আজকে আমাদের আলোচনার বিষয়ঃ গ্রামজীবন ভিত্তিক ছোটগল্পগুলির শিল্প মূল্যায়ন। যা বাংলাদেশের ছোটগল্পে গ্রামজীবনের এর অন্তর্গত।

গ্রামজীবন ভিত্তিক ছোটগল্পগুলির শিল্প মূল্যায়ন
লেখকেদের অনুভবে যুগধর্ম ক্রমাগত আবর্তিত হয়, সেই অনুভবের আবর্তনে লেখকের রচনায় একটি যুগ তার বিষয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে উপস্থাপিত হয়। তৃতীয় বিশ্বের একটি জনবহুল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জীবন, অভাব অনটন, রাজনীতির অপকৌশল, দুর্নীতিবাজ আমলা ও অসাধু ব্যবসায়ী মহলের জন নিপীড়ন, বর্ধিষ্ণু জনগোষ্ঠীর জীবিকা সংকট, অশিক্ষা, কুসংষ্কার এই সব নির্মম বাস্তবতা বাংলাদেশের কথা – সাহিত্যের তথা গল্পের ভিত্তিমূল গড়ে তুলেছে।
শিল্পের দাবীতে বাস্তবতাকে আংশিক পরিহার করে ফাঁকা স্থানটুকু নন্দনতাত্ত্বিক ঐশ্বর্যে ভরে দেয়া বর্তমান যুগবাস্তবতার দাবীতে গল্পকারেরা ত্যাগ করেছেন। কথা সাহিত্যিকেরা এখন নতুন সমাজব্যববায় সাহিত্যে কঠোর বাস্তবভিত্তিক এক নতুন মূল্যবোধের প্রকাশ ও প্রয়োগে বেশি উৎসুক।
প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও সাহিত্য সমালোচক হাসান আজিজুল হক তার “দুষ্পাঠ্য কররেখা : আমাদের কথাসাহিত্য” প্রবন্ধে বলেছেন, “বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের বড়ো অংশ সম্বন্ধে একটা কথা বোধহয় মেনে নেওয়া যায় যে, সেখানে যাদের দেখা আমরা পাই তারা সবাই সাধারণ মানুষ, আরও স্পষ্ট কথায় গ্রামের মানুষ।”
কথাসাহিত্যে পেয়েছি বাংলাদেশের গ্রামের স্থিরচিত্র, দুঃখ বা সুখের, গ্রাম হারানোর বিলাপ শহর জীবনের প্রতিতুলনায় গ্রামের নিশ্চিত নির্ভয় কোটরাগত জীবনযাপনের মোহ। “১ যদিও পঞ্চাশ দশকের পর থেকে বাংলাদেশের সাহিত্যে গ্রামজীবনের উপস্থিতি ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে, কিন্তু এ পরিবর্তনের গতি ও প্রকৃতি সম্পর্কে হাসান আজিজুল হক মন্তব্য করেন- “এজন্যে শহরের স্ফীতি ও চাকচিক্য চোখে একটা ধাঁধা সৃষ্টি করলেও, বাংলাদেশের গ্রাম সমাজ সে জৌলুস ও চাকচিক্য থেকে বহুদূরেই থেকে যায়।

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তিনের দশকে পদ্মা নদীর মাঝিদের এবং গাওদিয়া গ্রাম নিয়ে যে উপন্যাস লিখেছিলেন তা আধুনিক শহুরে স্পর্শদোষশূন্য স্থবির গ্রাম সমাজেরই কাহিনী। তিনি কখনো সঙ্কীর্ণ ও বানিয়ে তোলা শহর নিয়ে অভিভূত হয়ে পড়েন নি বরং স্বল্প শিল্প বিকাশে সমাজে যে ভাঙন ও বিপর্যয় দেখা দিয়েছিলেন তার কথাই লিখেছিলেন।
তিনি যখন শহরের কথায় ফিরে আসেন, তখন শহরের ফাঁকি ও অন্তঃসারশূন্যতা, বস্তির জীবন, মারি ও মন্বন্তরের কথাই আমাদের শোনাতে চান শহুরে সভ্যতার ফসল খুব স্বাভাবিকভাবে গ্রাম সমাজের গোলায় না উঠলে আমরা যে মূলতঃ গ্রামীণ থেকে যাই তাতে সন্দেহ কি? এদিক থেকে বিচার করলে, যে সাহিত্যিক বৃহৎ দেশের পরিচয় লিপিবদ্ধ করতে চান তিনি গ্রামের দিকেই চোখ ফেরাবেন। ২
বস্তুতঃ যে দেশের অধিকাংশ লোক গ্রামে বাস করে এবং যে দেশের অর্থনীতি কৃষির উপর নির্ভরশীল যে দেশে গ্রামজীবনকে বাদ দিয়ে সাহিত্য সম্পূর্ণ হয় না। কেননা, “ঐতিহ্য, সমাজ ও পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে সম্ভাবনাময় সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব। কিন্তু সমাজ সমস্যা বহুল সেখানে সমস্যার প্রতি উদাসীনতা লেখকের সংবেদনশীলতার পরিচয় বহন করে না।…………. ইতিহাস নয়।”৩
সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখের দলিল কথাসাহিত্য, সত্তর, আশি ও নব্বই অর্থাৎ এই ত্রিশ বছর সময় জুড়ে বাংলাদেশের গল্পকারদের রচিত গল্পে গ্রামজীবন তুলনামূলকভাবে কম আসলেও সংখ্যায় তা একেবারে নগন্য হয়। শিল্পসফল বেশ কিছু গল্পে এ সময় নানানভাবে গ্রাম এসেছে। তবে পরবর্তী দুই দশকের তুলনায় সত্তরের দশকে প্রবীন ও নবীন লেখকদের রচনায় গ্রামজীবনের উপস্থিতি অধিক লক্ষ্য করা যায়।
বস্তুতঃ স্বাধীনতার পরবর্তীকালে রচিত সেগুলো বিষয়ভাবনার দিক দিয়ে তুলনামূলকভাবে অধিক বৈচিত্র্যে ভরপুর। পল্লী জীবনের নানা দিক নানানভাবে উপস্থিত হয়েছে এসময়ের গল্পগুলোতে। গ্রামের সমাজপতি ও বিত্তবানদের শোষণে দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষ এবং মুক্তিযুদ্ধ পটভূমি হিসেবে অধিক এসেছে। নতুনভাবে ভাবতে ও নতুন দৃষ্টি দিয়ে দেখতে সাহায্য করেছে।
জটিল ও অগ্রসর জীবন শিল্পীমানসের চিন্তা ও দৃষ্টিকোনকে নতুনত্ব দিয়েছে। এজন্য গ্রামের মানুষের শোষণের কাহিনী, তাদের প্রতিবাদের কাহিনীতে অভিনবত্ব লক্ষ্যণীয়।
এ প্রসঙ্গে শওকত আলীর লেলিহান সাধ’, ‘নয়ন তারা কোথায় রে’, ‘ভবনদী, ‘অচেনা’, শওকত ওসমানের ‘কবন্ধ কাহিনী’, মাহমুদুল হকের ‘হৈরব ও ভৈরব”, শাহেদ আলীর ‘নতুন জমিনদার’, বুলবুল চৌধুরীর ‘টুকা কাহিনী’, সেলিনা হোসেনের ‘নতুন জলের শব্দ”, ‘পারুলের মা হওয়া” গল্পগুলির কথা উল্লেখ করা যায়। গ্রামমানুষের জীবন রূপায়ণে নানান শ্রেণী ও পেশার মানুষের জীবন চিত্রায়নে বিগত তিন দশকের গল্পকারদেরকেই অধিক বৈচিত্র্য সন্ধানী ও বিস্তৃত হতে লক্ষ্য করা যায়।
গ্রামের কৃষক ও জেলে জীবনের বাইরেও ছোট-বড় নানান প্রকার পেশাজীবী রয়েছে। তাদের জীবনের সমস্যার স্বরূপ, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও ছন্দ-হতাশায় চিত্রটি তরুণ লেখকদের রচনাতেই অধিক প্রকাশিত। অন্ত্যজ জীবনের রূপায়নে তরুণ লেখকদের কৃতিত্ব অপেক্ষাকৃত বেশী।
নানান বর্ণময় পেশা ও পেশাগত সমস্যা চিত্রনেও তারা শিল্পক্ষমতা দেখিয়েছেন। মাহমুদুল হকের ‘হলধর নিকারীর একদিন’, ‘হৈরব ও ভৈরব’, জাফর তালুকদারের ‘শিকার’, ‘রাজেন সাধুর পাঁচালী”, জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের ‘হিমজীবন, শহীদুল জহিরের ‘কাঠুরে ও দাঁড়কাক’, মুস্তাফা পান্নার ‘অজ্যোতি’, রায়হান রাইনের সতেরটি বাজ পাখি ও সাদা ঘোড়া’ ইত্যাদি গল্পের কথা উল্লেখ করা যায়।
আধুনিক মানুষের দ্বন্দ্ব জটিল সমাজ জীবনের প্রভাবে এ সময়ের গল্পে গ্রামীণ পটভূমিতে রচিত অনেক গল্পেই মনস্তত্ত্বের দিকটিই প্রধান হয়ে উঠেছে। এছাড়া সদ্য স্বাধীন দেশের উদ্ভূত নানান সমস্যা, স্বাধীন দেশে মানুষের হতাশা ও আশাভঙ্গ, সরকার ও রাজনীতিতে নেয়া নতুন নতুন পরিচল্পনা এবং তার প্রভাবে কখনও ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ জীবন, গ্রামজীবনে উন্নয়ন পরিকল্পনায় অবাস্তবায়ন, স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের হয়রানি ইত্যাদি নতুন নতুন বিষয় স্থান পেয়েছে এ সময়ের গল্পগুলিতে।

স্বাধীনতা পরবর্তীকালে স্বভাবতঃই মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বেশ কিছু গল্প লেখা হয়েছে। এসব গল্পের অনেকগুলোতেই গ্রাম পটভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
“গ্রামজীবন নিয়ে কথা সাহিত্যের ধারাটি ক্ষীণ হয়ে এসেছিল ষাটের দশকে কিন্তু পরের দশকের গোড়াতেই ঘটলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মতো এমন এক ঘটনা যাতে গ্রাম-নগর একাকার হয়ে গেল, অতীত বর্তমান মিশে গেল, গ্রামের নগরের প্রত্যেকটি মানুষ যাতে জড়িয়ে পড়লো।”৪
“বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এমনই এক দেশ আলোড়নকারী রক্তাক্ত অভিজ্ঞতা যা হয়তো আরো বহুদিন আমাদের গল্পকারদের প্রেরণার উৎস হিসেবে থাকবে। ৫
মুক্তিযুদ্ধকালীন শহর থেকে পলায়নপর মানুষের গ্রামে আশ্রয় নেয়া, গ্রামে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি, হানাদার বাহিনীর হামলা ও নির্যাতন, আমের মানুষের প্রতিরোধ, আত্মরক্ষা ও আত্মত্যাগ, নারীদের আত্মত্যাগ প্রভৃতি নানান বিষয় গ্রামভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধের গল্পের উপজীব্য হয়েছে।
মাহমুদুল হকের ‘বুড়ো ওবাদের জমা-খরচ গল্প’ গল্পে শহর থেকে প্রাণভয়ে পলায়নরত ভীত মানুষের চিত্রটি স্পষ্ট হয়েছে। গল্পটির বর্ণনা ঢঙে ও বিষয়বস্তু ব্যতিক্রম। শওকত ওসমানের বারুদের গন্ধ লোবানের ধোঁয়া এবং আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘কলিমদ্দি দফাদার’ গল্পে স্বশস্ত্র প্রতিরোধের পরিবর্তে মুক্তিযোদ্ধাদের কৌশলগত প্রতিরোধের কাহিনী দেখা যায়।
গ্রাম সম্পর্কিত গল্পগুলির সিংহভাগেরই উপজীব্য হয়েছে জোতদার-মহাজনদের অত্যাচার ও লগ্নিকারীর ঋণের দায়ে সর্বস্বান্ত মানুষের চিত্র। জোতদার-মহাজনদের কবলে পড়ে অনেক সম্পন্ন গৃহস্থই ভূমিহীন হয়ে পড়ে এবং মনুষ্যজীবনের ন্যূনতম আস্বাদন ও তাদের জন্য অবশিষ্ট থাকে না।
তবে গ্রামের শোষন সংক্রান্ত গল্পগুলির মধ্যে বেশ কিছু গল্পেই কৃষক বা অন্যান্য শোষিত দরিদ্র মানুষের প্রতিবাদের দৃশ্যও অঙ্কিত হয়েছে। শওকত আলীর গল্পেই এ বিষয়টি অধিক প্রতিপাদ্য হয়েছে। শওকত আলীর তার অধিকাংশ গ্রামীন পটভূমির গল্পেই প্রতিবাদী চরিত্র অংকন করেছে এবং শোষকের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ ও রুখে দাঁড়ানোর কাহিনী বর্ণনা করেছেন।
অন্যান্য লেখকের এ বিষয়ে রচিত গল্পের মধ্যে হাসান আজিজুল হকের ‘মাটি-পাথর বৃত্তান্ত-‘ গল্পটি অন্যতম উল্লেখযোগ্য। গল্পটির রচনারীতি ও গল্পের অবতারনার বিষয়টিও ব্যতিক্রমী।
গ্রামীণ শোষকদের বিরুদ্ধে কেবল প্রতিবাদই নয়, ভাগ্যপরিবর্তনে উদ্যমের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে নতুন জমিনদার’ ও ‘সোনাখালী’ গল্পদুটিতে। শাহেদ আলী এই গল্পদুটিতে শোষণ ও ভাগ্য বিড়ম্বনায় ন্যুব্জ মানুষের প্রতি সহমর্মিতা নিয়ে গল্প বর্ণনা করেছেন। ‘নতুন জমিনদারের’ বন্দার সম্মুখে সম্ভাবনা থাকলেও ‘সোনাখালী” গল্পের সোনাউল্ল্যাহ নিয়তির কাছে পরাস্ত হয়।
গ্রামের নিরন্ন অভাবস্ত মানুষের মধ্যে প্রস্ফুটিত নানান মানবিক গুণাবলী উপজীব্য হয়েছে ‘শহীদে কারবালা’, ‘জীবে দয়া করে যে জন’, ‘ভুবন পাগলের সমস্যা প্রভৃতি গল্পে। শাহেদ আলীর ‘শহীদে কারবালা” গল্পে রফিক চরিত্রটি সততার এক অনবদ্য উদাহরণ। পিতৃস্নেহে আচ্ছন্ন হৃদয় সন্তানকে অভুক্ত রেখে নিজের চিকিৎসা করাতে পারে না। কিন্তু মিথ্যা বলে বা প্রতারণা করে অর্থ সে নেয় না।
তাই তাকে অর্থ সাহায্য পাঠাতে আশ্বস্ত কারী ব্যক্তির কাছ থেকেও সে টাকা নেয় না। সততা ও আত্মসম্মানের স্থান তার কাছে আরও উর্ধ্বে। শওকত ওসমান রচিত ‘ভুবন পাগলের সমস্যা। গল্পে আত্ম সম্মানবোধের কারণে গ্রাম্য চাষীরা ভুবন পাগলের দেয়া অর্থ সাহায্য নিতে তারা রাজি হয় না।
নিজ হাতে পরিশ্রমের উপার্জনই তাদের কাছে শ্রেয়। তাই অর্থের প্রলোভনেও দরিদ্র চাষীদের প্রবল আত্ম সম্মানবোধকে টলাতে পারে না। মানবমনের কোমল অনুভূতি-স্নেহ মমতার একটি অপূর্ব গল্প বুলবুল চৌধুরীর ‘জীবে দয়া করে যে জন’। মাতৃস্নেহের সার্বজনীনতা গল্পটিতে ফুটে উঠেছে।

নারীর অসহায়ত্ব ও অবমাননাকর জীবন চিত্র পাওয়া যায়। শোষণসংক্রান্ত প্রায় প্রতিটি গল্পের অনুষঙ্গে। মহাজন-জোতদার-চেয়ারম্যানদের যৌনক্ষুধার করালগ্রাসে পতিত নারী হারাতে বাধ্য হয় তার সম্ভ্রম, সম্মান। এছাড়া আমাদের দেশের আত্মশক্তিহীন নারীরা গৃহেও লাঞ্ছিত জীবন যাপন করে। আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘ল্যাংড়ী’ এ প্রসঙ্গে শ্রেষ্ঠ গল্প।
বুলবুল চৌধুরীর ‘টুকা কাহিনী’তে টুকার মা, মাহমুদুল হকের ‘হলধর নিকারীর একদিন’ গল্পে মেনকা পার্শ্বচরিত্র হিসেবেও এ বিষয়টি উপস্থাপনে উজ্জ্বল। অবশ্য নারী ব্যক্তিত্বের স্ফূরণ ও প্রতিবাদীশক্তি হিসেবে নারী মূর্তিকেও পাওয়া যায় কোন কোন গল্পে।
মূলতঃ আধুনিক শিক্ষা ও মুক্তচিন্তার প্রভাবে নারীর যে উত্তরণ কাম্য, তার ছায়াপাত পাওয়া যায় সেলিনা হোসেনের ‘নতুন জলের শব্দ’, ‘পারুলের মা হওয়া’, ‘মতিজানের মেয়েরা’ প্রভৃতি গল্পে। আল মাহমুদ নারীর দৈহিক সৌন্দর্য ও সম্ভোগকে শিল্পায়িত করলেও নারীর অন্তর্নিহিত শক্তি, সংযম, বিচক্ষণতা, উদ্যমী ও দ্যুতিময় ব্যক্তিত্বকে এঁকেছেন ‘পশর নদীর গাঙচিল’, ‘নফস’, ‘উত্তর পাহাড়ের ঝরণা’ প্রভৃতি গল্পে।
ধর্মশোষণ ও ধর্মকে পুঁজি করার বাস্তব চিত্র দেখা যায় সৈয়দ শামসুল হকের ‘যারা বেঁচে আছে’, হাসান আজিজুল হকের’, ‘বিলি ব্যবস্থা”, ঝর্ণা রহমানের ক্ষণজন্মা’ প্রভৃতি গল্পে।
গ্রামীণজীবনের অভ্যন্তরে একটি ক্লেদাক্ত বিষয় ‘Vintage Polities। দরিদ্র মানুষের প্রতি প্রভাবশালী মহলের নিপীড়নেই গ্রামের একমাত্র অপরাধ সংঘটিত হয় না। বিত্তবান ও মতাশালী মানুষদের মধ্যে পারস্পারিক স্বার্থদ্বন্দ্ব ও ক্ষমতার লড়াই গ্রামজীবনের অন্তরালে নানান ঘটনার জন্ম দেয়। আবু জাফর শামসুদ্দীনের ‘ল্যাংড়ী’ গল্পে প্রসঙ্গটির উল্লেখ পাওয়া যায়। নাজমুল আলমের ‘ইজারদার’ এ সংক্রান্ত একটি চমৎকার গল্প।
গ্রামীন জীবনের বর্ণনায় বিভিন্ন লেখক নানান পেশাজীবী মানুষের চিত্র অঙ্কন করেছেন। বাংলাদেশের শতকরা আশিভাগ মানুষ কৃষিনির্ভর এ কারণে স্বভাবতঃই গল্পগুলিতে কৃষক জীবন ও কৃষক জীবনের সমস্যাই অপেক্ষাকৃত অধিক চিহ্নিত হয়েছে। জেলে ও জেলেপল্লীর গল্পও অভিনব কিছু নয়। এ ছাড়াও অন্যান্য পেশাজীবী মানুষের জীবনও বেশ কিছু গল্পে পাওয়া যায়।
প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতাপরবর্তীকালের গল্পেই এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে অধিক বৈচিত্র্যময় গল্প পাওয়া যায়। শাহেদ আলীর ‘শা’নযর’ গল্পে আমরা পাই এক গ্রামীন পায়ককে। ‘ঈশ্বরের পলায়ন’ গল্পে আলাউদ্দিন আল আজাদ ফুটিয়ে তুলেছেন ছুতার মিস্ত্রীদের বর্তমান পেশাগত সমস্যা। মাহমুদুল হকের হৈরব ও ভৈরব’ গল্পে ঢুলীদের প্রায় অবলুপ্ত পেশা এবং তাদের অতীত ও বর্তমান জীবনের চিত্র দেখা যায়। হলধর নিকারীর একদিন’ গল্পে নিকারী সম্প্রদায়ের সাথে পরিচয় ঘটে।
‘শিকার’ গল্পে জাফর তালুকদার কাহিনী উপস্থাপনের অনুষঙ্গেই মুচি সম্প্রদায়ের পেশাগত জীবন প্রণালীকে উপস্থাপন করেছেন। এছাড়া আধুনিক গল্পগুলিতে নতুন একটি বিষয় হিসেবে বিদেশে শ্রমবিক্রয় করতে যাওয়া বা যেতে আগ্রহী গ্রামের অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত যুবকদের নানান সমস্যা সংযোজিত হয়েছে।
গ্রাম জীবন ভিত্তিক দু’একটি গল্পে শহর ও গ্রামের দ্বন্দ্ব ও দূরত্ব অঙ্কিত হয়েছে। বর্তমান নগরকেন্দ্রিক জীবনের সাথে গ্রামীণ জীবনের গতিহীন পশ্চাৎপদতাকে চিহ্নিত করে দু’অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার ‘পল্লীগ্রাম’, জাফর তালুকদারের ‘বনপুলকের গন্ধ’ প্রভৃতি গল্পে।
গ্রামজীবনকে পটভূমি করে মানুষের মনস্তত্ত্ব, প্রেম-ভালবাসা, যৌনজীবন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে রচিত বেশ কিছু গল্প পাওয়া যায়। বুলবুল চৌধুরী তার গল্পে মূলত গ্রামীণ পটভূমিতে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও মানুষের অন্ত জাতের চিত্রকেই অধিক প্রাধান্য দিয়েছেন। এছাড়াও আরও কিছু লেখকেরও এশ্রেনীর গল্প পাওয়া যায়। এর মধ্যে জাফর তালুকদারের ‘সম্পর্ক’, মোস্তফা হোসাইনের ‘দিগন্ত অনন্ত’ উল্লেখযোগ্য।
স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশে চলেছে আরেক পালাবদল। মুক্তিযোদ্ধারা দেশত্যাগী মানুষেরা দেশগড়ার উদ্দীপনা নিয়ে ভাঙা ভিটেয় নতুন করে জীবন শুরু করার অঙ্গীকার নিয়ে দেশে ফিরেছে কিন্তু বাংলাদেশের গ্রামে-নগরে, পথে ঘাটে যে উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনা সঞ্চারিত হয়েছিল, তার কন্ঠরোধ হল স্বল্প সময়ের মধ্যেই। দেশপ্রেম ও জনকল্যাণের স্থান দখল করে নিল অন্ধ স্বার্থবোধ।

চোরাকারবারী কালোবাজারী আর মুনাফাখোরদের লোভের শিকার হয়েছে দুর্ভিক্ষপীড়িত লক্ষ লক্ষ নরনারী। গ্রামে গ্রামে সবুজ বিপ্লব এসেছে ঠিকই, কিন্তু তা দরিদ্রকে করেছে দরিদ্রতর প্রান্তিক চাষী হয়েছে ভূমিহীন। জোতদার-মহাজনের নতুর কৌশলে বর্গাচাষীদের জীবন হয়ে ওঠে আরও অনিশ্চিত। দরিদ্রমানুষ শুধু বেঁচে থাকার তাগিদে প্রানান্তকর সংগ্রামে রত। এসবই স্বাধীনতাত্তোর গল্পে গ্রামীণ সমাজ চিত্রের উপকরণ হয়েছে।
আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘পল্লীগ্রাম’ এ বিষয় কেন্দ্রিক অন্যতম শ্রেষ্ট গল্প। আতা সরকার তার ‘নিষিদ্ধ রাজনীতির গল্প গ্রন্থের কয়েকটি গল্পে নকশাল ও মুজিববাহিনীর দ্বন্দ্বের এবং মুক্তিযোদ্ধারে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে সৃষ্ট অবস্থার সুযোগে রাজাকারদের গুরুত্বপূর্ণ পদ দখলের কাহিনী এঁকেছেন। হাসান আজিফুল হকের ‘ফেরা’ গল্পে স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে স্বাধীনতা পরবর্তী সাধারন মানুষের স্বপ্নভঙ্গের কথা। সেলিনা হোসেনের ‘ভিটেমাটি’ গল্পটি সমশ্রেনীর হলেও তাতে ইতিবাচকতার প্রকাশ পাওয়া যায়।
বিভিন্ন সরকার গ্রামের উন্নয়নের জন্য নানাবিধ কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি, সরকারের দায়িত্ববোধহীনতা এবং সর্বোপরি সচেতনতার অভাবে এসব কর্মসূচী বা পদক্ষেপ কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থেকেছে।
গ্রামের সাধারণ মানুষ তার ফল ভোগ করতে পারেনি। এই বিষয়কে উপজীব্য করে দুটি চমৎকার গল্প মহীবুল আজিজের ‘গ্রাম উন্নয়ন কমপ্লেক্স বা নবিতুনের ভাগ্যচাঁদ’ এবং জাফর তালুকদারের ‘হাউই’। জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের ‘গ্রাম ও শহর উন্নয়নের গল্প একটু ভিন্নধাঁচের হলেও বক্তব্য বিষয়ে এসব গল্পের সমশ্রেণী।
বর্তমান দ্বন্দ্ব-বিষ্ণুজীবনে মানুষ দিকভ্রান্ত, স্বপ্নহীন। গ্রামগুলোতে মানবজীবন অভাব ও শোষণের যাতাকলে পিষ্ট হচ্ছে। আলোচ্য কালপর্বে রচিত গল্পে গ্রামীনজীবনের সমস্যামূলক গল্পই প্রাধান্য পেয়েছে। আধুনিক সমাজসচেতন লেখকেরা গ্রামজীবনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাকে তাদের গল্পে প্রাধান্য দিয়েছেন।
এ কারণে এ সময়ে রচিত গল্পে সাধারণ গার্হস্থ্য জীবনের সুখী-সচ্ছল চিত্র বা কোন নিটোল প্রেমের গল্প পাওয়া যায় না। এক সময় সমাজজীবনের জটিলতা কম ছিল বলে সমাজকে প্রতিফলিত করতে গিয়ে কথাসাহিত্যিক জীবন জটিলতার অন্ধগলিতে প্রবেশ করতেন না। কিন্তু আধুনিক রেল-কান্ত সমাজ জীবন অস্থিরতা ও অপ্রাপ্তির ভারে ন্যুব্জ। তাই পুরনো স্নিগ্ধ সরল গার্হস্থ্য জীবনের চিত্রের পরিবর্তে গ্রামীণ পটভূমিকায় অঙ্কিত হয়েছে এক ব্যাধিবিদ্ধ সমাজমুখ ।
“স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের গল্পের ধারা সময়ের প্রয়োজনের চিহ্ন নিজ শরীরে ধারণ করেছে প্রবলভাবে। পরীক্ষা-নিরিক্ষার মুখোমুখি হয়ে, কখনো আপোষ করে, কখনো আপোষহীনভাবে ছোট গল্প তার মূল আঙ্গিকগত কাঠামোর যোগ্যতাকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশের ছোটগল্পের এটাই বোধ হয় সব চাইতে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।”৬
এ সময়ে গল্পের টেকনিক ও শিল্পপ্রকরণ নিয়ে নতুন পরীক্ষা-নিরীক্ষা, নতুন শিল্প ভাবনার প্রকাশ ঘটে। বিষয় প্রকরণে নিও-রিয়ালিজমের মতবাদ ধীরে ধীরে জোর প্রভাব বিস্তার করে। কাহিনীর সাধারণ বিবৃতির পরিবর্তে রিয়লিজমের মধ্যে নতুন দার্শনিকতার আরোপ, সুররিয়ালিজমের নানা প্রসঙ্গ, অস্তিত্ববাদী চেতনার প্রয়োগ প্রভাব বিস্তার করে। এর সাথেই মিল রেখে গল্পের ভাষায় কিছু পরিবর্তন, টেকনিকে অভিনবত্ব ও বিষয় বৈচিত্র্য আনার প্রয়াস চলে।
এছাড়া, লোকজ কথা, স্বপ্নবাস্তব, অস্বাভাবিক স্বাভাবিকতা, পৌরাণিক প্রসঙ্গ অস্তিত্ব সচেতনতাসূত্রে গল্পকারেরা ব্যবহার করেন। আদি-মধ্য অন্ত যুক্ত ঘটনা হেঁটে ফেলে বোধের সংহতি এবং বণ্ড চিত্র কল্পের মাধ্যমেই পূর্ণাঙ্গবোধ নির্মাণের যে গদ্যকবিতা কৌশল তাও গল্পে রক্ষণীয়। “আঙ্গিকের বলিষ্ঠতা বাংলাদেশের গল্পে বিষয় চেতনার সঙ্গে একাত্ম হয়েছিল চল্লিশের দশকেই, সৈয়দ ওয়ালী উল্লাহর গল্পে।
ইমপ্রেশনিষ্ট, এক্সপ্রেশনিষ্ট ও চৈতন্য প্রবাহরীতির ব্যবহারে মন সমীক্ষণের গূঢ়ার্থ উম্মোচনে তিনি পথিকৃৎ। ষাটের দশকেও গল্পকারগণ বর্ণনার নির্মোহতায়, ঘটনাংশের ভাববস্তুতে রূপান্তরণে, ভাষার সংহত ঋজু ভঙ্গিতে আঙ্গিক বলিষ্ঠতায় নানা প্রান্তকে স্পর্শ করেছেন স্ব-কাল সম্পৃক্ত হয়ে।
যুদ্ধপরবর্তী প্রজম্মের গল্পগুলো গ্রামজীবনের আশ্রয়ে মূলতঃ থিমেটিক। ঘটনাংশের ভেতর দিয়ে জীবনের বাণী পাঠকের মনে পৌঁছে দেওয়ার প্রচেষ্টায় তাঁরা উদ্দীপ্ত। তাঁদের বর্ণনা মূলতঃ চিত্রধর্মী হলেও উপমার বহুল ব্যবহার চিত্রকল্পস্পর্শী হয়ে ওঠে। আশি ও নব্বই-এর দশক আঙ্গিক নিরীক্ষার দুর্বিনীতকাল। অনুসন্ধানীমন আপন পথের স্বাতন্ত্র্যধারায় গতিশীল। তবু নিরীক্ষা উন্মেষকালীন সচেতনতা বা সচেতনতার উম্মেষ। ৭

ছোটগল্পের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পবৈশিষ্ট্য হয়েছে ভাষা। এর সাথে লেখকের রচনারীতির স্বাচ্ছন্দ্য, তাদের সহজ বোধ্যতা ও পরিবেশন পদ্ধতিটিও তাৎপর্যপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচিত। গল্পের নেপথ্য অনুপ্রেরণাকে গ্রাহ্যতা ও অর্থময়তা আরোপ করে তার শিল্পময় পরিবেশনই একটি সার্থক ছোটগল্পের বিশেষত্ব। গল্পে ছোটপরিসরে ধারণ করে বিশালত্বের পরিমাপ নির্মিত হয়।
গল্পে এক টুকরো অনুভব বা অভিজ্ঞতাকে উপস্থাপন করে তার মধ্যে উপলব্ধির ব্যাপক সামগ্রিকতাকে প্রকাশই তার শিল্প সার্থকতা। এ প্রকাশে একটি প্রবহমানতা থেকে যায়, যা গল্পের খণ্ডাংশ জীবনকে সমগ্র জীবনের ধারাবাহিকতার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তাই ছোটগল্পের ছোট পরিসরে তীক্ষ্ণ অথচ গতিশীল ভাষাই কাম্য।
শওকত ওসমান গল্পের নেপথ্যে আধুনিক জীবন জিজ্ঞাসার একটি শক্তিশালী প্রেক্ষিত রচনা করেছেন। তার রচনার অন্যতম কৌশল সঙ্কেতাত্মক বাক্য প্রয়োগ, যার দ্বারা মূল কাহিনীর পশ্চাতে প্রায়শ নিগুঢ় কোন অর্থের অভিসিষ্ঠান সাধিত হয়। ভাষায় শানিত কৌতুক ও বাঙ্গেও তিনি জীবনের ত্রুটিগুলিকে চিহ্নিত করেন কখনও কখনও : উদাহরণ:
১। জলের প্রহারে ধস নামার পূর্বেই মাতৃ উপর থেকেই তার পৃথিবী ধ্বসিয়ে দিলে। শব্দ হয়ত একটা উঠেছিল। ধলেশ্বরীর গর্জনে সব ঢাকা পড়ে গেল। (দ্বিতীয় অভিসার)।
২। হুইস্কির ঝাঁক চোখ কান মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম পরে নিজেকে সামলে নিয়ে রমিজ জবাব দিলে, জন্মভূমি ত নয়, দেখে এলাম তোমার আমার কর্মভূমি………. তারপর সে আবার বেদম থিকথিক হাসি হাসতে লাগল। সঙ্গীরা ভাবলে আজ অল্পেই এর নেশা ধরেছে।
মোবারক মিয়া ভেবেছিল হেলেনা পাগলী সব ভণ্ডুল করে দিয়ে গেল। (গ্রহচ্যুত)
শাহেদ আলীর গল্পের ভাষা সরল, অনাড়ম্বর, তবে কখনও কখনও শৈল্পিক দাবী পূরণে দুর্বল। উদাহরণ:
১। জলচৌকি থেকে হঠাৎ সে নাড়িয়ে যায়, আর হাত দু’টি প্রসারিত করে দেয় মা’র দিকে। সারা শরীর তার শিউরে শিউরে উঠছে, চোখের পাতা বারবার উঠছে আর নামছে। ঠোঁট দু’টি থেকে একটা করুণ বিষণ্ণ আজাগতিক হাসি তার গালের উপর দিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে চোখে, মুখে, কপালে। (শা’ ন
শওকত আলীর রচনারীতি ও ভাষায় ব্যবহার ছোটগল্পের জন্য বিশেষ উপযোগী তিনি গল্পের বর্ণনায় সাধারণত উপমার ব্যবহার করেন না। স্বল্প সংখ্যক যে ব্যবহার পাওয়া যায় তা অতি কাব্যমনা ও মনোরম ‘কুয়াশার মধ্যে অনাথ শিশুর মতো শুয়ে থাকে অন্ধকার (লেলিহান সাধ)। ”
হাসান আজিদুল হকের গল্পের অন্যতম প্রধান আকর্ষণীয় দিক ভাষা। ভাষার অপরূপ কৌশলে তিনি সমগঞ্জে একটি কাঙ্ক্ষিত আবহ তৈরী করে পাঠককে আবিষ্ট রাখেন। উদাহরণ:
১। এর মধ্যে হুমড়ি খেয়ে ঘরের মধ্যে ঢোকে ছেলে, ছেলের বউ আর কোন আশ্চর্য এর মধ্যেও বাপ ওদের দেখতে পায়। পাশের ঘরে ছেলেমেয়েগুলো হাউ হাউ করে কাঁদছে তাও তার কানে আসে। মাংস খ্যাতলানোর আওয়াজ, হাড় ভাঙার শব্দ সে শোনে তখন। তারই দেহ থেকে উঠে আসছে।
ছেলে ঘরের এক কোনে হাবার মত দাঁড়িয়ে। (সমুখে শান্তি পারাবার) জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ভাষা ব্যবহারে সমসাময়িক শিল্পীদের থেকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। ভাষা ব্যবহারে তার রীতি পদ্ধতি ভিন্নতর। প্রবহমান কাব্যময় ভাষার গল্প বর্ণনা করেন, কিন্তু তার মধ্যেই একটি নিটোল সংযম উপলব্ধি করা যায়। অত্যন্ত পরিশীলিত ও কাব্যময় ভাষার মধ্যেই তিনি হঠাৎ দু’একটি একটি সংলাপ ব্যবহার করেন, যা লক্ষ্যভেদী ও যথাযথ। উদাহরণ:
১। তার স্ত্রীর এই কথা জানা ছিল। অনেক অনেক আগের স্মৃতি মনে পড়লে নিস্পন্দ হয় সে। এক পা ফেলার পর আর এক পা ফেলার আগে দেখতে হয় সামনে কি আছে কিন্তু সে কথা মানুষটির মনে পড়তো না। সে নির্দ্বিধায় পথচলাকালীন সব শক্ত মাটির কাঁকর উপেক্ষা করে ঈশানের কালান্তক অতিথির আসনপথে ছুটে যেতো। স্ত্রী অনেকবার তাকে বুঝিয়েছে দেখে কি লাভ জেনে কি লাভ, ‘অহন তো বইয়া রইছি চালের উপরেই।’ খাওয়া-থাকা সবই সেখানে।” (শূন্য গগনবিহারী)
ভাষার ব্যবহারে তরুণ প্রজন্মের অন্যতম দক্ষশিল্পী মাহমুদুল হক। ভাষা ও শব্দের ব্যবহারে তার শৈল্পিক দক্ষতা অসাধারণ। উদাহরণ:
১। চাপ চাপ অন্ধকার এক সময় হুড়মুড় করে ওঠে, দু’টি কুরাল নিদারুণ কর্কশ কণ্ঠে আর্তনাদ জুড়েছে। ধাইড়পাড়া মাঠের দিক থেকে ভয়ঙ্কর করাতের মতো আছড়ে পড়ছে চিৎকৃত নিনাদ, নাকি পরশুরামের দিক থেকে, খেই হারিয়ে ফেলে বুড়ো ওবাদ। এক একবার মনে হয় মধ্যপাড়ার দিঘির কোল ঘেঁষা বিশাল বিশাল রেন্ডিগাছের চূড়া থেকে মড়কের এই ভেঁপু ছড়িয়ে পড়ছে দিগ্বিদিকে, বুড়ো ওবাদ গ্রামছার ন্যাতাকানি দিয়ে আবার স্বেদসিক্ত কপাল মোছে, কিছুটা দিকভ্রান্ত সে এখন। (বুড়ো ওবাদের জমা-খরচ)
রাহাত খান কারুকার্যহীন সাধারণ ভাষা ব্যবহার করলেও তার ভাষায় একটি অন্তর্নিহিত বন্ধন অনুভব করা যায় যা ছোটগল্পের ভাষা হিসেবে বিশেষ উপযোগী। আল মাহমুদের গদ্যভাষা কাব্যগন্ধী ও রোমান্টিক। তিনি ভাষাকে মোহময় ও ব্যঞ্জনাধর্মী করে তোলেন। উদাহরণ:
১। ওসমানের জন্য খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। একটু পরেই আমি ওসমানকে বিস্তৃত বেলাভূমি মাড়িয়ে ডান কাঁধে কাঁথায় মোড়ানো বিছানা নিয়ে দ্রুতপায়ে আমাদের নাওয়ের দিকে আসতে দেখলাম। মেঘনার পশ্চিম পারে সূর্ব তখন লাল হয়ে ডুবে যাচ্ছে।
পড়ন্ত সূর্যের অন্ধকার মিশ্রিত লাল আভায় ওসমানের দৈহিক দৈর্ঘকে আমার কাছে বড় বেশি দীর্ঘাকায় বলে মনে হতে লাগল। পেছনে ডেজা বালুময় বিস্তৃত তীরভূমির ওপর তার পায়ের ছাপ এমনভাবে আঁকা হয়ে যাচ্ছে, দেখলে মনে হয় একজন ভারি মানুষকে বহন করার চিহ্ন রাখার জন্য ধরণী যেন বেশ একটু নমনীয় হতেই আছেন। (নীল নাকফুল সেলিনা হোসেনের গল্পের ভাষা বিশেষভাবে লক্ষণীয়।
তিনি ভাষারীতিতে এক ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষা এনেছেন, চলতি রীতির মধ্যে অনেক অপ্রচলিত শব্দ বসিয়ে বাক্য তেরী করেন তিনি। উদাহরণ: ১। না, অঙ্কটা কি চায় এটা কোনদিনই ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারেনি মনুমিয়া। ভাবতে গেলে চোখের সামনে ঘিরগিশটি অন্ধকার ঘনিয়ে উঠতো। (খোয়াই নদীর বাঁক বদল)
সৃষ্টিশীল গদ্যকে বাস্তবমুখী, গতিশীল করতে খেল ভাষা ও শব্দকে নানামুখী ব্যবহার করে। এই প্রেরণা থেকেই সাহিত্যসৃষ্টিকে জীবন সংলগ্ন ও জীবন্ত করে তুলতে আধুনিক কথাসাহিত্যিকের উপভাষাকে সর্বজনমান্য বাংলা লিখিত গদ্য কাঠামোর মধ্যে সঞ্চারিত করেছেন। তারা পরিশীলিত ভাষায় কাহিনী বর্ণনার সাথে ঘটনার প্রয়োজনে চরিত্রের মুখে দিয়েছেন পরিস্থিতি ও চরিত্রানুযায়ী আঞ্চলিক বুলি ব্যবহার করেছেন।
বাংলা গদ্যের জন্মলগ্ন থেকে তৎসম শব্দ প্রধান গুরুগম্ভীর ভাষাকে সাহিত্যের ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর পরে সাহিত্যের ভাষা মান চলিত ভাষার রূপ নেয়। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে পঞ্চাশের দশক থেকে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারের প্রবণতা শুরু হয়, ষাটের দশকে তার প্রসার বাড়ে। স্বাধীনতাউত্তর কথাসাহিত্যে এর ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়।
এ সময় আঞ্চলিক ও নিম্নশ্রেণীর জীবনচিত্রণে প্রায় সকল লেখকই বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের উপভাষা ব্যবহার করেন। এ প্রসঙ্গে বলা যায়, আঞ্চলিকতার দাবি যে গদ্যে যেভাবে আশা করা যায়, সেভাবেই তাঁরা অগ্রসর হয়েছেন। লেখকেরা আঞ্চলিক শব্দ, উপভাষা বা মৌখিক বুলি ব্যবহার করেন প্রধানতঃ বাস্তবতাকে মূর্ত করে তোলার জন্য। ভাষার মূল কাঠামোটি পরিশীলিত চলিত ভাষার থাকে, সংলাপেই মূলতঃ আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহারে শাহেদ আলী বেশ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।
শুধু সংলাপ নয়, তার গদ্যের বর্ণনাংশ আঞ্চলিক শব্দ, গ্রাম্য বুলি, প্রবাদ ইত্যাদির প্রয়োগে শিল্প সমৃদ্ধ। শওকত আলী ঘটনা বর্ণনায় একটি-দুটি আঞ্চলিক শব্দ এবং সংলাপে বাস্তবতার দাবিতে অবিরল আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করেছেন। তার আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার অনেকটা চিত্ররূপময়। কথাসাহিত্যে হাসান আজিজুল হকের শিল্প সাফল্যকে তার আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার ও বিশিষ্টতা দান করেছে।
তার ভাষাভঙ্গি নিরসক্ত অথচ মর্মভেদী, গভীর ও ব্যপ্ত। তার আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার তার গল্পে কোন বিচ্ছিন্নতা বা পোশাকি ব্যাপার থাকে না, সময়তার সূত্রে মিশে থাকে।
১। খালেদা এতোদিন ডুবে থেকেছে কাজের মধ্যে। ফুরসৎ পেলেই জা’দের সাথে বসে কথাবার্তা বলতো, শাশুড়ির লগে গল্পগুজব করতো। কিন্তু সেই খালেদা এখন একেবারেই নিভে গেছে। আজকাল আর সে হাসে না, কথাবার্তাও বেশী কয় না। (‘ছবি’, শাহেদ আলী)
২। গুপিনাথ হো হো করে হেসে উঠলো। যেন হাস্যকর একটা প্রস্তাব দিয়েছেন লক্ষীকান্ত। বললো, নিন্দ হামার আসে না লখিন্দর সদাগর নিন্দায়, তবে বহু সনকা নিন্দায়, ব্যাটা লখিন্দর নিন্দায়, পুতেছে বেহুলা নিন্দায়-জগৎসংসার নিন্দায় কিন্তুক জাগে কে? (শুন হে লখিন্দর, শওকত আলী)
৩। মালিক এই কথায় চিৎকার করে উঠেছিল, মুই কহি কি তুমরা কি দেখিছেন মোর ছোঁয়ারে তুমার বুনের সাথে আকাম করতে’ তুমরার বুন কি রাজি ছিল বাহে?
নেক বখশ নির্বিকার সরলভাবে বলে, মোর বুন নেকী মানুষই নহে, আপনের পোলা ল্যাওরা আর নুলো। দোষ কারো নই, বিহাটা দিলেই ঠিক হইবে মালিক। (বিলি ব্যবস্থা’, হাসান আজিজুল হক)

৪। লজ্জা করতিছে না?
না লজ্জা কিসির? কাজ না পালি আমি কি করবানে ?
মরবা আবার কি করবা,
সে জন্যি কি চেষ্টা করতি হবে? দুদিন বাদে আপনিই চিত্তির হবা। কি করেছ। তুমিই তো দেরি করতিছো। (সমুখে শান্তিপারাবার, হাসান আজিজুল হক)।
৫। চ্যাতছ ক্যান চৈতন্যদাস নিজেই থিতু হয়ে অকারনে ফোকলা মুখে হাসে, মাকড়সার জালকোনা দু’গালের গহ্বর দুপদুপ করে নাচে, তরে দেহিনা, তামান দিনরাইত কই কই যে খাহচ
কই থাহি বুজো না? প্যাচাল পারনের লাইগা বিহান হইতে না হইতে অক্করে উজাইয়া উঠতাছে। ঘরে বয়ে থাকলে প্যাট চলবো?
“ঈশ্বর তগো চাপা দিছে, করছো, নিকারীর কামড়ি যেমন চৈতন্যদাসের হোলাই পাইছে। আমাগো সময় কি আর ঘর-সরসার আছিলো, মাইয়া পোলা আছিলো, তগো কালে যেমন কার কারবার দেখতাছি-‘ (হলধর নিকারীর একদিন, মাহমুদুল হক)
৬। সারাদিন কুণ্ঠে যে ঘোরাঘুরি করিস। শরীরটাতো শ্যাষ করি দিলু।
বুড়ি দীর্ঘশ্বাস ফেলে ।
– আইজ তো চাউল আনোনি। কাইলকের তনেও তো নাই। (ভিটেমাটি’, সেলিনা হোসেন)
৭। ও পিতৃত্বের অধিকার দিতেও চায়না। সোজাসুজি বলে দেয়, আই হোলাহান মানুষ কইরুম। ভাত নিউম কাপড় নিউম, বাপ দি করিউম কি? ঐতো আইতনকে স্বামী দু’গা হোলামাইয়া পুই বাঘি গেছে। কি কইছে? বাপ ধুই হানি খাইযনি? যেগুনের বাপ নাই হেগুন মানুষ হয়না? (পারুলের মা হওয়া, সেলিনা হোসেন)
৮। ‘থোৰ ক্ষুধা নেগেচে বুইচো?’
“বুইচি, রোব ক্ষুধা লেগেছে।
“তা এখন কি করতি অবে?”
“তুমি মরদ বাজি পারো না।’
(অন্নদাস, জাফর তালুকদার)
৯। ওখানে যিশুনা কলাম ও নাগাল নয়, ব্রহ্মপসি। গোরুর নক্ত দিয়ে কিমন ঝিউ ধরি থাকে দ্যাকো না।
যগোর্নার। ওকানে যিশুনা কলাম …
(সম্পর্ক, জাফর তালুকদার)

১০। আয়েশা তরল গলায় বলে-
– তয় দিবো না? আপনে তো এই কয়দিন দরে দেইখা সাপের লাহান ফুঁসছেন। পোলা আমার গোয়ানী। সব জানে। কে শত্রু, কে বন্ধু ।
-হ, এই গেয়ান লইয়া পোলা তর বুজুরকি দেহাইবো। বাপেরে মান করে শত্তর।
আয়শার মুখ ঝকঝক করে। দু’চোখ উপচে পড়ে খুশির আলো। সে মাথাটা একটু ঝাকিয়ে ফিসফিস করে
বলে-
মাগো পোলায় মান করবো ক্যান? আপনেইতো মনে করছেন। এহন দেহেন মাটিতে পইড়াই যে পোলা ট্যাকা কামাই করে হে কিমুন পোলা? আর কিছু নয় বাদই দেন।
(ক্ষণজন্মা, ঝর্ণা রহমান)
১১। কি করতি কও? জনৈক রোগীর নাড়ি টিপে ধরে কাঁটতি প্রশ্ন করে কামিনী বসাক।
-আজ্ঞে দুটো মুখে ওইজে আসলে
মা- ঠাকরুনের কষ্ট হয়না।
— হবিনা।
-আজ্ঞে
-এখন খাওয়া হবিনি। মা- ঠাকরুনকে খেয়ে নিতি বল। আর শোন দশমূল পাচন শেষ হইয়ে গ্যাছে। উনুন জ্বালাবি জিনিস-পত্তর ঠিক করণে। আমি আসতিছি ।
ঘেউ, মনীশ রায়)
বাংলা কথা সাহিত্যে ভাষা প্রশ্নে মধ্যপঞ্চাশ থেকেই সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। পূর্বে পরিশীলিত ভাষায় পাশাপাশি বাংলা গদ্যে আঞ্চলিক শব্দ, ভাষাভঙ্গি ও উপভাষা সম্পর্কে সৃষ্টিশীল লেখকদের আঞ্চলিক ভাষার শক্তিকে আবিস্কার করে। কথা সাহিত্যে আঞ্চলিক পবরবর্তীকালে এই আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার গল্পে একটি জৈবিক ঐক্যে সমন্বিত হয়। গল্পের বক্তব্য ও ব্যঞ্জনার জন্য পরিশীলিত ও আঞ্চলিক ভাষা এবং তাকে শিল্পসফলভাবে ব্যবহার করা দুটি বিষয় একই এ ব্যাপারে সাহিত্যিকদের শিল্পসাফল্যে কমবেশী পার্থক্য থাকাই স্বাভাবিক।
বস্তুতঃ গ্রামভিত্তিক গল্পগুলোতে নিরক্ষর ক্ষুধাকাতর মানুষের জীবন যাপন, গ্রামের অন্নয়নের প্রতিবন্ধতা, ক্রমশঃই শোষকের উত্তরণ, – এসকল গ্রাম সমাজের মর্মমূলস্পর্শী সমস্যাকে উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে আধুনিক গল্পকারের তাদের সুগভীর সমাজ সচেতনতা ও নিবিড় সংলগ্নতার পরিচয় দিয়েছেন।
মূলতঃ এটিই যুগ বৈশিষ্ট্য; কেননা বিংশ শতাব্দীর শেষ তিন দশকে শিক্ষা ও মুক্তচিন্তার প্রসারে মানুষ জীবন বাস্তবতাকে প্রাধান্য দিতে চায়। শিল্পের দাবী অপেক্ষা জীবন বাস্তবতাই মুখ্য হয়ে ওঠে। এ বিষয়ে আহমদ কবিরের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য: “শিল্পমান যে রকমই হোক না কেন, স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশের ছোটগল্প স্বাধীনতাপূর্বযুগের তুলনায় অনেক বেশী গণমুখী ও রাজনীতিসংলগ্ন। ৮
আরও দেখুনঃ