদ্দিন আল আজাদ কুতুব নামক এক দুর্ধর্ষ ডাকাতের কাহিনী তুলে ধরেছেন। মেঘনাপাড়ের ডাকাত সর্দার কুতুবের পাশবিকতা, হিংস্রতা আর উম্মাদনা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘প্রাগৈতিহাসিক’ গল্পের ভিখুর কথা মনে করিয়ে দেয়। নারী ও অর্থের প্রতি তাঁর প্রবল বাসনা। জয়নাবকে ধর্ষণের দায়ে তার সাত বছর জেল হয়। কুতুব মনে মনে কল্পনা করে জেল থেকে ছাড়া পেলে সৎপথে ফিরে আসবে, সংসারী হবে। লেখক তার মধ্যে সদর্থক উত্তরণ দেখিয়েছেন :

“তারপর করবে একটা বিয়ে এবং তখন জয়নাবকে যদি না পায়, দেখে শুনে এমন একটা মেয়ে খুঁজে নেবে যে হবে ঠিক তারই মতো।

‘উজান তরঙ্গ’ লেখকের দীর্ঘ আকৃতির গল্প। রোমান্টিকতার আবরণে গড়ে ওঠা গল্পটিতে আছে যমুনা ও জুলমতের ভাগ্য বিড়ম্বনার ছবি। মেঘনাপাড়ের তরুণী যমুনা। তার কৈশোরের সঙ্গী জুলমত। দেশবিভাগের বিভীষিকা যমুনাকে শেষ পর্যন্ত বেশ্যালয়ে নিয়েছে। এক বারবণিতা হিসেবে সমাজে তার পরিচয়। এমন সময় পিতার মৃত্যু হলে জুলমতের সাহায্যে গ্রামের যায় এবং পিতার শবদাহ সম্পন্ন করে। জুলমতের নৌকায় করে যখন যমুনা শহরে ফিরছিল তখন তার মধ্যে মাতৃত্বের এক অদম্য বাসনা জেগে ওঠে।

 

দ্বিতীয় পর্যায়ের গল্প (ষাটের দশক)

 

সে কোলে তুলে নেয় জুলমতের মাতৃহারা শিশুপুত্রকে। জুলমতও চায় তার সন্তানের মা। অবশেষে জুলমত ও যমুনা সিদ্ধান্ত নেয় তারা একত্রে ঘর বাঁধবে। কিন্তু সমাজ কি যমুনাকে মেনে নেবে? এই দুর্ভাবনায় তারা চিন্তিত। যমুনা তার নরক জীবন যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে চায়, ফিরে পেতে চায় স্বাভাবিক জীবন। এ কারণে তারা পাড়ি জমায় অজানার উদ্দেশ্যে। যেমন :

‘এখন আবার থইথই করছে মেঘনা, ধারাল হাওয়ায় ঢেউয়ের মিছিল, গ্রামের দিকে ফিরতি যাত্রার বৈঠা বাইতে একেকবার ফুলে ফুলে উঠছে হাত পায়ের পেশীগুলো, মুখ দিয়ে যেন ছুটছে ফেনা। কিন্তু তবু জুলমত এতটুকু ক্লান্ত নয়। প্রয়োজন হলে উজান ঠেলে ঠেলে তাকে যেতে হবে আরও অনেক দূরে। হয়তো পাহাড়ের কাছে বা জঙ্গলের ধারে, অথবা নতুন কোনো জনপদ পর্যন্ত। কিংবা হয়তো আরও দূরে, অন্য কোথাও ।

‘অন্ধকার সিঁড়ি, গল্পটিতে ধরা পড়েছে আধুনিক পণ্যজীবী সভ্যতার ক্লেদাক্ত রূপ। অভাব দারিদ্র্যের কারণে নীলা নামের এক তরুণী বিপদগামী হয়। পুঁজিবাদী সভ্যতার ভোগের উপাচারে পরিণত হয় সে। এক পর্যায়ে নীলার মধ্যে জাগে পাপবোধ। ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে সে মুখোমুখি হয় অস্তিত্বের। তার মনোবিশ্লেষণই এখানে মুখ্য হয়েছে। ডাক্তার প্রেমিক কর্তৃক গর্ভের সন্তানকে অস্বীকার তাকে নিঃসঙ্গ করেছে।

ষাটের দশকে পূর্বপাকিস্তানের সচেতন মধ্যবিত্তের মধ্যে স্বায়ত্তশাসনের বাসনা প্রবল হয়। কেননা পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের বহুবছর পার হয়ে গেলেও পূর্বপাকিস্তানের মানুষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকার আশানুরূপ ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়। ফলে ছাত্র জনতার মধ্যে চাপা ক্ষোভ উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকে।

এ সময় পূর্ববাংলার স্বার্থরক্ষার জন্য নানা ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন আন্দোলন করতে থাকে। সমকালের রাজনীতির চালচিত্র নিয়ে লিখেছেন কয়েকটি কমলালেবু। বাস্তব ঘটনার প্রেক্ষাপটে গল্পটি রচিত, মুর্তাজা নামের এক ভক্ত বিপ্লবী ইলা মিত্রের সহযাত্রী। সে অতিকষ্টে শেষ পর্যন্ত এক কোম্পানির লেবেল অঙ্কন করে পাঁচ টাকা সম্মানী পেয়েছে এবং সেই টাকা দিয়ে কয়েকটি কমলালেবু কিনে নেয় প্রিয় নেত্রীর জন্য।

আলাউদ্দিন আল আজাদ সময়কে শব্দবন্দী করেছেন। শিল্পী মুর্তাজার ভাবনায় সমকালের রাজনৈতিক নেতাদের ওপর দহন, নিপীড়ন, নির্যাতনের প্রসঙ্গ ফুটে উঠেছে। তাইতো এই শিল্পী কমলালেবুগুলোকে বিপ্লবী মানুষের মাথার খুলির সঙ্গে যুক্ত করে দেখেছেন :

“আজকে বাসায় ফিরে গিয়ে রাত্রেই একটা স্টীল লাইফ কম্পোজ করবে। কম্পোজ করবে মানুষের মাথার একটা খুলির সঙ্গে কয়েকটি টসটস্ে তাজা কমলালেবুর রক্তিম স্তবক।

‘গুহাচিত্র’ গল্পটিতেও কালিক ছাত্র আন্দোলনই মুখ্য। গল্পের নায়ক প্রদোষ একজন রাজবন্দী। তার ভাবনায় ধরা পড়েছে সমকালের মধ্যবিত্তের সংগ্রাম, অর্থনৈতিক মন্দা, সরকারের অত্যাচার নির্যাতন প্রভৃতির চিত্র। আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘জবানবন্দী’ গল্পটিও একই বৃত্তের। গ্রাম থেকে শহরে আসা এক নিরীহ ছাত্রের দেশের স্বার্থচিন্তা এবং ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হওয়া গল্পের মুখ্য বিষয়। গল্পের প্রধান চরিত্র সাজ্জাদ তারই সহযাত্রী জেবুন্নিসার সঙ্গে সমকালের বিভীষিকাময় পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করছে। :

“সাজ্জাদ গরম হয়ে উঠল, ধৃষ্টতার ও একটা সীমা থাকা উচিত। দিনের পর দিন এই রাবিশ প্রপাগান্ডা কত টলারেট করা যায়। এরা প্রচার করছে, এদের মতো দেশ প্রেমিক ইহসংসারে নেই। কিন্তু বলি, জনসেবার নামে কারা বারবার তহবিল তছরুপ করছে। সাড়ে চারকোটি মানুষকে অজ্ঞ করে রেখেছে কারা? বুঝতেই যখন পারছে, নৈরাশ্যের কথা বলছ কেন? জেবুন্নিসা বললো। তার জবাব না দিয়ে সে বলতে লাগল, ভেবে অবাক হয়ে যাই একটু চিন্তার স্বাধীনতা যেখানে নেই, সে জাতি কেমন করে বাঁচাতে পারে, না, না জীবন অসহ্য। গলায় ফাঁস নিয়ে আমি বাঁচাতে পারব না।’

ছোটগল্পের শিল্পী হিসেবে আজাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল মনোবিশ্লেষণ করা। হোক তা রাজনীতি, প্রতিবাদী কিংবা শ্রেণী সংগ্রামের চিত্র। ‘পুনর্মিলন’ গল্পের নায়ক আনোয়ার রাজবন্দী হিসেবে জেল খেটেছে। আনোয়ার ছাত্রনেতা, দেশের জন্য কাজ করতে গিয়ে সরকারের রোষানলে পড়ে। মূলত গল্পটি অনেকটা লেখকের আত্মজৈবনিক ভাবনা। ভাইতো জেল হাজতের বাস্তব বর্ণনা গল্পটিকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।

 

দ্বিতীয় পর্যায়ের গল্প (ষাটের দশক)

 

“আধো আলো আধো অন্ধকার পাঁচ মিশালী শব্দ ও গলার স্বর শুনতে শুনতে সে জেলগেটে এসে দাঁড়াল লোহার বিরাট ফটকটা খুলে দিতেই শ্লোগান দিয়ে এগিয়ে এল কয়েকটি ছেলে, একজনের হাতে কয়েকটি ফুলের মালা। বুকে বুক মিলিয়ে কিছুক্ষণ কোলাকুলি করার পর জিগেশ করে জানতে পারল, এরা প্রায়ই আসে, জেলগেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে সরকারের যে নীতি, যদি কেউ ছাড়া পেয়ে যায়। আজকেও কয়েকজন এসেছিল এমনি একটি সম্ভাবনায়। ”

আলাউদ্দিন আল আজাদের ষাটের দশকের গল্পে উদিয়মান মধ্যবিত্তের স্বপ্ন, আশা, আকাঙ্ক্ষা শিল্পরূপ লাভ করেছে। ‘ছেঁড়াকোট’ গল্পেও এক ছাত্রনেতার কাহিনী। রাজনীতির কারণে ছাত্রনেতা আশরাফ ঘরছাড়া, স্বজনহারা ও পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে সে একমাত্র কন্যার জন্মদিনে নিজের কোটটি বন্ধুর কাছে রেখে, দশটি টাকা নিয়ে উপহার কিনে নিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত লাঞ্ছিত হয়ে ফিরে আসে।

কেননা স্ত্রীর সঙ্গে তার বিচ্ছেদ ঘটেছে ইতোমধ্যে। আলাউদ্দিন আল আজাদের দার্শনিক চিন্তার প্রকাশ ঘটেছে ‘কবি’ গল্পে। এ গল্পের নায়ক আবু মহসিন আচার আচরণে একজন কবি ও একজন প্রেমিক। গৃহশিক্ষকতা করতে গিয়ে ভালোবেসেছিল গ্রামের এক সহজ সরল মেয়ে দুলিকে। কিন্তু একজন কবির প্রেমে মিলন তার স্বভাবের পরিপন্থী, বিচ্ছেদে তার পরিপূর্ণতা।

এরপর গ্রাম থেকে শহরে আগমন কবি আবু মহসিনের। পত্রিকার এক হকার থেকে হকার সমিতির সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হবার পর তার বক্তৃতা সকলের চেতনায় আঘাত করে। সে সকলের উদ্দেশ্যে বলেছে, আমাদের বাঁচতে হবে, বাঁচার পথ খুঁজতে হবে। এক্ষেত্রে সে একতার ওপর জোর দিয়েছে।

“আমি বলছি সে পথ হল একতা। লোহদৃঢ় ঐক্য। আমরা যদি ধীরে ধীরে একতাবদ্ধ হয়ে উঠতে পারি, তাহলে মরবনা, কিছুতেই না।

‘এক হাজার একরাত্রি’ গল্পে একদিকে আছে স্বদেশপ্রেমিক যুবকের আত্ম বিসর্জনের কাহিনী অপরদিকে রয়েছে নগরজীবনের ক্লেদাক্ত রূপ। গল্পটি গড়ে উঠেছে মূলত মীরা নামধারী এক বারবণিতার স্মৃতিকথায়। গভীররাত্রে পুলিশের তাড়া খেয়ে পতিতা নারীর কামরায় ঢুকেছে এক রাজনৈতিক কর্মী। সে সরকারের নীতির বিরোধিতা করেছে বলে পুলিশের খাতায় তার নাম উঠেছে।

তাই সে পুলিশের নিপীড়ন থেকে বাঁচার জন্য পালিয়ে বেড়াচ্ছে এবং সে কথাই সে মীরা নামক তরুণীকে বলেছে :

“আমি চোর নই, দেশের কাজ করি, বলে ওরা আমাকে জেলে পুরতে চায়। কথা দাও কিছু বলবে না। ১০

মূলত গণতন্ত্রের জন্য এদেশের মানুষের দীর্ঘদিনের আন্দোলন এখানে ধরা পড়েছে। ‘জলটুঙি’ গল্পটিও একই ধারার গল্প। ছাত্র রাজনীতিতে সম্পৃক্ত ফেরারী পুত্র আলী আকবরের জন্য মা আমেনা বেগম ও বাবা আনিস মুন্সির বেদনা এখানে মুখ্য হয়েছে।

ষাটের দশকে রচিত গল্পগুলোর মধ্যেও গ্রামীণ পটভূমি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। প্রতিবাদী চেতনায় ভাস্বর গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকার চিত্র আঁকতে গিয়ে তিনি কৃষক-শ্রমিক-মজুর শ্রেণীর স্বার্থরক্ষার কথা বলেছেন। কায়িক শ্রমে বিপর্যস্ত মানুষের মুক্তির বাণী তাঁর গল্পে পাওয়া যায়।

শোষণহীন সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন তিনি দেখেছেন। মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র ও ধলেশ্বরী বিধৌত বাংলার বিশাল জনপদের বিচিত্র জীবনধারা তাঁর গল্পে একটি বিশিষ্ট মাত্রা লাভ করেছে। সমাজে বিরাজমান শ্রেণীবিভেদ, বৈরিতা এবং শোষকবর্গের নগ্নতা উম্মোচনে ষাটের দশকের কিছু গল্প যেন আলাউদ্দিন আল আজাদের পঞ্চাশের দশকের গল্পের সগোত্রীয়। জীবনঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণ তাকে একজন সমাজমনস্ক শিল্পী হিসেবে পরিচিতি এনে দিয়েছে।

গ্রামের শোষিত বঞ্চিত মানুষের প্রতিবাদী চেতনা নিয়ে লিখেছেন ‘মাঝি’ গল্পটি। শ্রেণীবিভক্ত সমাজের রূপ পরিবর্তনে ‘মাঝি’ গল্পটি উদ্বুদ্ধকরণে ও উজ্জীবনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে নিঃসন্দেহে। এ গল্পে আছে শোষক শ্রেণীর বিরুদ্ধে আলী মাঝির প্রতিরোধের চিত্র।

টাকাওয়ালা জহর ব্যবসায়ীর কাছে পাওয়ানা টাকা চাইতে গেলে তাকে জুতা মারে জহর। ফলে তার প্রতিশোধের বাসনা এক সময় বহ্নিশিখার ন্যায় জ্বলে ওঠে। এ পর্যায়ে সুযোগ বুঝে মাঝি তার দুই পুত্রকে নিয়ে ব্যবসায়ী জহরকে আক্রমণ করে। আঞ্চলিক উচ্চারণে ও সংলাপে গল্পটি হয়েছে। প্রাণবন্ত হয়েছে।

“চুপ ! তীব্র তির্যক কণ্ঠে ধমক দিয়ে ওঠে আলী চুপ মাইয়া থাক্ হারাম জাদা। আমার মুহে জুতা মারছিলি মনে আছে? খুন করুম তবে আজগা! খুদার নাম নে! জনু রামদাশুড়া বার করছ্যানরে । ১১

জহরকে প্রাণ মারেনি আলী কিন্তু তার বক্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ “একটারে খাদাইয়া কি অইব রে! থাক্। ১২

‘চিহ্ন’ গল্পে গ্রামের এক দরিদ্র কৃষকের শোষিত হওয়ার কাহিনী কয়েকটি শব্দগুচ্ছের মাধ্যমে আলাউদ্দিন আল আজাদ বন্দী করেছেন। ‘চিহ্ন’ গল্পের চিহ্ন মূলত নিম্নবিত্তের শরীরে ক্ষমতাবানদের চাবুকের চিহ্ন। এ গল্পের নায়ক কামু ও নায়িকা কৃষাণী আদালত অভাব দারিদ্র্যে দিন যাপন করে। একদিন স্বামী-স্ত্রী পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেয় যে, কামু হাটে সুপারি বিক্রি করবে। সে হাটে গিয়ে সুবিধামত একটি স্থান বেছে নেয় কিন্তু এক শ্রেণীর সুবিধাবাদী ক্ষমতাবান লোক তাকে বাধা দেয়। এর ফলে রুখে দাঁড়ায় কামু। সে নির্যাতিত হয়ে ফিরে আসে বাড়িতে। দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার অমানবিক। যেমন

“গোনাগুনতি পাঁচটি চাবুকের দাগ, পিঠের একধার থেকে অন্যধার পর্যন্ত সাপের মতো জড়ানো ফুলে ওঠা, কালো নীল হয়ে যাওয়া পাঁচটি চাবুকের দাগ। ১০

‘চারগুণ্ডা’ গল্পটি নরসিংদী জেলার তাঁতিদের নিয়ে রচিত। ‘চিহ্ন’ গল্পের মত ‘চারগুণ্ডা’ গল্পেও আছে সুবিধাবাদী শ্রেণীর বিরুদ্ধে শোষিত-বঞ্চিত শ্রেণীর রুখে দাঁড়াবার ইতিকথা। তাঁতিদের পারমিটের সুতা তাদের না দিয়ে বরং এক শ্রেণীর দালাল সেগুলো খোলা বাজারে বিক্রি করে অধিক মুনাফা অর্জন করে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় স্বল্প পুঁজির তাঁতিরা। এই অন্যায়ে বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় ইবু, কালু, মালু ও জৰু নামের চারগুণ্ডা।

 

দ্বিতীয় পর্যায়ের গল্প (ষাটের দশক)

 

আলাউদ্দিন আল আজাদ ষাটের দশকে বেশ কিছু ব্যতিক্রমধর্মী গল্প লিখেছেন। এসব গল্পে তিনি মানবতার অবমাননা, লাঞ্ছনা প্রভৃতি তুলে ধরেছেন। বৈষম্যমূলক সমাজব্যবস্থার অন্তর্গত অসঙ্গতি উপস্থাপনে তিনি দক্ষ শিল্পীর ভূমিকা পালন করেছেন। শহরের উচ্চবিত্ত মানুষেরা অভিজাত্যের নামে বিদেশী সংস্কৃতি লালন করে, বিলাসিতায় মগ্ন হয়।

অপরদিকে সেই সমাজেই নিঃস্ব, রিক্ত পর্দকশূন্য মানুষেরা খাদ্য ও আশ্রয়ের সন্ধানে দিশেহারা। এরকম কাহিনীকে প্রেক্ষাপটে রেখে রচনা করেছেন ‘আঁতুড় ঘর’ গল্পটি। এ গল্পে আছে গ্রাম থেকে শহরে আসা এক ভিক্ষুক দম্পতির দুঃখগাঁথা। স্বামী সলিমুদ্দি অন্ধ। স্ত্রী রহমজানকে নিয়ে শহরের খোলা আকাশের নিচে দিন যাপন করে। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে নিয়ে এক সাহেবের বাড়ির নিচতলার ঘরে স্থান পায়, অবশ্য বাড়ি ওয়ালার অজান্তে।

সেখানেই পুত্র সন্তানের জন্ম দেয় রহমজান। অপরদিকে একই কক্ষে একটি বিদেশী কুকুরও সাহেবকে কয়েকটি বাচ্চা উপহার দিয়েছে। এতে সাহেবের অভিজাত্য বেড়েছে তাইতো সে কুকুরছানার জন্য প্রচুর খাবার ও আরামদায়ক বিছানার ব্যবস্থা করে দেয়। লেখক এখানে দেখিয়েছেন যে, সমাজের দারিদ্র্য ও অভিজাত্যের দ্বৈত যাত্রা। গরিবের সন্তানের জন্য নেই কোন অভ্যর্থনা, নেই পোশাক, খাদ্য ও আবাসভূমির ব্যবস্থা। নাগরিক সমাজের গলদ, সমাজের উঁচু শ্রেণীর বৈষম্যমূলক মনোভঙ্গি, বিলাসিতা, বিদেশীয়ানা উপস্থাপনে লেখকের সমাজ সচেতন মনের পরিচয় পাওয়া যায়।

শ্রেণীসচেতন শিল্পী আলাউদ্দিন আল আজাদ মানুষের স্বার্থপরতা, পারস্পরিক বিভেদ, আর্থিক সংকট, মন্বন্তর, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে তিনি নিরলসভাবে লিখেছেন। ‘উত্তাপ’ গল্পে যেমন দুর্ভিক্ষের কথা আছে তেমনি সমাজ নিয়ে প্রধান চরিত্র জহিরের ভাবনায় যেন লেখকেরই আত্মগত উচ্চারণ ধরা পড়েছে।

“সুতরাং জীবনের স্নিগ্ধ শ্রীর স্পর্শ সে পায়নি। তাছাড়া লাখো মানুষের অদৃশ্য কঙ্কালের ওপর যে সমাজ দাঁড়িয়ে আছে, তার মূল্যবোধে ওর কোনো বিশ্বাস নেই, কারণ এখানে সুখ মানেই স্বার্থপরতা, প্রাচুর্য মানেই বঞ্চনা। নিজের চেষ্টা ও সাধনায় সে উচ্চশিক্ষা লাভ করেছে এবং সামাজিক মর্যাদার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু তা বলে মাটির ভিত ছেড়ে কৃত্রিম অভিজাত্যের ওপর তলায় আরোহণ করতে সে রাজী নয়।

ষাটের দশকে আলাউদ্দিন আল আজাদ বেশ কিছু গল্পে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের আর্থিক দৈন্য, টানাপোড়ন ও জীবনযাত্রার চিত্র এঁকেছেন। ‘সমতল’ গল্পটি এক্ষেত্রে মধ্যবিত্তের দিনলিপি। এ গল্পের রশিদ সাহেব, করিম সাহেব, গফুর মাস্টার, সালাম সাহেব ও জমির সাহেব প্রত্যেকেই প্রত্যেকের কাছে মিথ্যাচার ও ছলনার আশ্রয় নিচ্ছে। গল্পটিতে মধ্যবিত্তের আর্থিক সংকট অত্যন্ত স্পষ্ট।রশিদ সাহেব অতিকষ্টে কন্যাকে পাত্রস্থ করেছেন কিন্তু শ্বশুর বাড়িতে যৌতুকের দাবী মেটাতে না পারায় রানী নির্যাতিত হয়ে ফিরে এসেছে। গল্পের একাংশ এখানে উল্লেখযোগ্য :

“বারান্দায় গিয়ে সকলে বিস্ময়ে বেদনায় হতবাক। একি! রানী দাঁড়িয়ে আছে, রানী। তাদের এককালের পরম আদরের চপলা শ্যামলী সুন্দরী, বড় মেয়ে রানী। রানী না কোনো ভিখারিনী পাগলী, কোলে তার দেড় বছরের বাচ্চাটা গলার কণ্ঠি দেখা যাচ্ছে, মুখখানা পান্ডুর বিবর্ণ, এক যুগ তেল না পড়া শনের মতো খড়খড়ে চুল উড়ছে। পরনে বহুব্যবহৃত তেনার মতো বিদঘুটে ময়লা পড়া আধছেঁড়া কাপড়। বারান্দায় নিচে জবজবে ভেজা চালু জায়গাটায় খালি পায়ে অর্থহীন দৃষ্টি মেলে সে দাঁড়িয়ে আছে।

 

দ্বিতীয় পর্যায়ের গল্প (ষাটের দশক)

 

তাঁর ষাটের দশকের গল্পের চালচিত্র সরে এসেছে গ্রাম থেকে শহরে। স্বল্প আয়ের এক কেরানির কঠিন জীবন সংগ্রামের কাহিনী নিয়ে গড়ে উঠেছে ‘ছাতা’ গল্পটি। একআনা, দু আনা সঞ্চয় করে কেরানি আমিনুদ্দিনের স্ত্রী ছাতাটি ক্রয় করেছিল। স্কুলগামী পুত্রের বৃষ্টির কারণে ছাতা প্রয়োজন কিন্তু সমস্যা হল ছাতা একটি। নিম্নমধ্যবিত্তের কঠিন জীবন সংগ্রাম এখানে স্থান পেয়েছে।

পিতা পুত্রকে ছাতাটি দিয়ে নিজে বৃষ্টিতে ভিজে অফিসে যায় এবং সহকর্মীদের সঙ্গে বৃষ্টিতে ভেজার নানা মিথ্যে অজুহাত দেখায়। অথচ দ্বিতীয় আরেকটি ছাতা কেনার সামর্থ্য তার নেই। বৃষ্টিতে ভিজে অফিসে যাওয়ার কারণে সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। অসুস্থ স্বামীর পাশে বসে স্ত্রী রোকেয়া বানুর অনিশ্চয়তা ও দুর্ভাবনাই এখানে প্রাধান্য পেয়েছে।
“আমারে মেরে ফেলার ফিকির করেছে। কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে পথে বসাতে চায়। ভিক্ষে করাতে চায়। নিজে মরে আমাদের সবাইকে মারতে চায়। ১৬

নিম্ন মধ্যবিত্তের জীবন নিয়ে রচনা করেছেন ‘টেবিল ঘড়ি’ গল্পটি। গ্রাম থেকে শহরে আসা এক দম্পতির কঠিন জীবন সংগ্রাম গল্পটির বিষয়। একটি টেবিল ঘড়িকে কেন্দ্র করে স্বামী-স্ত্রীর অভিমান গল্পটিকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে। স্বল্প আয়ের নাগরিক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিনিধি তারা। নগর জীবনের ক্লান্তি, হতাশা, অবসাদ অভাব প্রভৃতি দুঃসহ জীবনযন্ত্রণা কেরানির জবানিতে ব্যক্ত হয়েছে। যেমনঃ

“মুশকিল হয়েছে শহরে এসে, এখানে সামান্য পানিটুকুও পয়সা না দিলে মেলে না। একশ বারো টাকা আট আনা মাইনে, তা থেকে বাড়িভাড়াই চলে যায় পঁচিশের মতো এদিকে কাপড় জামা বলতে কিছু নেই তিথিয়ে যাওয়া, আধছেঁড়া, আধময়লা পরিধেয় কোন রকমে লজ্জা নিবারণ করে মাত্র, আর তাতে যতটুকু প্রয়োজন মেটে তার চাইতে অনেক বেশি ফুটে ওঠে দৈন্য। ১৭

মূলত ষাটের দশকের গল্পগুলো বিষয়বৈচিত্র্যে অনন্য ও অসাধারণ। মানুষের জীবন ও সমাজ তাঁর ভাবনার মূল। পঞ্চাশের মতো ষাটের দশকেও তাঁর প্রতিবাদী জীবন দর্শন স্পষ্ট। সংগ্রামী মানুষের প্রতি তাঁর অপরিসীম দরদ । জনমানুষের সংগ্রাম তাঁর প্রধান বিষয় হলেও কাহিনীকেই তিনি প্রাধান্য দেননি বরং দক্ষ শিল্পীর ন্যায় চরিত্রের মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণ করেছেন।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment