সৈয়দ শামসুল হকের উত্তরবংশের শৈলিবিচার

উত্তরবংশের শৈলিবিচার রচনাটি সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যনাটক : ইতিহাস, সমাজ, রাজনীতি ও শিল্প [পিএইচডি অভিসন্দর্ভ] এর অংশ। গবেষনাটির অথোর জান্নাত আরাসোহেলী। এই অভিসন্দর্ভের (পিএইচডি) বিষয় বাংলা নাটক – ইতিহাস ও সমালোচনা। প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শিক্ষাবর্ষ: ২০১৭-২০১৮। গবেষণাকর্মটি সাহিত্যের শিক্ষার্থীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় আমরা সাহিত্য গুরুকুলে পুন-প্রকাশ করলাম।

উত্তরবংশের শৈলিবিচার

 

উত্তরবংশের শৈলিবিচার

সৈয়দ শামসুল হকের উত্তরবংশ কাব্যনাটকে একদিকে যেমন বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের গর্বিত ইতিহাস উপস্থাপিত হয়েছে, তেমনি সমকালীন কুটিল রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে মজ্জমান জাতির বেহাল দশাও চিত্রিত হয়েছে। নাট্যকার এখানে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে একাত্তরের ঘাতক-দালাল-রাজাকারদের ঘৃণা অপরাধের বিচার চেয়ে প্রতিবাদ করেছেন।

নেতা, লেখক ও লেখকের মেয়ে নাটকের এই প্রধান তিনটি চরিত্রের মুখেই উচ্চারিত হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে বিচার প্রসঙ্গ। বলা যায়, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ ও প্রতিবাদী উচ্চারণ সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যনাটক উত্তরবংশ। বস্তুত, সৈয়দ শামসুল হক অস্ত্রহাতে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে যোগ না দিলেও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আজীবনকাল বৃদ্ধিবৃত্তিক লড়াই করে গেছেন।

বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতির পক্ষে তিনি শুরু থেকেই সোচ্চার ছিলেন। এদেশের মানুষ কূপমণ্ডূক জীবনভাবনা পরিত্যাগ করে উদার, মুক্ত ও প্রগতিশীল জীবনভাবনায় শুতে হবে এটিই তিনি মনে প্রাণে চেয়েছেন। তিনি নিজেকে বাহান্নর সন্ধান পরিচয় দিতে অধিক পছন্দ করতেন। জীবন সায়াহ্নে লন্ডনে অবস্থানকালে মুক্তদৃষ্টির লেখক-সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরীর সঙ্গে একান্ত এক আলাপচারিতায় তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন

হিন্দু-মুসলমান কোনো ভেদাভেদ আমরা করিনি। আমরা বেড়ে উঠেছিলাম গণতান্ত্রিক একটা চেতনার মধ্য নিয়ে। আমরা তো বাহান্নর সন্তান, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সন্তান। […] আরেকটা দিক হলো স্বাধীন বালাদেশের অভ্যুদয় আমরা দেখেছি। তাতে আমানের অবদান কতটুকু, সেটা আমি বলতে চাই না। কিন্তু এই যে অভ্যুদয় দেখেছি, এটা জামানের জীবনের বিশাল একটা পাওয়া।

ভবিষ্যতের প্রজন আমাদের ঈর্ষা করবে, আমরা এমন সব ব্যক্তিকে দেখেছি, যারা এই দেশটাকে গড়ে তুলেছে। বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর কথা যদি বলি, তাঁর সময়ে আমরা বেঁচে ছিলাম। তাঁকে আমরা সাতই মার্চের ভাষণ দিতে দেখেছি, তাঁকে বঙ্গবন্ধু উপাধি পেতে দেখেছি, তাঁকে আমরা স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সময় পেরেছি। এই পুরো ব্যাপারে যে প্রত্যক্ষদর্শী, এটা প্রজন্মের পর প্রজন্য আমাদের ব্যাপারে ঈষান্বিত হবে।

এমনকি তারা বলবে, আপনারা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা আপনাদের লেখার ভেতরে প্রবেশ করিয়ে দিয়ে গেছেন। […] এই দেশ আমাদের নিজের হাতের তৈরি। এই দেশ আমার পিতা-পিতামহ থেকে শুরু করে আরও আগের প্রজন্যের উত্তরাধিকার বহন করছে। তাদের নানাবিধ অবদানে সমৃদ্ধ এই দেশ।

তিনি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে উত্তরপ্রজন্যকে অতীতের সঠিক ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিয়ে একটি অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন, স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখাতে চেয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গটি তিনি উত্তরবংশ কাব্যনাটকের মাধ্যমে উত্থাপন করেছেন।

তিনি আশা করেছেন, পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে এদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক-রাষ্ট্রিক জীবনে সংঘটিত অনাকাঙ্ক্ষিত বিপর্যয়ের কারণে মানবতাবিরোধী অপরাধের যে বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি, উত্তরপ্রজন দায়িত্ব নিয়ে একদিন সে বিচারপ্রক্রিয়ার সম্পন্ন করবে। নাটকের প্রধান দুই চরিত্র নেতা ও নাট্যকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দায়িত্ব অর্পণ করেছেন তাদের কন্যা, তথা উত্তরপুরুষের ওপর।

 

উত্তরবংশের শৈলিবিচার

 

লেখক-কন্যাও একদিকে যেমন তার মায়ের ওপর একাত্তরে সংঘটিত নির্যাতনের বিচারের দাবিতে সোচ্চার, অন্যদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে উচ্চকণ্ঠ। সে তাই দীঘরে ঘোষণা করেছে :

আমরা আর সময়কে পার হয়ে যেতে দেবো না।

যে- বিচার আপনারা করতে পারেননি, আমরাই করবো।

সময় এখনো বহে যায়নি, বিচারে তাদের তুলবো। । …

বিচার যদি না করি ইতিহাসে আমরা

মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবো না। ( কাব্যনাট্যসমগ্র ०৭)

তবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ কেবল অত্যাচারিত ও নির্যাতিত হবার বেদনাবিধুর আলেখ্য নয়। মুক্তিযুদ্ধ অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথানত না করে গৌরবদীপ্ত বিজয় রচনার ইতিহাস। এ প্রসঙ্গে সৈয়দ শামসুল হক রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ, সশস্ত্র আক্রমণ ও গেরিলা যুদ্ধের বীরত্বব্যঞ্জক আখ্যান তুলে ধরেছেন উত্তরবংশ নাটকে। তিনি চান – বর্তমান প্রজন্ম সেই পূর্বপ্রজন্মের কথা জানুক, যারা অন্যায়ের সঙ্গে কিছুতেই আপস করেনি। সেই সংগ্রামী যুবাদের কথা জানুক, যারা নিজেদের স্বার্থ ভুলে দেশমাতৃকার বৃহৎস্বার্থে অসম সাহসিকতার সঙ্গে গেরিলা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। নাট্যকারের মেয়ে চরিত্রটির মুখে তাই শুনতে পাই :

সেই গণহত্যার গল্পও তুমি আমার কাছে করেছো ।

….। গণহত্যার বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম সেই উঠে দাঁড়ানো।

….। হানাদারদের চোখ এড়িয়ে নগরে প্রবেশ করে

অতর্কিতে মুক্তিযোদ্ধাদের পালটা আক্রমণ ও আঘাত (কাব্যনাট্যসময় 228)

উত্তরবংশ নাটকে প্রধান চরিত্র তিনটি। নাট্যকার, তার কন্যা এবং জনৈক জননেতা। তবে আরেকটি প্রধান চরিত্র নাট্যকারের যিনি নেপথ্যে থেকেও নাটকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বস্তুত, নাট্যকারের স্ত্রীকে ঘিরেই এ নাটকের মূল বক্তব্য পরিণামমুখী হয়েছে।

এছাড়া নাটকে কিছু পরিপ্রেক্ষিত-চরিত্র রয়েছে, যারা নাটকের প্রয়োজনে কখনো ঘাতক হানাদার, রাজাকার, কখনো নির্যাতিত জনতা, মুক্তিযোদ্ধা প্রভৃতি চরিত্রের ভূমিকা পালন করেছে। তবে নাট্যকাহিনি অগ্রসর হয়েছে প্রধান তিনিটি চরিত্রের পারস্পরিক কথোপকথনে। এই তিনটি চরিত্রের ভূমিকা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, নাট্যকার স্বয়ং নাটকের ভূমিকায় বলেছেন

এ কাব্যনাটা কেবল নাট্যকার, তার মেয়ে, এবং নেতা, এই তিন চরিত্র সম্বলিত দৃশ্যগুলো নিয়েই উপস্থাপন করা সম্ভব: সে ক্ষেত্রে অপর দৃশ্যগুলো কেবল ধ্বনি সম্পাতের মাধ্যমে এনে প্রয়োজনীয় আবহ সৃষ্টি করা যেতে পারে। (কাব্যনাট্যসমগ্র ৫৪৯ )

নাটকের প্রধান চরিত্র নাট্যকার, যার হৃদয়ের ক্ষরণ- বিগলন পাঠক-দর্শকের অন্তরকে স্পর্শ ও বিচলিত করেছে। সৃষ্টিশীল এ মানুষটি প্রতিনিয়ত অন্তলোকে লালন করেছে শোকের হিম ও প্রতিশোধের দাবানল। তার অন্তর স্ত্রী শোকে ভারাক্রান্ত, কিন্তু বাইরে সে নির্বিকার থাকার ক্রমাগত অভিনয় করে যাচ্ছে।

এমতাবস্থায় দেশপেমিক জনৈক নেতা তাকে পরামর্শ দিয়েছেন এই বলে যে তার উচিত সত্যটা স্বীকার করে দ্রোহে, ক্ষোভে জ্বলে ওঠা। এমন কিছু রচনা করা, যা বিমেধৱা সমাজমানসকে সমুদ্রসম উত্তাল করে দিতে পারে। আর তাতেই সমব হবে একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচারকার্য। কারণ ব্যক্তির শোক আর রাষ্ট্রের সামষ্টিক শোক কখনো পৃথক নয়। নাট্যকার হারিয়েছে তার প্রিয়তমা স্ত্রীকে, আর বিনষ্ট রাজনীতির ঘূর্ণাবর্তে রাষ্ট্র হারিয়েছে তার আদর্শ, তার স্বপ্ন।

বলাবাহুল্য এজন্য দায়ী এদেশেরই সুপ্রিম জনগণ। পঁচাত্তর-উত্তর সময়ে তারাও পঁচা পাঁকে গা ভাসিয়েছে, রাজনীতি আর ধর্মব্যবসার মোহজালে বন্দি হয়ে ব্যক্তিক উন্নয়নের চিন্তার সামষ্টিক স্বার্থ বেমালুম ভুলে গেছে। নাট্যকারের খেদোক্তি।

যা আমরা মুখে মেজে নিচ্ছি মনে করেছি প্রসাধন

আসলে তা কালি – কালি। আমাদের অক্ষমতার কালি-

আমাদের ব্যর্থতার কালি আমাদের প্রাপ্তির কালি।

আর তারই মাশুল এখন আমরা দিয়ে চলেছি। (কাব্যনাট্যসমগ্র ৫৮০ )

একদা তরুণ নাট্যকার ও তার স্ত্রীর চোখে ছিল সংসার গড়ার স্বপ্ন, হৃদয়ে ছিল অকৃত্রিম প্রেম-ভালোবাসা। তাঁরা চেয়েছিলেন পাখি হয়ে উড়ে যেতে সবুজ নিসর্গ আর নিবিড় প্রান্তরে, মুক্ত বিহঙ্গের মতো ঘুরে বেড়াতে চেয়েছেন স্বদেশের মুক্ত আকাশে। কিন্তু পাকিস্তানি হায়েনার দল অতর্কিতে হানা দিয়ে তাদের স্বপ্নের পৃথিবী তছনছ করে দিয়ে গেছে। অট্টহাস্যে গুলি করেছে তাদের কোমল বুকে: লেখকের তরুণী স্ত্রীকে শেকলবন্দি করে নিয়ে গেছে নির্যাতন ক্যাম্পে। ঘটনার আকস্মিকতায় রক্তাক্ত হয়েছে যুবক নাট্যকারের হৃদয়

পিপাসায় নদীর কিনারে আমি উর্দু হয়ে সেই যে নেমেছি

শিকারীর অট্টহাসে হাত থেকে পড়ে গেছে পানি।

বিস্ফারিত চোখে আজও চেয়ে আছি আমি –

রক্তে ভিজে গেছে করতল (কাব্যনাট্যসমগ্র ৫৫৪ )

যুদ্ধশেষে নাট্যকার তাঁর স্ত্রীকে পরম মমতায় নিজগৃহে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু স্বাভাবিক সংসার আর হয়ে ওঠেনি। কেননা দীর্ঘকাল ক্যাম্পে নির্যাতন সয়ে সয়ে স্ত্রীর মধ্যে একধরনের বিকার জন্ম নিয়েছে। নিজের হাতেগড়া সংসারকে তার মনে হয়েছে শত্রুবেষ্টিত বাংকার। নিজের স্বামীকে মনে হয়েছে হানাদার বাহিনীর বর্বর সেপাই, দেশদ্রোহী রাজাকার, ধর্ষক আলবদর। ফলে কিছুতেই আর সে স্বাভাবিক হতে পারছিল না।

এরপরও নাট্যকারের প্রেমময় যত্নে তিনি কিছুটা স্বাভাবিক হতে শুরু করেছিলেন। সংসারের স্বাভাবিক নিয়মে তাঁর কোল জুড়ে এসেছিল কন্যা সন্তান। কিন্তু এরপর পঁচাত্তর-উত্তর পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে, রাষ্ট্রক্ষমতায় আবারো মৌলবাদের উত্থান দেখে তিনি ভীত ও শঙ্কিত হয়ে পড়েন। তাঁর ধারণা হয় একদিন রাজাকারদের সহায়তার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাঁর সঙ্গে যে ঘৃণ্য আচরণ করেছে, ভবিষ্যতে তাঁর সন্তানও এদেশে সেই ঘৃণ্য আচরণের শিকার হবে। ফলে তিনি আত্মহননের পথ বেছে নেন।

নাট্যকার এ পর্যায়ে অনুধাবন করেন যে, পাকিস্তানি হানাদারদের নির্মম অত্যাচার সয়েও তাঁর স্ত্রী যে টিকে গিয়েছিলেন, নতুন করে বাঁচতে চেয়েছিলেন, স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতার অবিচার আর নিজস্বামীর পলায়নবাদী মানসিকতা তাঁকে আত্মহত্যায় উদ্বুদ্ধ করেছে। অথচ নাট্যকার যদি উপযুক্ত প্রতিবাদ করতে পারতেন তখন, তাঁর স্ত্রী হয়তো বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা পেতেন। নাট্যকারের মেরুদণ্ডহীন নপুংসক মনোবৃত্তি, অনাকাঙ্ক্ষিত নির্লিপ্ততা ও আপসকামিতা তাঁর স্ত্রীকে আশাহত করেছে। ফলে আত্মহত্যা করে এই ভ্রষ্টতা, এই বিচারহীনতা, এই আদর্শহীনতা থেকে বহুদূরে সরে যেতে চেয়েছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে নাট্যকারের সংলাপ উল্লেখ্য

লজ্জা আর লজ্জার শেকল পায়ে পায়ে বেজেছে আমার।

পরিবারের সত্যকে রেখেছি গোপন, আমি করেছি গোপন।

সব স্পষ্ট দেখছি এখন আমার এ পরস্পরবিরোধী ভূমিকা।

আর ভেতরে বাহিরে এই আমারই তো দুই ভিন্ন রূপ দেখে –

ক্ষোভে ক্রোধে বিপন্ন বিধ্বস্ত নারী স্ত্রী আমার আহাদাতী হন। (কাব্যনাট্যসমগ্র ৬০২)

 

উত্তরবংশের শৈলিবিচার

 

নাট্যকারের মনে এই ঘটনা এতটাই তীব্রভাবে আঘাত করে যে, তিনি আজীবন বিপত্নীক থেকে যান। এমনকি নিজ কন্যার কাছ থেকেও তিনি তার মায়ের আত্মহত্যার প্রকৃত কারণ গোপন করে গেছেন। পাকিস্তানি হানাদার কর্তৃক একজন নির্যাতিত নারী সংসারে ফিরেও যে রাষ্ট্রের অন্যায় ও অন্যায্য নীতির কারণে আবার আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন – এটি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাট্যকারের কাছে অগ্রহণযোগ্য, লঙ্ঘিত বিষয়।

কেননা তারা নিজেরাই প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রের নিপীড়ন ও বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে নাট্যকারের মধ্যে সবসময় আত্মগ্লানিবোধ কাজ করেছে। তাই তিনি আশা করেছেন যে অন্যায়ের বিচার তাঁরা করে যেতে পারেননি, একদিন তাঁর কন্যা তথা জাতির উত্তরবংশ তার উপযুক্ত বিচার করবে।

নাটকের আরেকটি প্রধান চরিত্র নাট্যকারের বন্ধু নেতা। এই রাজনৈতিক নেতা গতানুগতিক, তোষামুদে, অসৎ নন। তিনি অত্যন্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন বিশুদ্ধ মানুষ। কিন্তু বিরুদ্ধবাদী রাজনীতির কারণে তাকে সবসময় বোমা হামলার আশঙ্কা নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হয়। এমনকি তাকে সর্বত্র অনুসরণ করে যায় সরকারের পোষা গুপ্তচর। নেতা যে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃস্থানীয় দল আওয়ামী লীগের সদস্য তাও নানান প্রসঙ্গে নাটকে ইঙ্গিতায়িত হয়েছে।

এখানে নাট্যকার চরিত্রটিও প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের সমর্থক। বস্তুত, সৈয়দ শামসুল হক নিজেও ছিলেন এ দলের একজন বড় হিতাকাঙ্ক্ষী। ফলে নাট্যকার ও নেতা চরিত্রের নানান সংলাপে ব্যক্তি সৈয়দ শামসুল হকের কণ্ঠস্বরই সুস্পষ্ট হয়েছে। নেতা চরিত্রের একটি সংলাপে নেতা ও নাট্যকার উভয়েই যে নৌকা প্রতীকের সমর্থক, তার প্রমাণ মেলে। যেমন নাট্যকারকে উদ্দেশ্য করে নেতা বলেছেন :

লক্ষ করেছো কিনা, মিল আমাদের একটা জায়গায়

দরিদ্র মাঝি ছিলো তোমার প্রথম কবিতার বিষয়।

আর মাঝির সেই নৌকোটিকে আমি দেখে উঠলা

মুক্তির সমুদ্রে পৌঁছে যাবার এক প্রতীক (কাব্যনাট্যসময় : ৫৮৭)

নেতা চরিত্রটি একজন সর্বহারা মুক্তিযোদ্ধা। দেশমাতৃকাকে হানাদার ঘাতকের হাত থেকে বাঁচাতে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু তার বিনিময়ে তাঁকে হারাতে হয়েছে সবকিছু নিকটজনের মৃত্যু হয়েছে, বিধবা বোন হয়েছে ধর্ষিত। নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হক এখানে নেতার বোনের ধর্ষিত হবার যে নির্মম চিত্র বর্ণনা করেছেন তার সঙ্গে রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সুইপার প্রত্যক্ষদর্শী রাবেয়া খাতুনের বর্ণনার সাদৃশ্য রয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধে বিপুলসংখ্যক মানুষের আত্মদান, অগুনতি নারীলক্ষ্মীর সম্ভ্রম হারানোর প্রতিকার কিছুতেই আর সম্ভব নয়। তবু যারা এই ঘৃণ্য ও অমানবিক নৃশংসতার সঙ্গে জড়িত, তাদের আশু বিচার যে প্রয়োজন, এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখেই সৈয়দ শামসুল হক রচনা করেছেন উত্তরবংশ নাটক।

নাট্যকারের মেয়ে চরিত্রটি একবিংশ শতাব্দীর ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া, শিক্ষিত, স্বাবলম্বী, দায়িত্বসচেতন তরুণপ্রজন্মের প্রতিনিধি। মেয়েটি শৈশব থেকেই মাতৃদেহবঞ্চিত, পিতাকে সে মাতৃদেহে আগলে রেখেছে। সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব সে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে।

নাটকের শুরুতে আমরা একজন মমতাময়ী, দায়িত্বশীল কন্যাকে পেয়েছি। কিন্তু যে মুহূর্তে মেয়েটি মায়ের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে পেরেছে, তখনি আমাদের সম্মুখে এক প্রতিবাদী রাজনীতিসচেতন চরিত্রেরই যেন আবির্ভাব ঘটেছে, যে তার নাট্যকার পিতার নির্লিপ্ততা, নেতার পলায়নবাদিতার বিরুদ্ধে ঠিক কথা বলতেও দ্বিধা করেনি।

বস্তুত, উত্তরবংশ মনে করছে পূর্বঙ্গ শিল্পী-বোদ্ধারা যথাযথ ভূমিকা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে তাদের কলমের মাধ্যমে। তারা কেবল যুদ্ধের বিরহগাথা, অত্যাচারের কাহিনি রচনা করে গেছে বিলাপের মতো করে। কিন্তু জাতির বুকে এই দুর্দশা কেন নেমে এসেছে, বা এই ষড়যন্ত্রের মূল হোতা কারা, তাদের পরিচয় সঠিকভাবে তুলে ধরে উত্তরপ্রজনুকে সতর্ক করতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। আর একারণেই বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ঘাতকেরা ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে নতুন প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করতে পেরেছে অনায়াসেই।

নাট্যকারের মেয়ে চরিত্রটি তার বাবার প্রতি যে ক্ষোভ উপরে দিয়েছে, তা যেন এদেশের নিস্পৃহ লেখক বুদ্ধিজীবীদের প্রতি তরুণ প্রজন্মের অভিযোগ। মেয়ের বক্তব্য উল্লেখ্য :

তুমি দাবানলের সেই দিনরাত্রির কথা বলেছো,

তোমার কলমে তুমি সেই দোজখের বর্ণনা করে গেছো। ……

কিন্তু কেন মানুষকে হত্যা করা হচ্ছিলো

তুমি তার কথা বলোনি।

মানুষ কেন ঘুরে দাঁড়িয়েছিলো, তা মনে করিয়ে পাওনি তুমি।

মানুষ কেন স্বাধীনতা চেয়েছিলো, তুমি তার কথা বলো নি । …..

ধর্মের নামে ভাই ডেকে ভুলিয়ে যারা দেশটিকে করেছিলো শোষণ,

বিকট সেই প্রতারণার কথা তুমি নাটকে আনোনি।

তুমি শুধু তোমার প্রতিভার কলমে, শব্দের পর শব্দরোল তুলে

ক্রন্দন রচনা করেছো যেন নতুন এক কারবার – […]

ফোরাতের তীরে নিহত ইমামের স্মরণে যেমন-

তুমিও তেমনি চেয়েছো মানুষের রক্তটাকেই মনে রাখুক!

কিন্তু কেন রক্তপাত ঘটেছিলো তার পূর্বাপর কারণটাকে

কিনা এখনো যে আবার আমাদের রক্ত করতে পারে গুদেরই হাতে-

তুমি আমাদের সতর্ক করোনি। বিশ্লেষণ করে তুমি কিছুই বলোনি। (কাব্যনাট্যসমগ্র: ৫৯৬)

বস্তুত, সৈয়দ শামসুল হক নাটকের মেয়ে চরিত্রটির মাধ্যমে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের সম্মুখে একাত্তরের সত্য ইতিহাস জানাতে চেয়েছেন, যাতে তারা পাকিস্তানি ঘাতকবাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের অত্যাচারের বাস্তব কাহিনি জেনে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠতে পারে।

যে বিচার, যে দায়িত্ব অতীতে অগ্রজরা পালন করতে পারেনি প্রতিকূল সামাজিক-রাজনৈতিক-রাষ্ট্রিক কারণে, সে- কাজ সমাধা করতে উত্তরপ্রজন্ম অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। মেয়ে তাই পিতাকে প্রতিবাদী সভায় আত্মপ্রকাশের আহবান জানিয়ে বলেছে

সুনীতির মঞ্চে তুলে ধিক্কার জানানো আর নয় –

ধর্ষক ঘাতক শত একাত্তর সালের প্রত্যেকে,

যুদ্ধ অপরাধী যত মুক্তিযুদ্ধকালে, প্রত্যেকে

আজ যারা মিশে আছে জনপদে, খোজো –

|… | বিচারে ওঠাও তাদের দন্ড দাও, দন্ড দাও, দাও (কাব্যনাট্যসমগ্র: ৬০২)

মেয়েটি আত্মপ্রতিজ্ঞায় উদ্দীপিত হয়ে আরও বলেছে

আমার মা, আমার বোন, আমার ভাই, আমার পূর্বপুরুষেরা,

আমি উত্তরবংশের মেয়ে, আমরাই করবো বিচার।

বাবা, আমি তোমার উত্তরপ্রজন্য তোমরা যেখানে বার্থ,

আমরা সেখানে হতে চাই সফল। (কাব্যনাট্যসমগ্র: ৬০৫)

 

উত্তরবংশের শৈলিবিচার

 

২০১২ সালের ১৩ আগস্ট গোলাম সারোয়ারের নির্দেশনা ও কণ্ঠশীলনের প্রযোজনায় উত্তরবংশ নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয়। তবে মাত্র ৮টি প্রযোজনার পর এটির মঞ্চায়ন থেমে যায়। গোলাম সারোয়ার এ নাটকটি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী দেশের সব মানুষ আরেক যুদ্ধ করে চলেছে বাংলাদেশের ভেতরে যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচারের দাবি নিয়ে। কালের পরিক্রমার এই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে এগিয়ে আসে নতুন প্রজন্ম। এমনই একটি বিষয়ের উপস্থাপন করেছেন নাট্যকার তাঁর উত্তরবংশে।

নিরীক্ষাপ্রবণ নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হক তাঁর উদ্ভবেংশ কাব্যনাটকের প্লট নির্মাণেও যথেষ্ঠ মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। প্রচলিত গ্রিক নাট্যফর্মের পঞ্চাঙ্ক সূত্র অনুসরণ না করে কেবল বারোটি দৃশ্যে তিনি নাটকের গল্প সাজিয়েছেন। এরমধ্যে কিছু কিছু দৃশ্য আবার সংলাপহীন, শুধু মঞ্চনির্দেশে চরিত্রের অঙ্গভঙ্গি ও অভিক্ষেপের মাধ্যমে দৃশ্যটি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

নাটকের ১ম থেকে ৪র্থ দৃশ্য এরকম ছোট ছোট ঘটনাপুঞ্জে সাজানো হয়েছে। সরাসরি চরিত্রের মুখের সংলাপের মাধ্যমে কাহিনির সূচনা হয়েছে ৫ম দৃশ্য থেকে। নাটকটি যেহেতু অতীত ও বর্তমান সময়ের সমন্বয়ে রচিত, সেহেতু নাট্যকার প্রায়শ স্মৃতিকাতর হয়ে পড়েছেন।

অতীতের এই ঘটনাবলি সৈয়দ শামসুল হক উপস্থাপন করেছেন ফ্লাশবাকরীতির আশ্রয় নিয়ে। যেমন: নাট্যকারের স্ত্রীর আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুর প্রকৃত কারণ বা রহস্য কী, এটিই বস্তুত আলোচা নাটকে প্রথম থেকে একটি কৌতূহল সৃষ্টি করে দর্শক-পাঠক মনে। এ পর্যায়ে তাই ফ্লাশব্যাক রীতিতে নাট্যকার চরিত্রের স্মৃতিতে প্রফিলিত হয়েছে পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে নাট্যকারের স্ত্রীর নিগ্রহের করুণ চিত্র।

এ দৃশ্যে সৈয়দ শামসুল হক যেভাবে নাট্যকারের স্ত্রীর নির্যাতনের ছবি এঁকেছেন, তা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের নিগৃহীত সময় নারী সমাজের চিত্র বলে প্রতীয়মান হয়েছে। এর পূর্বে দর্শক আভাসে ইঙ্গিতে নাট্যকারের স্ত্রীরা প্রতি পাকিস্তানি নরপশুদের নির্যাতন প্রসঙ্গে অবগত হয়ে থাকলেও এ দৃশ্যে এসে পুরোপুরি জেনে যায় এবং নিশ্চিত হয় যে, নাট্যকারের স্ত্রী হানাদারদের হাতে ধর্ষিত ও নির্যাতিত হয়েছিল। কিন্তু নাট্যকারের মেয়ে তার মায়ের আত্মহত্যার প্রকৃত কারণ কখন জানবে, বা আদৌ জানবে কিনা, অথবা জানলেও তার প্রতিক্রিয়া কী হবে সেটিই তখন দর্শকের উৎকণ্ঠার বিষয় ছিল।

৬ষ্ঠ দৃশ্যে কেবল মঞ্চনির্দেশের মাধ্যমে সংলাপহীন যে নারকীয় নির্যাতন দৃশ্য উপস্থাপিত হয়েছে তা প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় উপস্থাপন করা যেতে পারে

আলো জ্বলে ওঠে। সামরিক বেশে নিপরীত মানুষেরা শূন্য মঞ্চস্থানে আসে। এবার তাদের সঙ্গে সাধারণ বেশে। স্থানীয়দের দেখা যায়। প্রত্যেকে তারা একেকটি মেয়েকে টেনে হিচড়ে নিয়ে আসে। মেঘেরা চেষ্টা করে। ছোটাছুটি করে। নারকীয় উল্লাসে বিপৰীত মানুষেরা তাদের ধাওয়া করে। … আননি সঙ্গীতে-বাঁশীর তীক্ষ্ণ স্বর ও দুন্দভির মতো ভারী ঢোলক শব্দ। মেঘেরা সংজ্ঞা হারায়। এক মুর্তী – আসলে নাট্যকারের স্ত্রী তার ওপর আলো গুটিয়ে আসে। একটু পরে ধীরে সে মাথা তোলে। তার এলোমেে চুল মুখ বুক দিয়ে পড়েছে। মুখ বিক্ষত। (কাব্যনাট্যসমগ্র ৫৬৫)

নাট্যকার সৈয়দ শামসুল হক ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আলোচ্য দৃশ্যটি পুরোটাই নির্মাণ করেছেন মধ্যনির্দেশের মাধ্যমে। অর্থাৎ পুরো দৃশ্যটি নাটকের মূল চরিত্রগুলোর সংলাপবিহীন একটি বাস্তবচিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপিত হবে। নাট্যকার এই দৃশ্যটির মাধ্যমে বস্তুত ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের অপরাধ কতটা ভয়াবহ ছিল সে সম্পর্কে একটি ধারণা দিতে চেয়েছেন।

নাট্যকার এই দৃশ্যটি নির্মাণে শিল্পীর কল্পনার তুলনায় ইতিহাসবেত্তার মতো বাস্তবানুগ হতে চেয়েছেন পাঠক-দর্শককে ১৯৭১ সালের নারী নির্যাতনের ভয়াল ছবিটি মূলানুগ করে দেখাবার প্রয়োজনে। কেননা তিনি এখানে নারী নির্যাতন, ধর্ষণের যে পাশবিক চিত্রটি সৃষ্টি করেছেন সেই বর্ণনার সঙ্গে ১৯৭১ সালে নারী নির্যাতনের প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। অর্থাৎ নাটকের প্লট গঠন, মধ্যপরিকল্পনা, পাত্র-পাত্রী নির্বাচনে সৈয়দ শামসুল হকের সনিষ্ঠ যত্ন ও প্রভা সহজেই নজর কাড়ে।

উত্তরবংশ নাটকে মুনীর চৌধুরীর (১৯২৫-১৯৭১) কবর (রচনা ১৯৫৩) নাটকের প্রভাব স্বাক্ষণীয়। সৈয় হকের রচনায় মুনীর চৌধুরীর লেখনীর প্রভাব নাট্যকনা নিজেই স্বীকার করেছেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন

আমার মনে হয়, একমাত্র অাজদের মধ্যে আমি সৈয়দ উল্লাহ এবং মুনীর চৌধুরী, এ দু’জনকে গ্রহণ করেছি ?

মুনীর চৌধুরীর কবর নাটকে যেমন লাশ কবর থেকে উঠে আসার দৃশ্য রয়েছে তেমনি উত্তরবংশ নাটকের শেষের দিকের একটি দৃশ্যে চকখড়ির মতো সানামুখ অসংখ্য মৃত নারী-পুরুষ মঞ্চে উঠে আসে বিচারের দাবিতে। এরা মূলত একাত্তরে নির্যাতিত নারী-পুরুষের আত্মা। তারা নিজেদের পরিচয় নিয়ে ঘুরে ঘুরে বিচারের দাবি জানিয়ে উচ্চারণ করতে থাকে।

আমরা আর কারে থাকবো না।

আমরা আর কান্নার রোগে বাতাস ভারী করাবো না।

আমরা উঠে এসেছি বধ্যভূমি থেকে-

আমরা উঠে এসেছি অমাবস্যা সরিয়ে – I…]

আর কতকাল আমাদের অপেক্ষা করতে হবে –

একটি বিচারের জন্যে ( কাব্যনাট্যসমগ্র ৬০৫)

“আমরা আর কবরে থাকবো না’ সংলাপটি কবর নাটকের লাশদের সংলাপের কথা স্মরণ করিয়ে দেনা। নীর চৌধুরীর কবর ছিল ৫২-র ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত প্রতিবাদী নাটক, আর উত্তরবংশ ১৯৭১-এ মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিপ্রেক্ষিতে রচিত প্রতিবাদী নাটক।

উত্তরবংশ নাটকটির কলেবর তুলনামূলকভাবে সৈয়দ শামসুল হকের অন্যান্য নাটক থেকে বৃহৎ। এ নাটকটি একটি বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে রচিত হলেও সংলাপগুলো নিছকই স্লোগানধর্মী হয়ে ওঠেনি। বরং একজন অসামান্য কবির হাতে সংলাপের ভাষায় কাব্যের লালিত্য, মাধুর্য অনন্য হয়ে উঠেছে।

বস্তুত, গৈয়ন শামসুল হকের রচনা থেকে আমরা নতুনভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছি, বাংলাভাষার শক্তি কত প্রবল ও ঐশ্বর্যবান! আমাদের এই বাংলাভাষাকে সৈয়দ শামসুল হক নতুন নতুন রূপ দিয়েছেন। কতভাবেই না তিনি ব্যবহার করেছেন বাংলা ভাষাকে। কখনো নিপাট নিটোল সাজানো-গোছানো রূপ দিয়েছেন, কখনো নিয়েছেন আঞ্চলিক ভাষার তীব্রতার পরিচনা, কখনো নিয়েছেন কাচের মতো ধারালো আকাট মুখের ভাষার প্রায়োগিক রূপ। [ …] বাংলা ভাষার একজন প্রবল প্রতিভাবান লেখক হিসেবে তিনি আবিষ্কার করতে পেরেছিলেন বাংলা ও বাঙালির শক্তির উৎস।”

সৈয়দ শামসুল হকের অন্যান্য কাব্যনাটকে আঞ্চলিক ভাষায় সংলাপ রচিত হলেও এ নাটকে তিনি চরিত্রের শ্রেণি- অবস্থান বিবেচনায় রেখে প্রমিত বাংলা ভাষার সংলাপ ব্যবহার করেছেন। নাটকের প্রধান তিনটি চরিত্রই উচ্চশিক্ষিত, শহরে, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি। ফলত, তাদের মুখের ভাষায় আঞ্চলিকতার ছাপ সংলাপের গাঁথুনিকে দুর্বল করে দিতে পারতো।

এছাড়াও একজন সফল কবি হিসেবে নাট্যকার উপমা-উৎপ্রেক্ষা- চিত্রকল্পের সমন্বয়ে সংলাপকে শিল্পিত করে তুলেছেন। ২৫শে মার্চ ১৯৭১-এ লুকোনো অবস্থায় গণহত্যা ও হত্যা-ধর্ষণ-লুণ্ঠনদৃশ্য অবলোকন করেছিলেন তা তুলনা করেছেন সাগরে ডুবন্ত জাহাজের পেরিস্কোপের সঙ্গে।

জানালার নিচে মাথা

ডুবোজাহাজের পেরিস্কোপের মতো আমার চোখ তুলে

আমি দেখেছি- আমি দেখেছি – L…..

পৃথিবীর ইতিহাসে বৃহত্তম, পাশবিকতম, সবচেয়ে ভয়াবহ

সেই হত্যা, সেই গণহত্যা। সেই ধর্ষণ। সেই মৃত্যু। ( কাব্যনাট্যসময় ৫৬৩)

আবার মুক্তিযুদ্ধকালে অসহায় তরুণ যোদ্ধাকে তিনি তুলনা করেছেন ভেজাবারুদের সঙ্গে। ভেজাবারুদ যেমন আপাত অক্ষম, কিন্তু অন্তরে লালন করে অগ্নিভূলিঙ্গ, তেমনি একাত্তরের বিদ্যা রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নিরুপায় যুবক লালন করছে প্রতিবাদ, দ্রোহের আগুন। এ সময় ও সমাজকে নাট্যকার তুলনা করেছেন আমারে আরে সঙ্গে

লাগাতার কারফিউ। বাইরে গোলাগুলি। একাত্তর। ……

ভেজাবারুদের মতো যুবক প্রতিধধনি করে ওঠে – খবর

…. দোজখের তাপে তপ্ত ধারালো ছুরির মতো রোদ। কাব্যনাট্যসমগ্র ৫৫৬)

 

উত্তরবংশের শৈলিবিচার

 

এরকম আরও কিছু শিল্পিত, তাৎপর্যপূর্ণ উপমা, উৎপ্রেক্ষা, অগভারের উদাহরণ নিয়ে উপস্থাপন করা হলো :

উপমাঃ

১. মানুষের বুকে যে কথাগুলো পাথরের মতো আছে

তাকে গলিয়ে বর্ণার উদ্দান ধারা সৃষ্টি করতে হবে আজ টস ৫৬৫)

২. প্রতিমুহূর্তে মাকে বিজয়ে ধরে রাখতে হয় –

নইলে গোলাপী তুলোর মিঠাইয়ের মতো হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। (কাব্যনাট্যসমগ্র ৫৮০ )

৩. কবিতার ধ্বনির মতো অনুভব করছো বলেই

এমন উচ্চারণের বোল তুমি শব্দের ভেতরে পরেছো (কাব্যনাট্যসময় ৫৮৯)

৪. অতীতকে এত বেশি মনে রাখলে অতীত পেছন থেকে

শেকলের মতো টানে পেছনেই এতে রাষ্ট্রের চলন থামে … ( কাব্যনাট্যসমগ্র ( ৫৯৩)

৫. মানুষের হৃৎপিণ্ড তপ্ত খোলার খৈয়ের মতো ফোটে। (কাব্যনাট্যসমগ্র ৫৯৮)

উৎপ্রেক্ষা

১. মেয়েদের টেনে টেনে বের করেছিল ঘর থেকে

দাঁত মার গুদের হিংসে তীক্ষ্ণ কামুক,

যেন পৃথিবীর সমস্ত মাতৃদুধ ওরা শোষণ করে নিতে

নিকটের গর্ভ থেকে জন্ম নিয়ে জনপদে নেমেছে। কাব্যনাট্যসময় ৫৬৩)

২. তুমি শুধু তোমার প্রতিভার কলমে, শব্দের পর শব্দরোল তুলে

ক্রন্দন রচনা করেছো, যেন নতুন এক কারবালার নতুন মর্সিয়া –

যেন মিছিলের পর মিছিলে গীত হবে সেই শোক সময় ৫৯৫-৫৯৬)

৩. রকাক্ত আঁধার ঠেলে রক্ত মেখে সূর্য ওঠে রোজ মিলিটারি ট্রাক-

তার পাড়ঝাড় শব্দটা যেন করাত চিরে ফেলে জগত। (কাব্যনাট্যসমগ্র ৫৯৮)

৪. নিঃশব্দে সমস্ত কিছুর পতন আর থমথমে অনিশ্চয়তা যেন

মিস্তিরির হাতে শিরিষের মোটা কাগজ (কাব্যনাট্যসমগ্র ৫৬০)

সমাসোক্তি

১. বাতাস আজও মায়ের বোনের কান্নার অবিশ্রদ্ধ রোল করে ফেরে…… ( কাব্যনাট্যসমগ্র ৬০৭ )

২. আপনার আদর্শ আজ ধর্ষিত চেতনার জানু বেয়ে রক্ত ঝরছে। (কাব্যনাট্যসমগ্র ৬০৬)

৩. নালপড়া বুটের শব্দ গজাল ঠুকে চলে মানুষের হৃৎপিণ্ডে। (কাব্যনাট্যসমগ্র ৫৯৮)

৪. খসে খসে পড়ছে রাষ্ট্রের মাংস, নগ্ন হয়ে পড়ছে নাভিমূল, আর শত্রুরা তাদের তীক্ষ্ণ চক্ষুতে ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে। (কাব্যনাট্যসমগ্র ৫৮০ )

৫. কখনো কখনো কী জানো, সময় কেমন চেপে ঠেসে আসে।

অতীত অস্থির হয়ে ওঠে। ভবিষ্যৎ আর্ত হয়ে পালায়।

সময় কি সময়ের গতিতেই আছে ? নাকি অতীত ফিরে এসে অট্টহাসি করছে- (কাব্যনাট্যসমগ্র ৫৬৬) –

চিত্রকল্প :

১. পৃথিবী নীল হয়ে গেছে হিমে –

ঘরের বাঁশ বেড়া হিম, পায়ের নিচে উঠোন হিম

আকাশ হিম বাতাস হিম, নদীর পানি বরফের মতো হিম

কিন্তু ওই উনোনের চাপা দেয়া কড়াইয়ের ওলটানো পিঠ

বিশাল কাছিমের মতো উবু হয়ে ? ওটাও কি হিম ?

একদিন খুব ভোরে উঠেছি, পায়ে পায়ে এগিয়ে গেছি। –

কড়াইটার পিঠে হাত দিতেই ছ্যাঁত করে উঠলো হাত

তাতানো কড়াইয়ের পিঠ, ফোসকা পড়ে গেলো হাতে।

ভাবিনি যে আগুনটা মরে যায়নি দীর্ঘ সারা রাতেও –

আছে হিমের ভেতরে মাথামুড়ি দিয়ে। (কাব্যনাট্যসমগ্র ৫৮৯)

২. জীবন যে অনুভব করে

সে যেন পাষাণ ভেঙে বরফ গলিয়ে

প্রবল তিস্তার মতো হিমালয় থেকে নেমে আসে সমতলে –

কলকল বলখন উল্লাসের করতালি বাজিয়ে বাজিয়ে

ফসলের জন্যে পলি ফেলতে ফেলতে

যমুনায় গিয়ে ঝাঁপ দেয়,

যমুনাকে জাগিয়ে তোলে সে

মাতিয়ে ভরিয়ে তুলে মরা যমুনাকে

আবার জীবন দেয়, নতুন জীবন।

যমুনা যৌবন পায়।

তখন যমুনা তাকে জংঘার ভেতরে নিয়ে

সারা দেশে পলি ফেলে যেতে যেতে,

দু’পাড়ে ধানের বান ফসলের সাচ্ছলতা ফলাতে ফলাতে

পদ্মাকে ডাক দিয়ে বলে-

আয়, শরীরের ভেতর আয়

মেঘনার দিকে তার তরঙ্গের মুদ্রা তুলে বলে-

তোর কালো শ্রোতের ভেতরে

ব্ৰহ্মপুত্ৰ আয় নিবি আয় –

মৎসবর্তী হব আজ, সময় হয়েছে। (কাব্যনাট্যসমগ্র : ৫৮৯)

 

উত্তরবংশের শৈলিবিচার

 

পুরাণ

১. ভুলে গিয়েছিলে শত্রু হচ্ছে রক্তবীজের ঝাড়, একটি ফোঁটাও যতদিন থাকে – নতুন শত্রু জন্ম হতেই থাকে। (কাব্যনাট্যসমগ্র : ৫৮০) ।

ভারতীয় পুরাণ মতে, দানবরাজ রঙের রূপান্তরিত রূপ হল রক্তবীজ। ইনি দৈত্যরাজ শুম্ভ-নিশুম্ভের সেনাপতি ছিলেন। দেবির সঙ্গে শুভ-নিশুম্ভের যুদ্ধকালে রক্তবীজ ও দেবির সহচরীদের ঘোর যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে এর শরবিদ্ধ দেহ হতে যত বিন্দু রক্ত ভূমিতে পড়ত, তা থেকে রক্তবীজের মতো ভয়ঙ্কর বলবীর্য মহাসুর উদ্ভূত হত। এই জন্য ইন্দ্র নিজের বজ্র দিয়ে একে নিপাত করতে গেলে শত শত রক্তবীজের আবির্ভাব হয়েছিল।

শেষে দেবী মহাশক্তি দেবতাদের বিপথে দেখে নিজের অঙ্গীভূতা কালীকে বললেন, সমস্ত রক্ত-বীজস্বরূপ দৈত্যকে ভক্ষণ কর এবং রসনাবিস্তার করে সমস্ত শোণিত পান কর। তা’হলে রক্তবীজ নিঃশোণিত হয়ে আমার হস্তে নিহত হবে। দেবী মহাশক্তি চামুণ্ডা ও কালীর সাহায্যে রক্তবীজের নিপাত করেন।

আলোচ্য নাটকে সৈয়দ শামসুল হক একাত্তরের বিপুল পরাজয়ের পরও পাকিস্তানপন্থী রাজাকার-দালাল সম্প্রদায়ের ধীরে ধীরে এ দেশের রাজনীতিতে স্থায়ী হওয়া প্রসঙ্গে আলোচ্য পৌরাণিক দৃষ্টান্ত ব্যবহার করেছেন। রক্তবীজের যেমন আমূল বিনাশ প্রয়োজন, নইলে উত্তরোত্তর শক্তিবৃদ্ধি করতে থাকে, তেমনিভাবে রাজাকার-মানবতাবিরোধীদের আমূল বিনাশ প্রয়োজন, যেন তারা আর শক্তি ও সংখ্যা বৃদ্ধি না করতে পারে।

এদের বিরুদ্ধেই তো একাত্তরে উঠে দাঁড়িয়েছিলো মানুষ – / এখন সেই ওরাই আবার ছদ্মবেশে ছিদ্র কেটে – ঢুকেছে -/ লখিন্দরের বাসরে সাপ! ছিদ্র কেটেছে কি সদর পথেই এসেছে / রাষ্ট্র ছিনতাইকারীরাই ডেকে এনেছে তাদের- (কাব্যনাট্যসমগ্র : ৫৯৩)

বেহুলা লখিন্দরের গল্প বাঙালির লোকজ পুরাণের অংশ। বেহুলা মনসামঙ্গলের প্রধান নারী চরিত্র এবং তাঁর স্বামী হলো চাঁদ সওদাগরের পুত্র লখিন্দর। আলোচ্য কাব্যনাট্যে স্বাধীন বাংলাদেশকে লখিন্দরের নিশ্ছিদ্র বাসরঘরের সঙ্গে তুলনা করে পাকিস্তানপন্থি মানবতাবিরোধীদের সর্পের সঙ্গে প্রতিতুলনা করা হয়েছে; যারা জনগণের অসতর্কতায় ঢুকে পড়েছে রাষ্ট্রযন্ত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।

৩. পরনের শাদা শাড়িটি স্বাভাবিকের চেয়ে বহুগুণ দীর্ঘ, আঁচলটি লাল রক্ত মাখা। মঞ্চ সে পরিক্রম করতে থাকে, আর্চল তার লুটিয়ে থাকে, টানে টানে খুলে যেতে থাকে যেন অন্তহীন। (মঞ্চনির্দেশ, কাব্যনাট্যসমগ্র : ৬০৪)

এখানে অবশ্য নাট্যকার পুরাণ থেকে সরাসরি কোনো চরিত্র বা প্রসঙ্গ উত্থাপন করেননি। তবে দীর্ঘ আঁচল এবং টানে টানে শাড়ি খুলে যেতে থাকা চিত্রসংবলিত যে মঞ্চনির্দেশ তিনি প্রদান করেছেন, তাতে সুস্পষ্ট হয় যে, তিনি মহাভারত- পুরাণে উল্লেখিত চরিত্র দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণের সঙ্গে ১৯৭১ সালে পাকহানাদার বাহিনীর হাতে এদেশের মা-বোনের ধর্ষিত হবার ঘটনা তুলনা করেছেন। ।

সৈয়দ শামসুল হক তাঁর উত্তররবংশ কাব্যনাটকটি একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে রচনা করেছেন। বস্তুত তিনি চেয়েছিলেন এ নাটকটি রচনা ও মঞ্চায়নের মাধ্যমে দেশের তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের প্রকৃত ইতিহাস পৌঁছে দেবেন। এর ফলে একাত্তরের ঘাতক-দালাল-রাজাকারদের বিচার-প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে। তবে বিষয়মুখ্য এ রচনাটির শিল্পসৌন্দর্যের দিকেও তিনি সমান লক্ষ রেখেছেন। প্লট গঠন, চরিত্রায়ণ, ভাষাগত মাধুর্য- সবদিকেই তিনি সমান নজর রেখেছেন। ফলে রাজনৈতিক বিষয় নিয়েও উত্তরবংশ কাব্যনাটকটি একটি যথার্থ কাব্যনাটক হয়ে উঠতে পেরেছে।

আরও দেখুনঃ

Leave a Comment